১১ অক্টোবর ২০১৯, শুক্রবার, ১:০২

পদে পদে ভোগান্তি ব্যবসায়ীদের

সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ সর্বত্র ; রাজস্ব কড়াকড়িতে টিকে থাকাই দায় ; ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় দিশেহারা মানুষ

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, সীমাহীন বেকারত্ব, দেশী-বিদেশী বিনিয়োগে খরা, শেয়ারবাজারের দুরবস্থা, পরিবহন, বাসাভাড়া ও শিক্ষা-চিকিৎসার ব্যয়বৃদ্ধিসহ সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক দুরবস্থার কবলে পড়ে ভালো নেই দেশের ব্যবসায়ীরা। তার ওপর প্রতিটি বিভাগেই সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করছে কয়েকজন ব্যবসায়ীর একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। বাকিরা বছরের পর বছর অপেক্ষা করেও কোনো কাজ পাচ্ছেন না। বিরাট অঙ্কের রাজস্ব আদায়ে সৎ ব্যবসায়ীদের তাড়া করে বেড়াচ্ছে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ। ব্যাংকঋণে উচ্চ সুদের কারণে লোকসান গুনতে হচ্ছে সম্ভাবনাময় ব্যবসায়ও। বন্দরের অব্যবস্থাপনা, পদে পদে হয়রানি এবং ঘাটে ঘাটে চাঁদাবাজির শিকার হয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন সাধারণ ব্যবসায়ীরা। বাধ্য হয়ে ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছেন অনেকে। বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, সিটি করপোরেশন, এলজিইডি, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরসহ সরকারি বিভিন্ন অফিসে শত শত ব্যবসায়ী-সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান তালিকাভুক্ত থাকলেও কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। শক্তিশালী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পরিচিত কয়েকজনের মাধ্যেই বণ্টন হচ্ছে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের টেন্ডার। সুদিনের আশায় বছরের পর বছর কাগজপত্র হালনাগাদকরণ, অফিস ব্যবস্থাপনা এবং কর্মচারীর বেতন দিতে দিতে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ছে শত শত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। একসময়ের রমরমা ব্যবসায়ী এসব ঠিকাদারের এখন দিন কাটছে চরম দুর্দশায়। ব্যবসায়িক মন্দার চিত্র চোখে পড়ে মার্কেটগুলোয়। আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে ব্যর্থ হয়ে প্রতিনিয়তই ব্যবসা ছেড়ে দিচ্ছেন বিভিন্ন মার্কেটের প্রতিষ্ঠিত দোকানিরাও। হাতবদলের পর কিছু দিন লোকসান গুনে নতুন দোকানিও গুটিয়ে নিচ্ছেন নিজেকে। ফলে মার্কেট-মহল্লায় নতুন নতুন ব্যবসায়ীর সংখ্যাই বেশি চোখে পড়ছে।

সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছেন কম পুঁজির ব্যবসায়ীরা। তাদেরই একজন জীবনযুদ্ধে হিমশিম খাওয়া রাজধানীর খিলগাঁও তালতলা মার্কেটের ব্যবসায়ী সোলায়মান। ক্রোকারিজ মালামালের ব্যবসায় করেন তিনি। কথা প্রসঙ্গে জানালেন, কয়েক মাস থেকে ব্যবসায়ের অবস্থা খুবই খারাপ। বেচাবিক্রি নেই বললেই চলে। সামনে বাচ্চাদের পরীক্ষা। পরীক্ষার ফি, ভর্তি, বইপত্র কেনাসহ সম্ভাব্য খরচ কোত্থেকে জোগাড় করবেন সে বিষয়ে দুশ্চিন্তার কথা জানালেন তিনি। ব্যবসায় মন্দার ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, গত রোজার ঈদের আগে থেকে যা বিক্রি হয় তাতে দোকান খরচই আসে না। বাসাভাড়া, বাজার খরচ, চিকিৎসা ব্যয় এবং বাচ্চাদের পড়াশোনার খরচ চলছে দোকানের পুঁজি ভেঙে।

