১১ অক্টোবর ২০১৯, শুক্রবার, ১:৫৭

সর জমিন যা ঘটেছিল আবরারের গ্রামে

চাপা আতঙ্ক চারপাশে

রোববার রাতে বুয়েটের শেরে বাংলা হলে পিটিয়ে হত্যা করা হয় আবরার ফাহাদকে। রাতে বিষয়টি অবহিত হয়েও ঘটনাস্থলে যাননি বিশ্ববিদ্যালয় ভিসি ড. সাইফুল ইসলাম। পরের দিন ক্যাম্পাসে অনুষ্ঠিত আবরারের জানাজায়ও যাননি তিনি। এ নিয়ে চারপাশে সমালোচনা ওঠায় বুধবার আবরারের কুষ্টিয়ার গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন ভিসি। তার আগমনী বার্তা পৌঁছে যায় স্থানীয় প্রশাসনে। স্থানীয় যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদেরও বিষয়টি জানিয়ে দেয়া হয়। তাই ভিসি সেখানে পৌঁছার আগেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুল সংখ্যক সদস্য সেখানে উপস্থিত হন। দলীয় নেতাকর্মীদেরও ভিড় বাড়ে।

আবরারের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর রহস্যময় আড়ালে থাকা ভিসি সাইফুল ইসলামের রায়ডাঙ্গা গ্রামে যাওয়াকে ভালভাবে দেখেননি সেখানকার ক্ষুব্ধ বাসিন্দারা। তারা ভিসিকে আবরারের বাড়িতে যাওয়ার পথে প্রতিরোধ গড়ে তুলেন। ভিসির সামনে বাধা হয়ে দাঁড়ান স্থানীয় নারী, পুুরুষ, যুবকরা। প্রতিবাদী এসব মানুষকে নিবৃত্ত করতে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা এখন এলাকার মানুষের মুখে মুখে। বুধবারের এ ঘটনার পর এখন নতুন করে চাপা আতঙ্ক দেখা দিয়েছে এলাকায়। সেদিন যা ঘটেছিল তা নিয়ে কথা বলতে ভয় পাচ্ছেন অনেকে। ভিসির গাড়ি বহরে যারা বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন তারা এখন আর সামনে আসতে চান না। আতঙ্কের ছাপ দেখা গেছে আবরারের পরিবারের সদস্যদের মাঝেও।

হত্যাকাণ্ডের শিকার আবরার ফাহাদের ভাই ফায়াজের অভিযোগ, বুধবার তাকে এবং তার স্বজনদের মারধর করে পুলিশ। এমনকি আবরারের জানাজা দুই মিনিটের মধ্যে শেষ করার জন্য পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল বলেও দাবি করেন ফায়াজ। তার অভিযোগের সূত্র ধরে গতকাল কুষ্টিয়ার কুমালখালী উপজেলার কয়া ইউনিয়নের রায়ডাঙ্গা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, চাপা আতঙ্কের ছাপ। গ্রামবাসী প্রশ্ন তুলেছেন পুলিশের আচরণ নিয়ে। তারা বলছেন, পুলিশের কাজ সবাইকে নিরাপত্তা দেয়া। কিন্তু তারা উল্টো এসে এই পরিবারের সদস্যদের ওপর নির্যাতন করেছে।

