পাগলা মিজানকে নিয়ে র‌্যাবের অভিযান। ছবি: যুগান্তর
১২ অক্টোবর ২০১৯, শনিবার, ২:২৩

মোহাম্মদপুরের ত্রাস ‘পাগলা মিজান’ গ্রেফতার

অস্ত্র, ৬ কোটি ৭৭ লাখ টাকার চেক ও ১ কোটি টাকার এফডিআর জব্দ * আয়ের উৎস না থাকলেও নিউইয়র্কে বাড়ি * শেখ হাসিনা হত্যাচেষ্টায় জড়িত থাকার অভিযোগ

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) ৩২নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও মোহাম্মদপুর থানা আওয়ামী লীগের আলোচিত নেতা হাবিবুর রহমান মিজান ওরফে পাগলা মিজানকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব।

শুক্রবার সকালে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল থেকে তাকে র‌্যাবের একটি বিশেষ টিম গ্রেফতার করে। এ সময় তার কাছ থেকে একটি পিস্তল, চার রাউন্ড গুলি ও একটি ম্যাগাজিন এবং নগদ দুই লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়। বিকালে মিজানকে নিয়ে ঢাকার লালমাটিয়ায় তার অফিস ও মোহাম্মদপুরের বাসায় অভিযান চালানো হয়।

অভিযান শেষে শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টায় র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম সাংবাদিকদের জানান, শ্রীমঙ্গলের গুহ রোডের হামিদা আবাসিক গেস্ট হাউসের সামনে থেকে পাগলা মিজানকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর তাকে নিয়ে লালমাটিয়ায় অফিস ও বাসায় অভিযান চালানো হয়। তবে তার অফিসে কিছু পাওয়া না গেলেও বাসা থেকে ৬ কোটি ৭৭ লাখ টাকার চেক, ১ কোটি টাকার এফডিআর জব্দ করা হয়। সারওয়ার আলম জানান, পাগলা মিজানের বিরুদ্ধে জেনেভা ক্যাম্পে মাদকের ব্যবসা এবং চাঁদাবাজির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। আমরা জানতে পেরেছি নিউইয়র্কের টেক্সাসে এবং আরও দুয়েকটি দেশে মিজানের বাড়ি রয়েছে। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার বলেন, তাকে নিয়ে আমরা আবার শ্রীমঙ্গলে যাব। অবৈধ অস্ত্র থাকায় সংশ্লিষ্ট থানায় তার বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা করা হবে। তিনি জানান, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতেই আমরা তাকে আটক করেছি। প্রধানমন্ত্রীকে হত্যাচেষ্টা মামলায় মিজান ও তার ভাই চার্জশিটভুক্ত আসামি। তিনি ও তার ভাই ফ্রিডম পার্টি করতেন।

সারওয়ার আলম জানান, মিজানের সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নেই। তার আয়ের উৎস আমরা পাইনি। সরকারি যে সম্মানী পান সেটাই তার আয়ের উৎস। এর বাইরে তার কোনো আয় নেই। জেনেভা ক্যাম্পে মাদক ব্যবসা এবং চাঁদাবাজির সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে র‌্যাব প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হয়েছে। বুধ ও বৃহস্পতিবার দুই দিনে প্রিমিয়ার ব্যাংক থেকে মিজান ৬৮ লাখ টাকা উত্তোলন করেছেন। এ টাকা নিয়ে তিনি কোথায় যাচ্ছিলেন তা জানতে চাওয়া হয়। দেশত্যাগ করতে মিজান শ্রীমঙ্গলে অবস্থান করছিলেন বলেও আমরা (র‌্যাব) নিশ্চিত হয়েছি।

র‌্যাব জানায়, মোহাম্মদপুর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মিজানের দৃশ্যমান কোনো ব্যবসা নেই। তার বিরুদ্ধে অবৈধ ক্যাসিনো পরিচালনা, হত্যা, মাদকের কারবার, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে।

স্থানীয় সূত্র জানায়, পাগলা মিজানের আসল নাম ছিল মিজানুর রহমান মিজান। ফ্রিডম পার্টির ধানমণ্ডি-মোহাম্মদপুর থানার কো-অর্ডিনেটর মিজান পরে নাম পাল্টে হয়ে যান হাবিবুর রহমান মিজান। ক্ষমতার পটপরিবর্তনের সুযোগে আওয়ামী লীগে ঢুকে পড়েন। তবে মোহাম্মদপুরের বাসিন্দারা তাকে ‘পাগলা মিজান’ নামেই চেনেন।

