৬ অক্টোবর ২০১৯, রবিবার, ১১:১৯

কফি ও কাজুবাদাম চাষ : প্রশিক্ষণের নামে ১০ কর্মকর্তার বিদেশ সফরের প্রস্তাব

সরকারি অর্থের অপচয় রোধে নাকচ হচ্ছে প্রস্তাব

সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে একের পর এক ধরা পড়ছে নানা দুর্নীতি। একটি বালিশের কভারের মূল্য ২৮ হাজার টাকাসহ বিভিন্ন প্রকল্পে সরঞ্জামের মূল্য এবং স্টাফদের বেতনে অস্বাভাবিক প্রস্তাব করায় তীব্র সমালোচনার মুখে আছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো। প্রতিবারই এসব প্রস্তাব ফেরত পাঠিয়ে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করেছে পরিকল্পনা কমিশন।

যদিও এখন পর্যন্ত কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার খবর পাওয়া যায়নি। বরং প্রস্তাব ভুল হয়েছে- এমন অজুহাত দেখাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। এসবের রেশ কাটতে না কাটতেই এবার ‘কফি ও কাজুবাদাম’ চাষ প্রকল্পে ১০ কর্মকর্তাকে বিদেশ সফরের প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে সরকারি অর্থের অপচয় হবে- এমন কারণ দেখিয়ে এই সফরের প্রস্তাব নাকচ করতে যাচ্ছে কমিশন। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

১০ অক্টোবর অনুষ্ঠেয় প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভার কার্যপত্র থেকে জানা গেছে, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে কফি ও কাজুবাদাম চাষের মাধ্যমে দারিদ্র্য হ্রাসকরণ’ প্রকল্পের অভিজ্ঞতার লক্ষ্যে ব্রাজিল, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, মেক্সিকো, চিলি অথবা এশিয়া ও ইউরোপের সমজাতীয় কফি ও কাজুবাদাম উৎপাদনকারী দেশে ১০ কর্মকর্তার প্রশিক্ষণের প্রস্তাব করা হয়েছে।

এ প্রশিক্ষণ বাবদ ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ ধরা হয়েছে। আর প্রায় ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাবিত প্রকল্পটি সম্পূর্ণ সরকারি অর্থে বাস্তবায়ন হবে। এই অর্থের সর্বোত্তম সদ্ব্যবহারের জন্য প্রস্তাবিত বিদেশ প্রশিক্ষণ বাদ দেয়া যেতে পারে বলে মন্তব্য করা হয় কার্যপত্রে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রকল্পটি প্রক্রিয়াকরণের দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের প্রধান প্রশান্ত কুমার চক্রবর্তী শনিবার যুগান্তরকে বলেন, বিদেশ সফরের নামে অর্থ অপচয় রোধে কঠোর অবস্থান নেয়া হয়েছে।

একেবারেই যেসব প্রকল্পে বিদেশে প্রশিক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে সেগুলোরও পরিমাণ কমানো হচ্ছে। তাছাড়া যেসব প্রকল্পে প্রয়োজন নেই সেসব প্রকল্পে এ খাতের বরাদ্দ কেটে দেয়া হচ্ছে। তবে প্রস্তাবিত কফি ও বাদাম চাষ প্রকল্পটির বিষয়ে পিইসি সভায় প্রশ্ন করা হবে। তারপর সবার মতামতের ভিত্তিতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

অর্থনীতিবিদ ও বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, সব কিছুতেই একটি অরাজকতা দেখা যাচ্ছে। জিনিসপত্র কেনার ক্ষেত্রে যেমন অবাস্তব দাম নির্ধারণ করা হচ্ছে, তেমনি সব প্রকল্পেই যেন বিদেশ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকতেই হবে। সেটি প্রয়োজন হোক আর না হোক। সেই সঙ্গে গাড়িও থাকতে হবে। এর মধ্য দিয়ে সরকারি অর্থ অপচয় হচ্ছে।

এ ধরনের অপচয় মেনে নেয়া যায় না। পরিকল্পনা কমিশন তবুও বিষয়গুলো ধরছে। না হলে আরও খারাপ অবস্থা হতো। এ উদ্যোগ ধারাবাহিকভাবে বজায় রাখতে হবে। সেই সঙ্গে এরকম অহেতুক প্রস্তাব তৈরির সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।