স্থানীয়রা জানান, বুয়েট ভিসি অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম ফাহাদের গ্রামের বাড়িতে পৌঁছালে এসময় তার দাদা আবুল কাশেম বিশ্বাস ভিসিকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। পরে কবর জিয়ারত শেষে পরিবারকে সমবেদনা জানাতে ফাহাদের বাড়িতে যাওয়ার সময় গ্রামবাসীর প্রতিরোধের মুখে পড়েন তিনি। এলাকার বিক্ষুব্ধ শত শত নারী-পুরুষ ভিসিকে বাধা দেন। একসময় পুলিশের সঙ্গে গ্রামবাসীর ধস্তাধস্তি হয়। এতে আঘাত পান আবরারের ছোট ভাই ফায়াজ, তার ফুপাতো ভাইয়ের স্ত্রী তমা। এদিকে এলাকাবাসীর প্রতিরোধে ও বাধার মুখে পড়ে ভিসি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়া প্রহরায় রায়ডাঙ্গা গ্রাম ত্যাগ করেন। তবে ফাহাদের বাবা বরকতউল্লাহ এই প্রতিবেদক’কে বলেন, ভিসি স্যার চাইলে আমার বাসায় আসতে পারতেন। পুরো রাস্তা খালি ছিলো। ভিসি থাকতেই আমাদের উপজেলার চেয়ারম্যান আমাদের বাড়িতে এসেছেন। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বেশি তদারকি ছিলো। এ কারণেই মনে হয় তিনি আসেননি। পুলিশের এমনটা করা ঠিক হয়নি। আবরারের ছোট ভাই ফায়াজ বলেন, এখানকার দায়িত্বে থাকা এডিশনাল এসপি (অতিরিক্ত পুলিশ সুপার) মোস্তাফিজুর রহমান আমার বুকে কনুই দিয়ে আঘাত করেন এবং মঙ্গলবারও যখন আমার ভাইয়ের জানাজা হয় তখন তিনি বলেছিলেন দুই মিনিটের মধ্যে জানাজা শেষ করতে হবে। কিভাবে তিনি এটা বলেন? আমার ভাবিকে বেধড়ক পুলিশ দিয়ে মারা হয়েছে। এটা কোন ধরনের পুলিশ?

ফাহাদের বাবা বলেন, আমি নিজের কানে শুনেনি। পরে জানাজায় আসা অনেকের কাছেই এই কথা শুনেছি। পুলিশ নাকি বলেছে দুই মিনিটের মধ্যে জানাযা শেষ করতে হবে।

ফাহাদের মা রোকেয়া খাতুন বলেন, ভিসি এখানে আসাতে অনাকাঙ্খিত অনেক কিছু ঘটেছে। আমার ছোট ছেলে যখন ভিসির সাথে কথা বলতে যায়,তখন আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা তার গায়ে হাত তুলে। এই বেদনা আমি আর সইতে পারছি না।

বুধবারের ঘটনাটির প্রতক্ষদর্শী কলেজ শিক্ষার্থী একই গ্রামের শাহরিয়ার মাতুল বলেন, আমি এখানে ছিলাম। কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে বলতে শুনেছি এখানে সব ভিডিও হচ্ছে। যাদেরকে ভিডিওর মধ্যে দেখা যাবে তাদেরকে জামায়াত শিবির বলে চালিয়ে দিবো। এখনো সময় আছে সরে যান। কিভাবে একজন পুলিশ সদস্য এই কথা বলতে পারে। আমরা তা দেখে অবাক হয়েছি। এটা খুবই দুঃখজনক। প্রদক্ষদর্শী রিকশা চালক সালাউদ্দিন বলেন, আমাদের মধ্যে এই ছেলেটার জন্য একটা আফসোস তৈরি হয়েছে। শুধুমাত্র এই আফসোস থেকে ভিসির কাছে জানতে চেয়েছিলাম। এটা আমাদের অপরাধ? পুলিশ এটা কোনোদিনই করতে পারে না।

আরেকজন প্রতক্ষ্যদর্শী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন , ওই দিন যদি সাংবাদিকরা এখানে না থাকতো, তাহলে আমাদের ওপর গণহারে অত্যাচার চলতো। একটা মানুষকে মেরে ফেললো, তার ওপর আবার পুলিশ এসে গ্রামবাসীর উপর অত্যাচার শুরু করলো। এই দেশ থেকে কি বিচার ওঠে গেছে? এদিকে বুধবার সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন প্রতিবাদ সমাবেশ করতে এলে আইশৃঙ্খলা বাহিনীর সামনেই ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা প্রতিবাদ সামাবেশ করতে বাধা দেন বলে অভিযোগ উঠেছে। গতকাল কুষ্টিয়া জিলা স্কুলের সামনে ফাহাদের বন্ধুদের কর্মসূচি পালন করতে দেয়া হয়নি বলেও অভিযোগ উঠে। স্থানীয় ছাত্রলীগ তাদের কর্মসূচিতে বাধা দেয়। সেখানে পুলিশ থাকলেও কোন ব্যবস্থা নেয়নি।

কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার (এসপি) এস এম তানভীর আরাফাত এসব বিষয় অস্বীকার করে মানবজমিনকে বলেন, এই বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। এসব ঘটনা আমার সামনে ঘটেনি। আগে পরে কি হয়েছে আমি জানি না। আমাদের কাজ ছিলো জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, অতিরক্তি জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম), উপজেলা চেয়ারম্যানসহ ভিসি স্যারের নিরপত্তার জন্য ওই স্থানে যাওয়া। এরপরও এমন একটা অভিযোগ কেন উঠলো আমার সেটা বোধগোম্য নয়।

এলাকায় চাপা আতঙ্ক: আমার ছোট ছেলে আবরার ফায়েজের বিরুদ্ধে বিভিন্ন নামে বেনামে ফেসবুক আইডি খুলে মিথ্যা স্ট্যাটাস দিচ্ছে। তার আইডিতে নানাজন হুমকি ধমকি দিয়ে ম্যাসেজ পাঠাচ্ছে। বুধবার রাতে ফায়াজের বন্ধু ফোন দিয়ে আমাকে বলছে ফায়েজকে যেনো বাইরে না পাঠাই। তাকে অনেকে নজরদারি করছে, যেকোনো সময় ক্ষতি করতে পারে। বুধবার তাকে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরাও মারধর করলো। আমি এই নিরাপত্তা চাইবো কার কাছে’ বলছিলেন ছাত্রলীগের নির্যাতনে নিহত বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের মা রোকেয়া খাতুন। গতকাল কুষ্টিয়ার কুমালখালী উপজেলার কয়া ইউনিয়নের রায়ডাঙ্গায় ফাহাদের গ্রামে গেলে এই প্রতিবেদকে তিনি এই কথা বলেন। এদিকে আবরারের ভাই ফায়েজ বলেন, ঢাকায় যে রকম ভাইয়ের হত্যার প্রতিবাদের জন্য সমর্থন পাচ্ছি, কুষ্টিয়ায় অদৃশ্য কারণে কোনো ধরনের সমর্থন পাচ্ছি না এভাবে। কিভাবে আগাবো বুঝতে পারছি না। তাছাড়া আমার নামে যে কয়েকটি আইডিতে নানানজন স্ট্যাটাস দিচ্ছে এগুলো আবার বিভিন্ন অনলাইনে নিউজ করছে।

বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার হত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত আসামিদের গ্রেপ্তার করা হলেও এক ধরনের চাপা আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে তার পরিবারের সদস্যরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আবরার ফাহাদের এক স্বজন বলেন, বুধবার রাতে আবরারের বাবা বরকতউল্লাহকে কেউ একজন হুমকি দিয়ে বলেছে, এক ছেলেকে হারিয়েছন। আরেক ছেলেকে হারানোর চেষ্টা করবেন না। বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে বলেই ফোন রেখে দেন। তবে বরকতউল্লাহ এই নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি আঁতকে উঠেন। চোখেমুখে ছিলো আতঙ্কের ছাপ। যদিও বিষয়টি তিনি অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, এই ধরনের কোনো চাপ আমার ওপর নেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেহেতু বলেছে বিচার করে দিবেন। সেহেতু আমি নিশ্চিন্তে থাকতে পারি।

কুষ্টিয়া শহরের পিটিআই সড়কে পাশে স্থানীয় এমপির বাড়ির পেছনেই আবরারের বাড়িটি। সেখানেও গিয়েও কথা হয় কয়েকজনের সাথে। গতকাল ভোরে বাড়ির পাশের মসজিদে ফজর নাম পড়ে বেরোচ্ছিলেন কয়েকজন মুসল্লি। তাদের কাছে আবরারের পরিবার সর্ম্পকে জানতে চাইলে এক মুসল্লি বলেন, আবরারের পরিবারটি খুবই শান্তশিষ্ট। এখানে প্রায় সাত বছর ধরে আছেন তারা। আমরা যতটুকু জানি, খুবই ভদ্র পরিবার।

কুষ্টিয়া শহরের পাশের বাসায় থাকা আবরারের বাবার বন্ধু আলী আকবর বলেন, তাদের পরিবারটি খুবই নিরীহ পরিবার।

http://mzamin.com/article.php?mzamin=194091