৯ অক্টোবর ২০১৯, বুধবার, ৩:৩২

বিশ্ব তার চৌদ্দতম বাঁকে

সব আলোচনা এবং অনুসন্ধানের শেষে সামনে আসে যে শব্দটি তা হলো যুদ্ধ। আর সে যুদ্ধ বহুমাত্রিক, যদিও যুদ্ধ বলতে প্রধানত মৃত্যু, হত্যা, সঙ্ঘাতের ছবিই ভেসে ওঠে। তবে এটা সত্য, সব যুদ্ধ একটা উদ্দেশ্য নিয়ে এগিয়ে যায়, তা হলো জয়লাভ করা। কেউই পরাজিত হতে চায় না।

এরই ধারাবাহিকতায় সৃষ্টি হয় নানা বাঁক। যুদ্ধের শেষে জয়ী অংশ এক নতুন বাঁকের পথে চলতে থাকে। এই বাঁকে পৌঁছতে ধ্বংসের যে ইতিহাস পাওয়া যায় তাতে প্রায়ই গণহত্যা এবং জাতি নিধনেরই ছবি থাকে। কারণ এই বাঁকে পৌঁছতে নানা শক্তি এবং স্বার্থ একযোগে বিপরীতমুখী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। তাই চলতে থাকে যুদ্ধ এবং সঙ্ঘাত।

পশ্চিমা অনুসন্ধানীরা আধুনিক সময়কে তেরোটি ভাগ করে, বর্তমান সময়কে চৌদ্দতম বাঁক বলেছেন। এই ভাগাভাগি সঠিক বা বেঠিক, সেটি গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবে চলমান সময়ের মধ্যে কোনো সঙ্ঘাত বা সংঘর্ষ ঘটে তাতে হয়তো একটি নতুন জাতির সৃষ্টি হয় বা দেশের সীমানা নির্ধারিত হয়। সেই একই পথে আবার নতুন সঙ্ঘাতেরও সৃষ্টি হয়। তাই যদিও বলা হয় ইতিহাসের কখনো পুনরাবৃত্তি হয় না, তবে একই ঘটনা অন্য আঙ্গিকে এবং চেহারায় ঘটে।

এবার ঘটে যাওয়া অনুসন্ধানীদের বর্ণিত তেরোটি বাঁকের ইতিহাস সংক্ষেপে আলোচনা করা যায়।

তারা প্রথম বাঁকে ক্রুসেডকে স্থান দিয়েছে। এই বক্তব্যে পশ্চিমাদের মানসিক একটি চিত্র ও ফুটে ওঠে। তা হলো, খ্রিষ্টান জগতের পরমত গ্রহণ বা অবস্থানের প্রতি অসহিষ্ণুতা। যেমন মধ্যযুগে রোমান ক্যাথলিক চার্চের নেতৃত্বে ১০৯৫ এবং ১২৯১ মধ্যে বহুবার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দিকে অভিযান চালানো হয়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে তখন ইসলাম দ্রুত প্রসার লাভ করছিল। কারণ ইসলামের সাম্য এবং মানবতার বাণী সবাইকে আকৃষ্ট করে। খ্রিষ্টান জগতে এই অবস্থা ছিল অগ্রহণীয়। ফলে শুরু হয় সঙ্ঘাত। তবে দুর্বল মুসলমানদের বিশাল খ্রিষ্টান বাহিনী পুরোপুরি নির্মূল করতে অক্ষম হয়। ঐতিহাসিকদের মতে, এই যুদ্ধগুলোতে প্রায় ত্রিশ লাখ লোকের মৃত্যু ঘটে।

দ্বিতীয় বাঁককে ফরাসি বিপ্লব বলে বর্ণিত হয়। এ বিপ্লবের শুরু হয় ১৭৮৯ সালে। তখন ধর্মীয় আবরণে রাজা এক মহা শোষণের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন। এই শোষণের বিরুদ্ধে জনগণ সংগঠিত হতে থাকে এবং একপর্যায়ে রক্তের মধ্য দিয়ে রাজার পতন ঘটায়। বিশ্বের ইতিহাসের এই দ্বিতীয় বাঁক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই পথ ধরে বিশ্বের মানুষেরা একের পর এক গণ-অভ্যুত্থান ঘটাতে থাকে এবং জনগণের শাসন প্রবর্তিত হতে থাকে।