সোলায়মান জানান, তার একার নয়, মার্কেটের সবার ব্যবসায় মন্দাবস্থা চলছে। আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে ব্যর্থ হয়ে গত কয়েক বছরে অর্ধেকের বেশি দোকানদার ব্যবসায় ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। যাদের নিজস্ব দোকান তারা অন্যকে ভাড়া দিয়ে দিয়েছেন। মাস শেষে ভাড়া তুলে খাচ্ছেন। তাতেও ভালো, লোকসান কম হচ্ছে। তার কাছে প্রশ্ন ছিল, এসব দোকান নতুন করে ভাড়া নিচ্ছেন কারা? জবাবে সোলায়মান বলেন, মানুষের হাতে তো কাজ নেই। ধরুন একজন লোক বিদেশ থেকে ফেরত এসেছেন। হাতে কিছু টাকা আছে। ওই টাকা দিয়ে অনেক বড় আশা নিয়ে একটি দোকান ভাড়া নিয়ে ব্যবসায় শুরু করেছেন। কিছুদিন পর টের পেলেন, ব্যবসা-বাণিজ্য নেই। দিনদিন পুঁজি কমে যাচ্ছে। এভাবে একদিন পুঁজি হারিয়ে তিনিও দোকান বন্ধ করে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন।

ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সোলায়মানের কথার সূত্র ধরে অনুসন্ধান করতে গেলে বেরিয়ে আসে ব্যবসায়ীদের হাহাকার চিত্র। রাজধানীর মার্কেটগুলোয় কয়েক লাখ খুচরা দোকান থাকলেও লাভে আছে খুব সামান্যই। অধিকাংশ মার্কেটেই বেচাকেনা নেই বললেই চলে। বিশেষ করে পোশাকের দোকানগুলো রোজার মাস ছাড়া বাকি ১১ মাসই লোকসানে থাকে। মালিকরা এ সময় দোকান ভাড়া, কর্মচারীর বেতন এবং বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতেই হিমশিম খান। পাড়া-মহল্লার চাল-ডালসহ নিত্যপণ্যের দোকানগুলো সারা বছর চললেও তৈজসপত্র, প্রসাধনী এবং পারিবারিক ব্যবহার্য পণ্যসামগ্রীর দোকানিরা রয়েছেন সবচেয়ে বেশি চাপে।

আলাপ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো: হেলাল উদ্দিন নয়া দিগন্তকে বলেন, সাধারণ মানুষের হাতে টাকা নেই। টাকা চলে গেছে অল্প কিছু মানুষের হাতে। তারা কেনাকাটা করেন বিলাসবহুল মার্কেটে কিংবা বিদেশে। ফলে সাধারণ মানের মার্কেটগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ। অন্য দিকে ঢাকার মার্কেটগুলোয় দোকানভাড়া অনেক বেশি। বিদ্যুৎ বিল বাড়তে বাড়তে আকাশ ছুঁয়েছে। সার্ভিস চার্জসহ অন্যান্য খরচও বাড়তি। এসব কারণে অধিকাংশ দোকানদার লোকসান দিয়ে পেশা টিকিয়ে রেখেছেন। অন্য কিছু করার সুযোগ নেই বলে দোকানদারি করছেন। কর্মসংস্থান না থাকায় প্রতিনিয়ত নতুন নতুন লোক ব্যবসায় আসছেন এবং লোকসান দিয়ে ব্যবসায় গুটিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। পরিস্থিতি মোকাবেলায় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক সংস্কারের ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, ব্যবসায়িক মন্দার অন্যতম প্রধান কারণ জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়া। একজন সবজি বিক্রেতা ভালো আয়-রোজগার করলেও অপরাপর সব খরচ বেড়ে যাওয়ায় বাড়তি আয়েও তার পক্ষে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। এক দিকে দোকান ভাড়া বৃদ্ধি, বাসাভাড়া বৃদ্ধি, কর্মচারীর বেতন বৃদ্ধি, অন্য দিকে বেচাকেনা কমে যাওয়ায় আগের মতো লাভ করতে পারছেন না বলে জানান। এদের অনেকের আয় বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু ব্যয় তুলনামূলকভাবে অধিক বৃদ্ধি পাওয়ায় বাড়তি আয়েও সংসার চলছে না বলে জানান বেশ কয়েকজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। টিকে থাকার জন্য বাধ্য হয়ে অনেকে বড় ব্যবসা ছেড়ে ছোট ব্যবসায় যাচ্ছেন। অনেকে আবার পরিবারের সদস্যদের গ্রামে পাঠিয়ে দিয়ে নিজেরা মেসে উঠছেন।

