১০ অক্টোবর ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ১২:১৯

উচ্চসুদ ও দুর্নীতিতে বাড়ছে ব্যবসার ব্যয়

প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় আরও দুই ধাপ পিছিয়েছে বাংলাদেশ * আর্থিক খাতে বিশৃঙ্খলা ও টাকা পাচার বাড়ছে * অনিরাপদ বোধ করছেন ব্যবসায়ীরা * গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আরও কমেছে

দুর্নীতি, ঋণের উচ্চসুদ, মূল্যস্ফীতি, আয়কর এবং বিভিন্ন বিলের কারণে ব্যবসার ব্যয় বাড়ছে। শুধু তাই নয়, দেশের আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা নেই। বাড়ছে টাকা পাচার। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। ফলে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার ক্ষেত্রে ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা।

এর প্রতিফলন হয়েছে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের করা প্রতিযোগিতার সক্ষমতার বৈশ্বিক সূচকে। এ সূচকে ২০১৯ সালে ১৪১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৫। আগের বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালে যা ছিল ১০৩। এর আগে ২০১৭ সালে যা ছিল ১০২। অর্থাৎ সূচকে ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশের পতন হচ্ছে।

ব্যবসায়ীদের মতামতের ভিত্তিতে বুধবার বিশ্বব্যাপী একযোগে এ রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়। রাজধানীর ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) মিলনায়তনে ফোরামের পক্ষে বাংলাদেশে রিপোর্ট প্রকাশ করে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।

আবার এই রিপোর্টের বাইরে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ব্যবসায়ীদের মতামত নিয়ে আরেকটি মূল্যায়ন রিপোর্ট তৈরি করেছে সিপিডি। ওই রিপোর্টে বলা হয়, চতুর্থমুখী চাপে রয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। দেশের ব্যবসায়ীরা অনিরাপদ বোধ করছেন। মূল প্রতিবেদন তুলে ধরেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। উপস্থিত ছিলেন সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন, রিসার্স ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান।

বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের প্রতিবেদনটি ১২টি মানদণ্ডের ভিত্তিতে করা হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৯টিতেই পিছিয়েছে। মাত্র দুটিতে এগিয়েছে। যেসব মানদণ্ডে বাংলাদেশ পিছিয়েছে সেগুলো হল- সামষ্টিক অর্থনীতি, শ্রমবাজার, তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার, অবকাঠামো, দক্ষতা, প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ, আর্থিক ব্যবস্থাপনা, ব্যবসায় বৈচিত্র্য এবং উদ্ভাবন। অন্যদিকে এগিয়েছে পণ্যবাজার ও স্বাস্থ্যসূচকে। স্থিতিশীল রয়েছে বাজারের আয়তনের দিক থেকে।

প্রতিযোগিতার সক্ষমতার বৈশ্বিক সূচকে প্রথম অবস্থানে রয়েছে সিঙ্গাপুর। যুক্তরাষ্ট্র প্রথম থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে নেমে এসেছে। তৃতীয় হংকং, চতুর্থ নেদারল্যান্ডস, পঞ্চম সুইজারল্যান্ড, ষষ্ঠ জাপান, সপ্তম জার্মানি, অষ্টম সুইডেন, নবম যুক্তরাজ্য এবং দশম অবস্থানে রয়েছে ডেনমার্ক। আর এবারও সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে আফ্রিকার দেশ চাদ। তালিকায় এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে এগিয়ে রয়েছে তাইওয়ান।

এ বছর দেশটি ১২তম। মালয়েশিয়ার অবস্থান ২৭। এরপর চীন ২৮, থাইল্যান্ড ৪০, ইন্দোনেশিয়া ৫০, ফিলিপাইন ৬৪। ১০ ধাপ বেড়ে ভারতের অবস্থান ৬৮, ভিয়েতনাম ৬৭, শ্রীলংকা ৮৪, পাকিস্তান ৩ ধাপ বেড়ে ১১০, নেপাল ১০৮ এবং কম্বোডিয়া ১০৬তম অবস্থানে রয়েছে। ১২টি মানদণ্ডের ভিত্তিতে ১০০-ভিত্তিক সূচকে সব মিলিয়ে এবার বাংলাদেশের স্কোর ৫২ দশমিক ১।

এর মধ্যে পণ্যবাজার সূচকে ১১৯, ব্যবসা গতিশীলতায় ১২০, স্কিল ডেভেলপমেন্টে ১১৭, শ্রমবাজারে ১২১, অবকাঠামোয় ১১৪, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতায় ১০৯, আর্থিক খাতে ১০৬, উদ্ভাবনী দক্ষতায় ১২১, তথ্য-প্রযুক্তি অংশ ১০৮, স্বাস্থ্য খাতে ৯৩ এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় ৯৫তম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।

তবে বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে বাজারের সূচকে, ৩৬তম। এর মানে হল দেশে অভ্যন্তরীণ বড় একটি বাজার রয়েছে। তবে প্রাথমিক শিক্ষায় কিছুটা উন্নতি হলেও মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষায় পিছিয়েছে। রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, শেয়ারবাজারের কিছুটা উন্নতি হয়েছে। প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে।

বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের প্রতিবেদনটি ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়কালের তথ্যের ওপর সদস্য দেশগুলোর মোট ১২ হাজার ৯৩৬ শীর্ষ উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীর মতামতের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে। তবে ব্যবসায়ীরা ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত সময়ের মধ্যে মতামত দিয়েছেন।