তৃতীয় বাঁক হলো, মেক্সিকো আমেরিকান যুদ্ধ। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ফ্রান্স, স্পেন এবং আমেরিকা একযোগে টেক্সাসের মালিকানা দাবি করে। এখানে হাজার হাজার অভিবাসী আগমন করে। ১৮৩৫ সালে তারা মেক্সিকো বলে একটি রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তবে সঙ্ঘাত চলতে থাকে এবং ১৮৪৬-এ মেক্সিকো আমেরিকার অংশ হয়ে যায়। এটা এখন এরিজোনা ইত্যাদি ইত্যাদি এলাকা নিয়ে গঠিত।
চতুর্থ বাঁক হলো প্রথম মহাযুদ্ধ। প্রথম মহাযুদ্ধ শুরু হয় অত্যন্ত ছোট্ট ঘটনা থেকে। এ যুদ্ধকে ট্রেঞ্চের যুদ্ধ বলা হয়ে থাকে। আসলে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মধ্যে যে সঙ্ঘাত-সংঘর্ষ চলত তার ওপর চাপ পড়ে এবং একপর্যায়ে যখন পশ্চিম এশিয়া দখল করার প্রশ্নটি প্রাধান্য লাভ করে তখন যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধে তিন কোটি মানুষের মৃত্যু ঘটে। এ যুদ্ধ এত ভয়াবহ এবং নোংরা ছিল, যা অতীতে কখনো ঘটেনি।

পঞ্চম বাঁক হলো দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ। প্রথম মহাযুদ্ধের পর লিগ অব নেশন জন্ম নেয় এবং জার্মানির ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করা হয়। এতে জার্মানরা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয় আর এ সময় হিটলার ক্ষমতায় এসেই ১৯৩৯ সালে পোল্যান্ড আক্রমণ করে। এ দিকে জাপানও পূর্ব দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। আবার ইটালির মুসোলিনি হিটলারের সাথে হাত মিলায় এবং যা হওয়ার তাই হলো, আবার যুদ্ধ শুরু হলো এবং ফলে সাত কোটি মানুষ প্রাণ দিলো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সারাবিশ্বের রাজনীতিকে পরিবর্তন করে। বলা হয় জার্মান ক্যাম্পে হিটলার এক কোটি দশ লাখ লোককে ক্ষুধা এবং অত্যাচারে হত্যা করে। এর ফলেই এর যুদ্ধ।

লিগ অব নেশন যে উদ্দেশ্য নিয়ে স্থাপিত হয়েছিল তা ব্যর্থ হয়। তাই যুদ্ধ চলাকালীন সময়ই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাংকলিন ডি রুজভেল্ট বিদেশী রাষ্ট্রপ্রধানদের একত্র করেন এবং অক্টোবর ১৯৪৫ জন্ম নেয় আজকের জাতিসঙ্ঘ। লিগ অব নেশনের দুর্বলতাকে মুক্ত করে অগ্রযাত্রায় শামিল হয়। এখন জাতিসঙ্ঘের সদস্য সব দেশ।

ষষ্ঠ বাঁক হলো মার্কিন এবং ব্রিটিশদের তৈরি ইসরাইলের উদ্ভব। ব্রিটিশের ১৯১৭ বালফোর ঘোষণার মধ্য দিয়ে প্যালেস্টাইনের বুকে জন্ম নিলো ইসরাইল। এক সাথে তাদের সহায়তায় ইসরাইল প্যালেস্টাইনে চালিয়ে যাচ্ছে হত্যাযজ্ঞ। আজ ইসরাইল সারা বিশ্বের শান্তির প্রতি এক বিরাট হুমকি।

অনুসন্ধানীরা বিশ্বের সপ্তম বাঁককে বিশ্বযুদ্ধের পরের ‘ঠাণ্ডা যুদ্ধ’ (কোল্ড ওয়ার বলছেন)। সম্মুখ যুদ্ধ না হলেও ঠাণ্ডা যুদ্ধের মধ্যে সারা বিশ্বে চলছে সঙ্ঘাত এবং সংঘর্ষ যার ফলে বিশ্বের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে চলছে নানা আলোড়ন। এখন দুটো মত একে অন্যের মুখোমুখি। এক দিকে কমিউনিজমের (সাম্যবাদ) ছত্রছায়ায় রাশিয়া এবং সাম্যবাদী দেশগুলো। অপর দিকে, পুঁজিবাদের ছত্রছায়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অবশিষ্ট দেশগুলো। এই ঠাণ্ডাযুদ্ধ ১৯৪৭ থেকে ১৯৯১তক চলে। এ যুদ্ধগুলোতে আফগানিস্তান, কোরিয়া, ভিয়েতনামে চলতে থাকে স্থানীয় যুদ্ধ এবং এ সময় আত্মপ্রকাশ করে আণবিক অস্ত্র।

অষ্টম বাঁক তারা নির্ধারণ করেছেন কোরিয়া যুদ্ধকে ঘিরে। জাপান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত কোরিয়া দখল করেছিল। এরপর গণবিদ্রোহের পরে উত্তর এবং দক্ষিণ কোরিয়ায় তারা বিভক্ত হয়। উত্তর কোরিয়া রাশিয়া দখল করে এবং দক্ষিণ কোরিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করত। ১৯৫০ দুই কোরিয়ায় যুদ্ধ হয় এবং ১৯৫৩ শেষ হয়। তবে ঠাণ্ডা যুদ্ধ আজো চলছে।