র‌্যাব-২ এর একটি সূত্র জানায়, ক্যাসিনো পরিচালনাসহ নানা অভিযোগের ভিত্তিতে সোমবার রাত ১টা থেকে দেড়টা পর্যন্ত মোহাম্মদপুরের আওরঙ্গজেব রোডে ৭/৩নং হোল্ডিংয়ের পান্থনীড় নামের বাড়িতে মিজানের বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে অভিযান চালানো হয়, কিন্তু সেখানে তাকে পাওয়া যায়নি। শ্রীমঙ্গল থেকে তাকে আটক করা হয়। এরপর ঢাকায় নিয়ে এসে শুক্রবার বেলা সাড়ে ৩টার দিকে র‌্যাব সদস্যরা তার লালমাটিয়ার অফিসে অভিযান চালান। সেখানে অবৈধ কিছু পাওয়া যায়নি। প্রায় এক ঘণ্টা অভিযানের পর ৪টা ৪০ মিনিটে র‌্যাব সদস্যরা মিজানকে নিয়ে আওরঙ্গজেব রোডের ৭/৩ নম্বর বাড়ির ৫ তলার বি-৪ ফ্ল্যাটে অভিযান চালান। সন্ধ্যা পৌনে ৭টা পর্যন্ত চলে এ অভিযান।

মিজানের অপরাধ সাম্রাজ্য : পাগলা মিজান মোহাম্মদপুরে অপরাধ সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন। মাদক কারবার থেকে শুরু করে খুন-খারাবি পর্যন্ত নানা অপরাধে তার নাম বারবার উঠে এসেছে। তার নামে ১৯৯৬ সালে মোহাম্মদপুর থানায় ইউনূস হত্যা এবং ২০১৬ সালে সাভারে জোড়া খুনের মামলা হয়। এছাড়া মোহাম্মদপুর বিহারি ক্যাম্প এলাকায় মাদক কারবারের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারীও তিনি। মাদক কারবারে নেপথ্য পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে অবৈধভাবে কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন মিজান।

বিহারি ক্যাম্পের একটি সূত্র জানায়, জেনেভা ক্যাম্পের মাছুয়া সাঈদ আর জব্বার খানের ছেলে মর্তুজা খান পাগলা মিজানের ডান ও বাম হাত। এছাড়া ইশতিয়াক, মুন্না, ছোয়া সেলিম, আরশাদসহ কয়েকজন মাদক ব্যবসায়ীকে দিয়ে মিজান ইয়াবার ব্যবসা পরিচালনা করেন। মাদক বিক্রির টাকার একটি বড় অংশ তারা পাগলা মিজানের হাতে পৌঁছে দিত। এছাড়া ক্যাম্পের সামনের সিটি কর্পোরেশন টোল মার্কেটের চাঁদার টাকাও তাদের মাধ্যমে মিজানের পকেটে পৌঁছে যেত। জমি জবরদখলের কারণে পাগলা মিজান বেশ কয়েকবার জেলও খেটেছেন। মিজানের সেকেন্ড ইন কমান্ড আদাবরের মাতুব্বর তুহিন ইয়াবার কারবার করে শূন্য থেকে কোটিপতি বনে গেছেন।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি সূত্র জানায়, মিজান বাহিনী এ পর্যন্ত কয়েকশ’ কোটি টাকার টেন্ডারবাজি করেছে। এছাড়া ভূমি দখল, চাঁদাবাজিসহ মোহাম্মদপুর বিহারি ক্যাম্পে মাদক ও চোরাই গ্যাস-বিদ্যুতের ব্যবসার নিয়ন্ত্রক পাগলা মিজান। স্থানীয়রা জানান, খুন-খারাবি পাগলা মিজানের বাঁ হাতের কাজ। এ কারণে এলাকায় কেউ ভয়ে তার বিরুদ্ধে কথা বলেন না।

২০১৪ সালে তুচ্ছ ঘটনায় মোহাম্মদপুরে ৬৫ বছরের বৃদ্ধ মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ আহমেদ পাইন ও তার অসুস্থ স্ত্রী মরিয়ম বেগমকে শত শত মানুষের সামনে জুতাপেটা করেন পাগলা মিজান। তখন কেউ ভয়ে কথা বলেননি। সরকারের উচ্চপর্যায়ের অনেক নেতা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু অসৎ কর্মকর্তা তার অপকর্মে সহযোগিতা করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। আর এ কারণেই অপরাধ করেও মিজান সব সময় পার পেয়ে যান।

বিহারি ক্যাম্পের বিদ্যুৎ লাইন থেকে ক্যাম্প-লাগোয়া কাঁচাবাজার ও মাছের বাজারের তিন শতাধিক দোকানে অবৈধ সংযোগ দিয়ে মিজান মাসে প্রায় পাঁচ লাখ টাকা আয় করেন। এ কারণে সম্প্রতি বিদ্যুৎ অফিসের সঙ্গে ক্যাম্পবাসীর ঝামেলা হয়।

শেখ হাসিনা হত্যাচেষ্টা মামলার আসামি পাগলা মিজান : ১৯৮৯ সালের ১০ আগস্ট মধ্যরাতে ফ্রিডম পার্টির সদস্য কাজল ও কবিরের নেতৃত্বে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর রোডে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে হামলা চালায় ১০-১২ জনের একটি দল। এ দলে ছিলেন তৎকালীন ফ্রিডম পার্টির নেতা পাগলা মিজানও। দলটি সেখানে বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় ও গুলি চালায়। এ সময় শেখ হাসিনা বাড়ির ভেতর অবস্থান করছিলেন। বাড়ির নিরাপত্তাকর্মীরা পাল্টা গুলি চালালে হামলাকারীরা কেটে পড়ে। এ ঘটনায় ধানমণ্ডি থানায় মামলা হয়।

