৮ অক্টোবর ২০১৯, মঙ্গলবার, ৩:১৪

সম্রাটের দখল ও চাঁদাবাজির ভয়ংকর চিত্র

ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের বহিষ্কৃত সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট গ্রেপ্তার হওয়ার পর বেরিয়ে আসছে তাঁর চাঁদাবাজি ও দখলবাজির ভয়ংকর চিত্র। চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে শুধু পুরান ঢাকায়ই রয়েছে তাঁর শতাধিক ক্যাডার। এই ক্যাডারদের মধ্যে রয়েছেন যুবলীগ ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী।

অন্যদিকে কাকরাইলের রাজমনি সিনেমা হলের উল্টো দিকে যে ভূঁইয়া ট্রেড সেন্টারে অফিস খুলেছিলেন সেই ভবনও দখল করে নেন সম্রাট। দখল হওয়ার পর ভবনের মালিক পুলিশের কাছে অভিযোগ করেও কোনো সহযোগিতা পাননি। উল্টো সম্রাটের নাম শুনে হুমকি দিয়েছে পুলিশ।

কাকরাইলের ভূঁইয়া ট্রেড সেন্টারটি সাত কাঠা জমির ওপর নির্মিত। জমিটির মালিক ছিলেন ওয়াজেদ আলী। তিনি ওই জমিতে ভবন নির্মাণ করতে ২০০৩ সালে ‘মদিনা রিয়েল এস্টেট’ ডেভেলপার কম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন। চুক্তি হয় ৬৫ শতাংশ পাবে ডেভেলপার কম্পানি আর ৩৫ শতাংশ পাবেন ওয়াজেদ আলী। এরপর ৯ তলা ভবনটির নির্মাণকাজ শেষ হয় ২০০৮ সালে। নির্মাণকাজ শেষ হলে ওয়াজেদ আলী তাঁর অংশ বিক্রি করে দেন পাশের ভূঁইয়া ম্যানশনের মালিক দবির ভুইয়ার কাছে। তার পরই ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট দবির ভুইয়ার ফ্লোরে অফিস করা শুরু করেন।

নিচতলায় তিন হাজার স্কয়ার ফিট বাহরাইন এয়ারলাইনসকে এবং পাঁচতলা চিত্রনায়ক অনন্ত জলিলের কাছে ভাড়া দেন মদিনা রিয়েল এস্টেটের মালিক আবু সাইদ রুবেল।

২০১২ সালের দিকে সম্রাট চারতলায় দবির ভুইয়ার ফ্লোরে অফিস শুরু করেন। অফিস নেওয়ার পর থেকেই চিত্র পাল্টাতে শুরু করে ওই ভবনের। ভবনটির গেটের সামনে সম্রাটের অস্ত্রধারী সহযোগীরা অবস্থান নেয়। কেউ ভেতরে যেতে চাইলে তার দেহ তল্লাশি করে ঢুকতে দেওয়া শুরু হয়। এ অবস্থায় অনন্ত জলিল ও বাহরাইন এয়ারলাইনস অফিস ছেড়ে চলে যায়। এই সুযোগে পুরো ভবন দখলে নেন ইসমাইল হোসেন সম্রাট। ভবনটি দখল করলে সম্রাটের বিরুদ্ধে রমনা থানায় অভিযোগ করতে যান মদিনা রিয়েল এস্টেটের মালিক আবু সাইদ রুবেল। ওই সময় রমনা থানার ওসি ছিলেন শিবলী নোমান। ওসি অভিযোগ না নিয়ে উল্টো তাঁকে হুমকি দিয়ে থানা থেকে বের করে দেন বলে জানান আবু সাইদ রুবেল।

গতকাল আবু সাইদ রুবেল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ভবনটি করতে আমার কয়েক কোটি টাকা খরচ হয়েছে। আমি ব্যবসায়ী মানুষ। লাভের জন্য ভবনটি করেছিলাম, কিন্তু ভবনটি দখল করে নেওয়া হয়েছে। আমি এই অন্যায়ের বিচার চাই। আমার অংশ ফেরত চাই। আমি আইনি লড়াইয়ে যাব।’