নবম বাঁক হলো ভিয়েতনাম যুদ্ধ। ভিয়েতনাম এবং তার পাশের লাওস, ক্যাম্বোডিয়া ছিল ফরাসিদের দখলে। ৫০ বছরের এই অধিকারের ফলে যে সংঘর্ষ এবং সংগ্রাম চলে তাতে বড় শক্তিগুলো জড়িয়ে পড়ে। বিশ বছরের যুদ্ধে অন্তত সাড়ে তিন লাখ মার্কিনীও নিহত হয়। আর সাধারণ মানুষের মৃত্যের সংখ্যা শুধু অনুমান সাপেক্ষ।

দশম বাঁক হলো, সোভিয়েত এবং আফগান যুদ্ধ। আফগান যুদ্ধ শুরু হয় ১৯৭০ যখন ৪০ বছরের রাজার শাসনের অবসান ঘটে। রাশিয়া তখন আফগানিস্তান প্রবেশের চেষ্টা করে এক অংশের আমন্ত্রণে। গেরিলা আক্রমণে তারাও পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে।

এরপর হয় ইরাক এবং ইরান যুদ্ধ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরাককে সাহায্য করে। এ যুদ্ধে হত্যার ছবি ভয়াবহ। পৃথিবীর ইতিহাসে এত নৃশংসতা দেখা যায়নি। যুদ্ধ বিস্তৃÍত লাভ করে যখন ইরাক কুয়েত আক্রমণ করে। কুয়েতের ইরাকের কাছে ১৪ বিলিয়ন ডলার পাওনা ছিল। ইরাক যুক্তরাষ্ট্রের কাছে পরাজিত হয়।

সে বছর সেপ্টেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরাক আক্রমণ করে। ১/১১ ঘটনার পর এ আক্রমণ ঘটে। ১৯৬৬ সালে শুরু হওয়া এ যুদ্ধ ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বদীর্ঘ যুদ্ধ। এর ফলে আফগানিস্তানের সব কাঠামো ভেঙে পড়ে। যুদ্ধ শুরু হয়েছিল গণতন্ত্র এবং জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার নামে, যা আজো সুদূর পরাহত।

তারা বিশ্বের ত্রয়োদশ বাঁক ইরাক যুদ্ধকে অভিহিত করেছে। এ যুদ্ধের শেষে ইরাকের জনগণ নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম মৃত্যু বরণ করে। ইরাকের কাছে আণবিক অস্ত্র থাকার মিথ্যা প্রচারণা দিয়ে এ আক্রমণ শুরু হয়। ইরাক দখল করলেও মার্কিন শক্তি নানা বাধার সম্মুখীন হয়। গেরিলা কর্মকাণ্ডের ফলে ১৭ হাজার ইরাকি সৈন্য নিহত হয় এবং দুই ট্রিলিয়ন ডলার সম্পদ বিনষ্ট হয়। এর ফলে শান্ত আসেনি। ঠাণ্ডা যুদ্ধ তার লেবাস পাল্টিয়েছে।

এই একবিংশ শতাব্দীতে জটিল জীবন আরো সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। এর মধ্যে আবহাওয়া পরিবর্তন, দারিদ্র্যের বিস্তার লাভ, বিশ্ব জনসংখ্যাও ক্রমবর্ধমান, জীবনকে সুন্দরভাবে পরিচালনা কঠিন হয়ে পড়া, যুদ্ধ যেন আরো এগিয়ে আসছে। বিশ্বায়নের কুফল, রোগের বিস্তৃতি ইত্যাদি এর সাথে যোগ হয়েছে।

উল্লেখযোগ্য হলো, এ শতাব্দীতে চীনের অভূতপূর্ব অগ্রগতি। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, এ শতাব্দী হবে ‘চীনের শতাব্দী’। সবাই বিশেষ আগ্রহসহকারে এই অবস্থা অবলোকন করছে।

তবে প্রযুক্তির মধ্য দিয়ে জীবনের সব স্তরে নানা অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। তাই এখন কেউই ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো সঠিক চিত্রই আঁকতে পারছেন না। কারণ ভালো এবং খারাপ দু’দিকই প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার করছে। ফলে সর্বস্তরে হচ্ছে নতুন সমস্যা। যেমন সামাজিক সাম্যহীনতা। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অসমতা মূলক (ইনইকুয়ালিটি) হত্যাকাণ্ডের জন্য প্রধানত দায়ী সঙ্ঘাত, সংঘর্ষ নয়।’ বক্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য।

আসলে বিশ্বের এই চৌদ্দতম বাঁকের শেষে বিশ্বের অস্তিত্ব থাকবে না বলে অনেকেই দাবি করেছেন। এমন প্রান্তিকভাবে চিন্তা না করলেও বলা যায়, আগামী দিনগুলোর জটিলতায় মানুষের (অর্থাৎ সাধারণ মানুষের) জীবনে শান্তির সময় হবে অত্যন্ত সীমিতÑ এ কথা সবার জানা।

http://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/446578/