ব্যবসায়ীদের দুর্দশার চিত্র উঠে এসেছে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতা প্রতিবেদনেও। সদ্য প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, ১৪১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৫তম। আগেরবার অবস্থান ছিল ১০৩। প্রতিবেদন তৈরিতে ১২টি সূচক ব্যবহার করা হয়েছে। এসব সূচকের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০টিতেই পিছিয়েছে। মাত্র দুটিতে এগিয়েছে। যেসব সূচকে বাংলাদেশ পিছিয়েছে, সেগুলো হলো সামষ্টিক অর্থনীতি, শ্রমবাজার, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার, অবকাঠামো, দক্ষতা, প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ, আর্থিক ব্যবস্থাপনা, ব্যবসায় বৈচিত্র্য, উদ্ভাবন এবং বাজারের আকার। প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়ার কারণ হিসেবে অবকাঠামো সমস্যা, দক্ষ মানবসম্পদ গঠনের বিষয় এবং সুশাসনের অভাবের কথা জানান বিশ্লেষকেরা।

অর্থনৈতিক দুরবস্থার চিত্র ফুটে ওঠে বিনিয়োগচিত্র থেকেও। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) তথ্যানুযায়ী, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বিদেশী বিনিয়োগের পরিমাণ যেখানে ছিল এক হাজার ৩১ কোটি ডলার, সেখানে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে কমে হয়েছে মাত্র ৫২৫ কোটি ডলার। অর্থাৎ এক বছরে বিদেশী বিনিয়োগ অর্ধেকে নেমে এসেছে। অথচ সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণের ক্ষেত্রে ওই অর্থবছরে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষস্থানে ছিল। একই অবস্থা বিরাজ করছে দেশী বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও। বিডা জানায়, বিগত অর্থবছরে পূর্ববর্তী অর্থবছরের তুলনায় অনেক কম বিনিয়োগ প্রস্তাব নিবন্ধন করা হয়েছে। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এমন নিম্নমুখিতার কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বিশিষ্টজনেরা বলছেন, আগে রাজনৈতিক সঙ্ঘাত ও অনিশ্চয়তাকে বিনিয়োগ কমে যাওয়ার জন্য দায়ী করা হতো। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গ্যাস ও বিদ্যুতের সংযোগ না পাওয়া এবং অবকাঠামোগত দুর্বলতাকে প্রধান কারণ হিসেবে দেখা যাচ্ছে। পাশাপাশি রয়েছে জমি কেনা ও রেজিস্ট্রেশন করাসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং দীর্ঘসূত্রতা। মাঝখানে বহুদিন পর্যন্ত শিল্প-কারখানায় গ্যাস ও বিদ্যুতের সংযোগ দেয়া হয়নি। এখনও সব শিল্প উদ্যোক্তাকে তাদের চাহিদা অনুযায়ী যথাসময়ে গ্যাস ও বিদ্যুতের সংযোগ দেয়া হচ্ছে না। ফলে দেশীয় উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছেন। তারা চলে যাচ্ছেন ভারত ও মালয়েশিয়াসহ অন্য দেশগুলোতে। একই কারণে এগিয়ে আসছেন না বিদেশী উদ্যোক্তারাও। কারণ, দেশের ভেতরে বিনিয়োগ বাড়লে এবং উৎপাদনসহ বাধাহীন কার্যক্রম পরিচালনার ব্যাপারে নিশ্চয়তা পেলেই সাধারণত বিনিয়োগের জন্য বিদেশীরা এগিয়ে আসেন।

এ দিকে দেশের ব্যবসায়িক দুরবস্থার জন্য ব্যাংকঋণের উচ্চ সুদহার এবং মাত্রাতিরিক্ত খেলাপি ঋণের কথা বলেন বিশেষজ্ঞরা। বিশাল অঙ্কের খেলাপি ঋণ অর্থনীতিকে দিন দিন নিচের দিকে নিয়ে যাচ্ছে বলে তাদের দাবি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ছয় মাসেই ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৮ হাজার ৫১৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে তিন মাসে বেড়েছে ১ হাজার ৫৫২ কোটি টাকা। ফলে জুন শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ১২ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা মোট ঋণের ১১ দশমিক ৬৯ শতাংশ। এর সাথে অবলোপন করা ঋণ যোগ করলে খেলাপি ঋণ দেড় লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সবচেয়ে খেলাপি ঋণ বেড়েছে রাষ্ট্রমালিকানাধীন জনতা ব্যাংকের। এক বছরে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ১১ হাজার ১১৫ কোটি টাকা বেড়ে হয়েছে ২০ হাজার ৯৯৪ কোটি টাকা। অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ গত অর্থবছরে বেড়েছে ৫৯১ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে ফারমার্স ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২ হাজার ৯০ কোটি টাকা। বেসরকারি খাতের এবি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ এক বছরে বেড়েছে ৫ হাজার ২৩৯ কোটি টাকা।

http://www.dailynayadiganta.com/first-page/447148