আসামি মাজেদকে হাজির করা হয় কোর্টে -
১৩ অক্টোবর ২০১৯, রবিবার, ৪:২৪

আবরার হত্যা

স্টিকের দেড় শ’ আঘাতের কথা স্বীকার অনিকের

পাঁচ দিনের রিমান্ডে মাজেদুর ; মোয়াজ নামে আরেকজন গ্রেফতার

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যা মামলায় বুয়েট ছাত্রলীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অনিক সরকার ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল শনিবার ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত এই আসামির জবানবন্দী রেকর্ড করেন। পরে অনিক সরকারকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত।

পুলিশ ও আদালত সূত্র বলছে, অনিক তার জবানবন্দীতে আবরার ফাহাদকে ক্রিকেটের স্টাম্প দিয়ে বেধড়ক পিটিয়ে গুরুতর জখম করার কথা আদালতে স্বীকার করেছেন। সংশ্লিষ্টসূত্র জানায়, অনিক একাই অন্তত দেড়শ’বার আবরারকে আঘাত করার কথা স্বীকার করেছেন। এ ছাড়া মারধরের সময় নিজের ভূমিকার বিষয়েও জিজ্ঞাসাবাদে তথ্য দিয়েছেন। অনিক বলেছেন, আবরার একেক সময়ে একেক তথ্য দিচ্ছিলেন। এ জন্য তার মাথা গরম হয়ে যায়। ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি তাকে বারবার মারছিলেন। নির্যাতনের একপর্যায়ে আবরার যখন নিস্তেজ হয়ে পড়ছিলেন, তারা বলছিল, ‘ও ঢং ধরেছে’। এ সময় হামলাকারীদের নানা পরামর্শ দেন বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল। এদিকে অনিক সরকার ও ইফতি মোশাররফ আবরারকে পেটাতে পেটাতে ভেঙে ফেলে ক্রিকেট স্টাম্প। রাত ৮টা থেকে সোয়া ১টা পর্যন্ত বুয়েটের শেরেবাংলা হলের ২০১১ এবং ২০০৫ নম্বর রুমে দফায় দফায় আবরারের ওপর এভাবে নিষ্ঠুর নির্যাতন চলে। পরে রাত ১২টার পর ২০১১ নম্বর রুমের টর্চার সেল থেকে বের হয়ে যায় অনিক। এরপর নির্যাতন চলে রাত সোয়া ২টা পর্যন্ত। অনিকের নিস্তেজ দেহ নিয়ে ছোটাছুটি করেন হত্যাকাণ্ডে জড়িতরা। এভাবেই আবরার হত্যার লোমহর্ষক বর্ণনা দেন অনিক।

এদিকে গ্রেফতার আরেক আসামি মাজেদুর রহমান নওরোজকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। এ ছাড়া হত্যা মামলার আরেক আসামি মোয়াজ আবু হুরায়রা নামে একজনকে গ্রেফতার করেছে গোয়েন্দারা। এ নিয়ে গত ছয় দিনে মোট ১৯ জনকে গ্রেফতার করা হলো।

জানা গেছে, আবরার হত্যাকাণ্ডের বর্ণনার সাথে তার নিজের জড়িত থাকাসহ অপর আসামিদের নাম প্রকাশ করেছেন এবং হত্যার সময় কার কী ভূমিকা ছিল তা-ও বলে দিয়েছেন অনিক।

গত ৬ জুন আবরার হত্যার পরপরই যে ১০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল, তাদের একজন অনিক। গ্রেফতারের পর তাকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়েছিল পুলিশ। রিমান্ডের চার দিনের মাথায় গতকাল শনিবার অনিককে ঢাকার আদালতে নিয়ে তার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী নেয়ার আবেদন জানায় মামলা তদন্তের দায়িত্বে থাকা ডিবি। বুয়েট ছাত্রলীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অনিক সরকার মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পঞ্চদশ ব্যাচের শিক্ষার্থী। আবরারের বাবার করা মামলায় আসামি হওয়ার পর তাকে বহিষ্কার করে ছাত্রলীগ।

ঢাকা মহানগর পুলিশের অপরাধ, তথ্য ও প্রসিকিউশন বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার ফজলুর রহমান জানিয়েছেন, অনিক সরকার ১৬৪ ধারায় জবাববন্দী দিয়েছেন। মহানগর হাকিম আতিকুল ইসলাম তার খাস কামরায় জবানবন্দী নেন। এর আগে বুয়েট ছাত্র মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন ও ইফতি মোশাররফ সকাল স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেন।