১৯৯৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) মামলার অভিযোগপত্র দেয়। এতে লে. কর্নেল (অব.) সৈয়দ ফারুক, লে. কর্নেল (অব.) আবদুর রশিদ ও মেজর (অব.) বজলুল হুদা এবং নাজমুল মাকসুদ মুরাদসহ ১৬ জনকে আসামি করা হয়। এ অভিযোগপত্রে মিজানুর রহমান ওরফে পাগলা মিজানকে হামলার পরিকল্পনাকারীদের একজন হিসেবে উল্লেখ করা হয়। মিজানের ছোট ভাই মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফাও ছিলেন হামলাকারী দলের সদস্য। ১৯৯৫ সালে দুর্বৃত্তদের গুলিতে মোস্তফা নিহত হন।

স্থানীয় সূত্র জানায়, ১৯৭৬ সালে ফ্রিডম পার্টির পক্ষ থেকে মিজান, শামীম জালালী ওরফে দারোগার ছেলে শামীম, বাবুল ওরফে পিচ্চি বাবুলসহ কয়েকজন গেরিলা ট্রেনিং নিতে লিবিয়া যান। ধানমণ্ডিতে হামলার সময় মিজান ফ্রিডম পার্টির ধানমণ্ডি-মোহাম্মদপুর জোনের কো-অর্ডিনেটর ছিলেন।

যেভাবে আওয়ামী লীগে ভিড়েন : দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলে মিজানুর রহমান নিজের নাম পাল্টে হাবিবুর রহমান মিজান হয়ে যান। ফ্রিডম পার্টি ছেড়ে তিনি আওয়ামী লীগে ভেড়েন। এখন তিনি মোহাম্মদপুর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। এলাকায় তার খুব দাপট।

যেভাবে পাগলা মিজান নামকরণ : হাবিবুর রহমান মিজান নাম ছাপিয়ে লোকে তাকে ‘পাগলা মিজান’ হিসেবেই চেনেন। তার এ নামকরণের পেছনেও আছে রোমাঞ্চকর ঘটনা। স্বাধীনতার পর মিজান মোহাম্মদপুর এলাকায় শুরু করেন চাঁদাবাজি ও ছিনতাই। ১৯৭৪ সালের প্রথমদিকে ছিনতাইকারী হিসেবে এলাকায় তিনি পরিচিতি পান। স্থানীয় এক বাসিন্দা জানান, ১৯৭৫ সালের মাঝামাঝি খামারবাড়ি খেঁজুরবাগান এলাকায় ছিনতাই করার সময় মিজানকে ধাওয়া দেয় পুলিশ। লালমাটিয়া মসজিদের পাশে পৌঁছেই মিজান পুকুরে লাফ দেন। পুকুর থেকে তাকে উঠতে পুলিশ বারবার বললেও মিজান উঠতে নারাজ। এভাবে প্রায় চার ঘণ্টা কেটে যাওয়ার পর মিজান হঠাৎ পরনের সব কাপড় খুলে ফেলেন। বিবস্ত্র অবস্থায় উঠে যান পাড়ে। তার এমন আচরণে রীতিমতো হতভম্ব হন পুলিশ সদস্যরা। তাকে পাগলা মনে করে পুলিশ ছেড়ে দেয়। তখন থেকে এলাকার মানুষ তাকে পাগলা মিজান নামে ডাকতে শুরু করেন।

পাগলা মিজানের ফাঁসির দাবিতে মিছিল : বাসায় অভিযান চলাকালে অর্ধশতাধিক ব্যক্তি বিকাল ৫টা ২০ মিনিটে পাগলা মিজানের ফাঁসির দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। এ সময় বিক্ষোভকারীদের হাতে ব্যানার দেখা যায়। ব্যানারে লেখা ছিল- ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার আসামি ও সাবেক ফ্রিডম পার্টির নেতা, মাদক সম্রাট হাবিবুর রহমান পাগলা মিজানের ফাঁসি চাই।’ এ সময় ‘পাগলা মিজানের ফাঁসি চাই, ফাঁসি চাই’- এমন স্লোগানও দেন তারা।

যা বললেন কেয়ারটেকার : শুক্রবার দুপুরে মোহাম্মদপুরের আওরঙ্গজেব রোডে পাগলা মিজানের বাড়ির কেয়ারটেকার সোহরাব সাংবাদিকদের জানান, বাড়িতে মিজান তার স্ত্রী, ছেলে ও ছেলের বউকে নিয়ে থাকেন। সোমবার রাতে র‌্যাব বাসায় আসার আগেই মিজান বাড়ি ছেড়ে চলে যান। বৃহস্পতিবার পাগলা মিজানের ছেলে মামুন বাসা থেকে বের হয়ে আর ফেরেননি। শুক্রবার সকালে পাগলা মিজানের স্ত্রীও বাড়ি থেকে বের হয়ে গেছেন। বাসায় রয়েছেন মিজানের ছেলে মামুনের স্ত্রী।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/230920