১৩ অক্টোবর ২০১৯, রবিবার, ৪:২০

অধিকারের মানবাধিকার প্রতিবেদন

৯ মাসে বিচারবহির্ভূত হত্যা ৩১৫ : বিএসএফের হাতে মৃত্যু ২৮ জনের

২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে বাংলাদেশে ৩১৫টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। যার মধ্যে ৩০৬ জন তথাকথিত বন্ধুকযুদ্ধে মারা গেছে। এ সময়ে একজনকে পিটিয়ে আর চারজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। বাকি চারজনের মৃত্যু ঘটেছে নির্যাতনে। এ সময়ে গুমের ঘটনা ঘটেছে ২৪টি, আর কারাগারে মৃত্যু হয়েছে ৪৯ জনের। এই ৯ মাসে বিএসএফের হাতে ২৮ জন বাংলাদেশী নিহত হয়েছে, অপহরণের শিকার হয়েছে আরো ১৭ জন। মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। গতকাল শনিবার প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।

অধিকারের এই প্রতিবেদনে উল্লিখিত ৯ মাস সময়ে বাংলাদেশে ব্যাপক মানবাধিকার হরণের ঘটনার চিত্র তুলে ধরা হয়। এ সময়ে সারা দেশে ৮১০টি ধর্ষণের ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যার মধ্যে ৫৫৯ জনই হলো অনূর্ধ্ব ১৮ বছরের মেয়ে শিশু। এ সময় রাজনৈতিক সহিংসতা ও সাংবাদিকদের উপর ব্যাপক হুমকি ও লাঞ্ছনার ঘটনাও ঘটে। রাজনৈতিক সহিংসতায় এ সময় ৬০ জন নিহত হয় আর সাংবাদিক লাঞ্ছনা ও হুমকি প্রদানের ঘটনা ঘটে ৫৫টি।

অধিকারের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে নির্যাতনের অভিযোগ যথাযথ বা পর্যাপ্তভাবে তদন্ত হয় না এবং নির্যাতনের শিকার ব্যক্তির পরিবারের অভিযোগ গ্রহণে পুলিশ প্রায়ই অস্বীকৃতি জানায়। এমনকি অভিযোগকারী পরিবারগুলোকে পরে হুমকি, হয়রানি ও প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপের শিকার হতে হয়। অন্য দিকে দেশে গুমের ঘটনা অব্যাহত থাকলেও সরকার তা প্রতিনিয়ত অস্বীকার করছে। জাতিসঙ্ঘের নির্যাতনবিরোধী কমিটির ৬৭তম অধিবেশনে বাংলাদেশের ওপর পর্যালোচনা চলাকালে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিরা গুমের বিষয়টি অস্বীকার করলে কমিটি তাদের চূড়ান্ত পর্যবেক্ষণে অঘোষিত আটক ও গুমের ঘটনাগুলোর বিষয়ে সরকারের তথ্য প্রকাশের ব্যর্থতায় উদ্বেগ জানায়।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, দুর্নীতিগ্রস্ত অগণতান্ত্রিক সরকারগুলোর প্রচেষ্টাই থাকে জনগণের মত প্রকাশ ও সভা-সমাবেশ করার মতো অধিকারগুলো নস্যাৎ করা, যাতে জনগণ এই সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে না পারে। বাংলাদেশেও সেই একই পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অভাবে দেশে দুর্নীতি ও দুঃশাসন ব্যাপক রূপ নিয়েছে। সরকার সংশ্লিষ্ট প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অর্থ অর্জন এবং দুর্নীতির অর্থ বিদেশে পাচার করার অভিযোগ রয়েছে।

অধিকারের প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের প্রায় সব কারাগারের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে কারাগারে আটক বন্দীদের ওপর নির্যাতনসহ বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া কারাগারগুলোতে অতিরিক্ত বন্দী থাকার কারণে কারাবন্দীরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন এবং চিকিৎসা ব্যবস্থার অপ্রতুলতার পাশাপাশি কারাগার কর্তৃপক্ষের গাফিলতির কারণে কারাবন্দীদের মৃত্যু ঘটছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

অধিকারের প্রতিবেদন অনুসারে বিরোধী রাজনীতিতে জড়িত থাকা ও ভিন্নমতের কারণে অনেক মানুষের ওপর সরকার গ্রেফতার, নির্যাতন, মামলা দায়েরসহ ব্যাপক দমন-পীড়ন চালিয়েছে। ফলে অনেক বাংলাদেশী নাগরিক দেশের বাইরে চলে গিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন। বর্তমান অবস্থায় বিরোধীদল ও ভিন্নমতাবলম্বীদের সভা-সমাবেশ করার অধিকার নির্মমভাবে দমন করা হয়েছে। পুলিশের অনুমতি ছাড়া মিছিল সমাবেশ করার ওপর বহুদিন ধরেই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে সরকার। বিরোধী রাজনৈতিকদল (বিএনপি) ও সরকারের কাছে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলনকারী সংগঠনগুলোর মিছিল সমাবেশে পুলিশ এবং ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা হামলা করেছে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ব্যাপকভাবে বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের ওপর দমন-পীড়ন, চাঁদাবাজি, জমি দখল ও নারীর প্রতি সহিংসতাসহ বিভিন্ন ধরনের সহিংস কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়েছে। এ ছাড়া স্বার্থসংশ্লিষ্ট অন্তঃদলীয় কোন্দলের কারণে তাদেরকে বিভিন্ন মারণাস্ত্র ব্যবহার করে নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে লিপ্ত হতে দেখা যাচ্ছে।

অধিকার উল্লেখ করেছে, ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের সদস্যরা সীমান্তে বাংলাদেশের নাগরিকদের হত্যা ও নির্যাতন অব্যাহত রেখেছে এবং বাংলাদেশের ওপর ভারতের আধিপত্য বিস্তারের নানা তৎপরতা অব্যাহত আছে। ভারত সরকার বাংলাদেশ সরকারের সাথে তিস্তা চুক্তি সম্পাদন করেনি। বরং আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করে সীমান্তের জিরো লাইনে পাম্প বসিয়ে বাংলাদেশের সম্মতি ছাড়াই ফেনী নদী থেকে পানি নিয়ে যাচ্ছে। একদিকে ভারত বাংলাদেশের সীমান্তের বেশির ভাগ এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরাও করে রেখেছে। অন্য দিকে ভারতের আসাম রাজ্যের জাতীয় নাগরিকপঞ্জি থেকে বাদ পড়া ব্যক্তিদের বাংলাদেশে পুশইন করার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

http://www.dailynayadiganta.com/first-page/447756