তিনি আরো বলেন, “ভবনটি দখল করার পর আমি সম্রাটের কাছে গিয়েছিলাম। তিনি আমাকে বলেন, ‘আপনার ভবন তো কেউ দখল করেনি। ফ্লোরগুলো খালি পড়ে আছে, আপনি ভাড়া দেন।’ তখন তাঁকে বলি, আপনার লোকজন ভবনের সামনে অস্ত্র নিয়ে বসে থাকে। কেউ তো ভাড়া নিতে আসতে সাহস করে না। জবাবে সম্রাট বলেন, ‘এটাতে তো আমার কিছু করার নেই।’”

এরপর আর মালিক ভবনটির দখল পাননি। একটি সূত্র বলছে, সম্রাট ভবনটি তাঁর নিজের বলে দাবি করছেন। এর জন্য ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে মালিকানাও তৈরি করেছেন।

অন্যদিকে সম্রাটের চাঁদাবাজির খোঁজ নিতে গিয়ে পাওয়া গেছে ভয়াবহ সব তথ্য। শুধু গুলিস্তান থেকেই প্রতিদিন চাঁদাবাজির প্রায় এক কোটি টাকা যেত সম্রাটের কাছে। চাঁদাবাজির এ কাজে সহযোগিতা করতেন যুবলীগের মনির, মান্নাফি, রিটাসহ কয়েকজন।

সূত্র জানায়, গুলিস্তানের ফুলবাড়িয়া বাসস্ট্যান্ড থেকে প্রতিদিন ৬০ লাখ টাকার বেশি চাঁদা উঠানো হয়। প্রতিটি বাসকে প্রতিদিন এক হাজার ৮০০ থেকে দুই হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়। এ ছাড়া গুলিস্তান হয়ে প্রতিদিন চলাচল করা তিন হাজার গাড়ির মালিককেও চাঁদা দিতে হয়। এর বাইরে সদরঘাট, কাপ্তান বাজার, গুলিস্তানসহ পুরান ঢাকার লেগুনাস্ট্যান্ড, ফুটপাত থেকে প্রতিদিন চাঁদা আদায় করা হয় প্রায় ৫০ লাখ টাকা। কাপ্তান বাজারের পাশ থেকে শতাধিক লেগুনা চলাচল করে জুরাইন টু কাপ্তান বাজার। প্রতিটি লেগুনা থেকে দিনে ৬০০ টাকা করে চাঁদা আদায় করা হয়। ওই স্ট্যান্ড থেকে প্রতিদিন প্রায় এক লাখ টাকা চাঁদা আদায় করা হয়।

একজন লেগুনাচালক মলিন মুখে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাগো দেখার কেউ নাই। সারা দিন পরিশ্রম কইরা হাজার বারো শ টেহা কামাই করি। এর মধ্যে ৬০০ টেহা চান্দা দিয়া দেওন লাগে। আমাগো থাকে চার-পাঁচ শ টাকা। আর তারা পরিশ্রম ছাড়াই লাইনম্যান রিপনরে দিয়া ঘরে বইসা ৬০০ কইরা পাইতাছে।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চাঁদার এই টাকা প্রথমে যায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৫১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর কাজী হাবিবুর রহমান হাবুর কাছে। তিনি চাঁদার ভাগ পাঠাতেন সম্রাটের কাছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে গতকাল সন্ধ্যায় টেলিফোনে হাবিবুর রহমান হাবু কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এটা ভুল ধারণা। আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার।’ সম্রাট গ্রেপ্তার হওয়ার পরও চাঁদা তোলা হচ্ছে। গতকাল সোমবারও চাঁদা তুলেছেন মনির নামের একজন। চাঁদার এই টাকা এখন কার কাছে যাচ্ছে, সেটা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

কাপ্তান বাজার এলাকায় ফুটপাতে টেবিল বিছিয়ে পান-সিগারেট বিক্রি করেন আসিফ। তিনি বলেন, ‘এখানে পান-সিগারেট বিক্রি করার জন্য প্রতিদিন রিটা আপাকে ৫০ টাকা চাঁদা দিতে হয়।’ খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রিটা যুব মহিলা লীগের সদস্য। কাপ্তান বাজার থেকে ওয়ারীর জয়কালী মন্দির পর্যন্ত এলাকার চাঁদা নিয়ন্ত্রণ করেন রিটা। তিনিও সম্রাটের সহযোগী। পুরান ঢাকার তাঁতীবাজার এলাকার এক ডাব বিক্রেতা জানান, তাঁকে প্রতিদিন ৫০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। এই চাঁদার ভাগ পুলিশও নেয়।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2019/10/08/823893