মাজেদুর ৫ দিনের রিমান্ডে : অন্য দিকে এই মামলায় গ্রেফতার আবরারের সহপাঠী মাজেদুর রহমান ওরফে নওরোজকে পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। গতকাল মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক ওয়াহিদুজ্জামান আসামিকে আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেন। শুনানি শেষে ঢাকা মহানগর হাকিম নিভানা খায়ের জেসী পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

আবরার হত্যাকাণ্ডের পর আসামির তালিকায় থাকা মাজেদুর ইসলামকে গত শুক্রবার সিলেট থেকে গ্রেফতার করে গতকাল আদালতে হাজির করা হলে তিনি জানান, তার নামটি ভুল বলেছে পুলিশ। এই বুয়েট ছাত্র সাংবাদিকদের বলেন, আমার নাম মাজেদুর রহমান নওরোজ। পুলিশ ভুল করে মাজেদুল ইসলাম লিখেছে। আবরারের বাবা ১৯ জনকে আসামি করে চকবাজার থানায় যে মামলাটি করেন, সেখানে আসামির তালিকায় ৮ নম্বরে মাজেদুর ইসলামের নাম রয়েছে। আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে এই বুয়েট ছাত্র বলেন, সিসি ক্যামেরার ফুটেজে আমাকে দেখা গেছে কি না, জানি না। আহত অবস্থায় আবরারকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়ার দলে আমিও ছিলাম।

এদিকে আসামি মাজেদের রিমান্ড আবেদনে তদন্তকারী কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, অনিক এজাহারনামীয় ৮ নম্বর আসামি। মামলার তদন্ত, সাক্ষ্য প্রমাণে ও ভিডিও ফুটেজ পর্যালোচনায় ঘটনার সাথে তার জড়িত থাকার সম্পর্কে যথেষ্ট সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। ইতঃপূর্বে গ্রেফতারকৃত আসামি ইফতি মোশারফ আদালতে দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে এই আসামির নাম প্রকাশ করেছেন। তাই মামলার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে অন্য আসামিদের শনাক্ত এবং গ্রেফতারে জন্য এই আসামিদের ১০ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন।

রিমান্ড শুনানিকালে রাষ্ট্রপক্ষে পুলিশের জিআরো এসআই মাজহারুল ইসলাম ও সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর হেমায়েত উদ্দিন খান হিরণ রিমান্ড আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন। তবে মাজেদের পক্ষে কোনো আইনজীবী না থাকায় রাষ্ট্রপক্ষে একতরফা রিমান্ড আবেদনের শুনানির পর ঢাকা মহানগর হাকিম নিভানা খায়ের জেসী পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। একই সাথে মঞ্জুরকৃত রিমান্ড আট কার্যদিবসের মধ্যে কার্যকর করার নির্দেশ দেন।

মামলাটিতে বর্তমানে বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মুহতামিম ফুয়াদ, সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান রবিন, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক মো: অনিক সরকার, কর্মী মুনতাসির আল জেমি, সদস্য মো: মুজাহিদুর রহমান, কর্মী খন্দকার তাবাখখারুল ইসলাম তানভির, গ্রন্থ ও প্রকাশনা বিষয়ক সম্পাদক ইসতিয়াক আহম্মেদ মুন্না, মো: মনিরুজ্জামান মনির, আকাশ হোসেন, সামছুল আরেফিন রাফাত, অমিত সাহা ও হোসেন মোহাম্মাদ তোহা রিমান্ডে রয়েছেন।

আরো একজন গ্রেফতার : আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত আরেক আসামিকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। তার নাম মোয়াজ আবু হুরায়রা (২০)। গতকাল বেলা ১১টার দিকে রাজধানীর উত্তরার ১৪ নম্বর সেক্টর থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। জানা গেছে, মোয়াজ আবু হুরায়রা বুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী। তার বাড়ি কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরের ওসমানপুরের পিরপুর গ্রামে। মোয়াজের বাবার নাম মাশরুর উজ জামান। এ নিয়ে আবরার হত্যায় গ্রেফতারের সংখ্যা ১৯।

গত ৬ অক্টোবর রোববার রাত ৩টার দিকে শেরে বাংলা হল থেকে তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল (ইইই) বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবরার ফাহাদের লাশ উদ্ধার করা হয়। ওই রাতে হলের ২০১১ নম্বর কক্ষে আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ১৯ জনকে আসামি করে পরের দিন সন্ধ্যার পর চকবাজার থানায় একটি হত্যা মামলা করা হয়। নিহত আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ বাদি হয়ে মামলাটি করেন।

http://www.dailynayadiganta.com/first-page/447668