বাংলাদেশের মোট ৭৭ জন ব্যবসায়ীর মতামত নেয়া হয়েছে। এসব ব্যবসায়ীর মালিকানাধীন প্রতিটি কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন ১০ কোটি টাকার উপরে। তিনটি সূচকের ওপর প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে- মৌলিক সূচক, দক্ষতা ও উদ্ভাবন ক্ষমতা। এ ছাড়া আরও ১২টি উপ-খাতের সূচক বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম ২০০১ সাল থেকে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে।

জরিপে মতামত দেয়া ৭৭ জন ব্যবসায়ীর মধ্যে অধিকাংশই মনে করেন, দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রধান সমস্যা দুর্নীতি ও সুশাসনের অভাব। তাই দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের একটি সুস্পষ্ট রাজনৈতিক অঙ্গীকার থাকা উচিত। বাংলাদেশের দ্বিতীয় সমস্যা অবকাঠামো। ব্যবসায়ীরা মনে করেন, বিচ্ছিন্নভাবে কিছু অবকাঠামো করছে সরকার। কিন্তু ব্যবসা করার জন্য একটি ফুল প্যাকেজ দরকার।

এর মধ্যে রয়েছে- জমি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, শ্রমিক, স্বল্পসুদে ঋণ এবং বন্দরের সুবিধা। কিন্তু এগুলো এখনও নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি, যা বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এ ছাড়া অবকাঠামো খাতে যে পরিমাণ বিনিয়োগ হচ্ছে, তার পুরো সুবিধা পাচ্ছে না ব্যবসায়ীরা।

সরকারের প্রশাসন যন্ত্রকে আরও শক্তিশালী করার প্রয়োজন রয়েছে বলে মত তাদের। প্রতিবেদনে বলা হয়, অধিকাংশ ব্যবসায়ী মনে করছেন, দেশে গণমাধ্যম তথা সংবাদপত্রের স্বাধীনতা আরও কমেছে। এর আগে বাংলাদেশের জন্য এই সূচকটি ইতিবাচকভাবে দেখা হতো। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে বলে মনে করছে সিপিডি। ব্যবসায়ীদের মতে, জনসেবা পাওয়ার ক্ষেত্রেও দুর্নীতি রয়েছে। ফলে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে একটি বড় পরিবর্তন দরকার।

সমস্যার ক্ষেত্রে পর্যায়ক্রমে রয়েছে- আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, পুঁজির সহজলভ্যতার অভাব, ঘুষ ছাড়া সহজে ঋণ না পাওয়া। সংস্থাটির বিবেচনায় অন্য সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে- নীতিনির্ধারণে অস্থিতিশীলতা, প্রশিক্ষিত জনশক্তির অভাব, উচ্চ করহার, করের বিভিন্ন আইনে জটিলতা, উদ্ভাবনী ক্ষমতার অভাব এবং বিভিন্ন আইনের সীমাবদ্ধতা। সব মিলিয়ে সামগ্রিকভাবে ব্যবসার ব্যয় বেড়েছে।

এ ছাড়া অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিদেশি ক্রেতারা বাজার নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। ফলে আগে যেভাবে মুনাফা হতো, বতর্মানে ওই হারে মুনাফা করা যায় না। এসব কারণে ব্যবসায় ব্যয় কমাতে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি স্বচ্ছতা বাড়াতে ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং অ্যাক্টসহ অন্য আইনগুলো কার্যকর করতে হবে। ট্যাক্সের সুবিধাগুলো যাতে ব্যবসায়ীদের কাছে আরও সহজে পৌঁছানো যায়, সে জন্য প্রযুক্তির মাধ্যমে সিস্টেমের উন্নয়ন করতে হবে।

প্রতিবেদন উপস্থাপনের সময় খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বেশকিছু সূচকের ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। সরকারের দীর্ঘমেয়াদি ভিশনকেও ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন ব্যবসায়ীরা। তিনি বলেন, জরিপে অংশ নেয়া ৭৮ ভাগ ব্যবসায়ী মনে করেন, দেশের আর্থিক খাতের অবস্থা খারাপ হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকের পাশাপাশি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক খাতেও রয়েছে সমস্যা। এ খাতের সুশাসন ভেঙে পড়েছে।

এ খাতে শৃঙ্খলা ফেরানো দরকার। বিষয়টি মূল্যায়নের জন্য দীর্ঘদিন থেকে সিপিডির পক্ষ থেকে একটি সংস্কার কমিশন গঠনের কথা বলা হচ্ছে। অর্থমন্ত্রী কমিশন গঠনের কথাও বলেছিলেন। দ্রুত কমিশন গঠন করে এ খাতের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।

খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ৮০ শতাংশ ব্যবসায়ী মনে করেন, এ বছর টাকা পাচার আরও বেড়েছে। ৩৬ শতাংশ ব্যবসায়ী মনে করেন, আগামী অর্থবছর থেকে নতুন ভ্যাট কার্যকর হলেও সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন কঠিন। জ্বালানির দামও ব্যবসায়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

অন্যদিকে আরেকটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ- এর আগে দেশের অন্যতম একটি ইতিবাচক দিক ছিল শ্রমশক্তি। কিন্তু আগামীতে সেই শ্রমশক্তি দেশের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে। এ ছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্য নির্দিষ্ট কিছু গোষ্ঠীর হাতে চলে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে খাতভিত্তিক বড় গ্রুপ তৈরি হচ্ছে। যা সাধারণ ব্যবসায়ীদের জন্য অত্যন্ত চ্যালেঞ্জের।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/230208