সূত্র জানায়, কফি ও কাজুবাদাম চাষের মাধ্যমে দারিদ্র্য হ্রাসকরণ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতায় পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড। এটি চলতি অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতেও (এডিপি) বরাদ্দহীনভাবে সংযুক্ত নতুন অননুমোদিত প্রকল্পের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত নেই। এজন্য পরিকল্পনামন্ত্রীর সম্মতি নিয়ে প্রকল্পের প্রক্রিয়াকরণ শুরু করা হয়।

এছাড়া স্থানীয় পর্যায়ে ২ হাজার কৃষকের ৬ ধরনের প্রশিক্ষণ ও অভ্যন্তরীণ সফর যেমন গাছ রোপণ ও পরিচর্যা, ফসল সংগ্রহ, প্যাকেজিং ও বাজারজাতকরণ, রিফ্রেসার্স প্রশিক্ষণ, মৌ চাষবিষয়ক প্রশিক্ষণ, বাজারজাতকরণ বিষয়ক প্রশিক্ষণ, উদ্যোক্তা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ এবং কৃষকের অভ্যন্তরীণ উদ্বুদ্ধকরণ সফর খাতে আড়াই কোটি টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে।

এছাড়া প্রশিক্ষণ ব্যয় বাবদ আরও ৩ কোটি ১৮ লাখ টাকার বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে পিইসির কার্যপত্রে বলা হয়েছে, একই কৃষককে সমজাতীয় বিভিন্ন বিষয়ে একাধিকবার প্রশিক্ষণ দেয়া হলে সরকারি অর্থের অপচয় হবে মর্মে প্রতীয়মান হচ্ছে। তাই এসব প্রশিক্ষণ একটি বা দুটি প্যাকেজের আওতায় অর্থাৎ সমন্বিতভাবে সম্পন্ন করা যেতে পারে।

এর বাইরে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপি) নির্মাণ ও পূর্ত খাতের আওতায় ৫০টি মার্কেট শেড, ১০টি জিএফএস, ২০টি পানির উৎস সৃষ্টি এবং ৩০০টি পানির ট্যাংক অবকাঠামো নির্মাণের জন্য ১৯ কোটি ৬০ লাখ টাকা ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে।

কিন্তু এসব নির্মাণ কাজের বিস্তারিত ব্যয় বিভাজন সংযুক্ত করা হয়নি। প্রকল্পের আওতায় সব নির্মাণ কাজের ধরন ও সংখ্যা নির্ধারণ করে পূর্ণাঙ্গ ব্যয় বিভাজন ডিপিপিতে দিতে পরামর্শ দেয়া হয় কার্যপত্রে।

প্রকল্পের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অন্যতম অনুন্নত তিনটি পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল গঠিত। এ অঞ্চলে আবাদযোগ্য জমি মোট জমির মাত্র ৫ শতাংশ।

সমতল জমির অভাবে কৃষকরা তাদের খাদ্যের চাহিদা মেটাতে পাহাড়ের ঢালে অপরিকল্পিত চাষাবাদ করে থাকেন। ফলে একদিকে যেমন ভূমি ক্ষয় এবং ভূমির উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে, অন্যদিকে তেমন পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। এ অবস্থার উন্নয়নে পার্বত্য এলাকায় উদ্যান ফসলের চাষাবাদ গুরুত্ব বাড়ছে। সঠিক পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পার্বত্য এলাকায় মোট ভূমির ২২ শতাংশ উদ্যান ফসলের আওতায় আনার সম্ভাবনা রয়েছে।

প্রসঙ্গত, সম্প্রতি ‘বাংলাদেশ রেলওয়ের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে প্রস্তুতিমূলক কারিগরি সহায়তা’ নামের একটি প্রকল্পে ক্লিনারের মাসিক বেতন ধরা হয়েছিল ৪ লাখ ২০ হাজার টাকা। এ প্রকল্পে অন্যান্য ক্ষেত্রেও অবাস্তব ব্যয় প্রস্তাব করায় সেটি ফেরত দেয় পরিকল্পনা কমিশন।

এরই মধ্যে আবারও একটি প্রকল্পে বালিশের দাম যেখানে সাড়ে ৭০০ টাকা থেকে ২ হাজার টাকা, সেখানে প্রস্তাব হয় ২৭ হাজার ৭২০ টাকা। আর একেকটি বালিশের কভারের দাম ৫০০ থেকে দেড় হাজার টাকার স্থলে প্রস্তাব করা হয় ২৮ হাজার টাকা করে। সেই সঙ্গে একটি সার্জিক্যাল ক্যাপ ও মাস্কের দাম যেখানে সম্ভাব্য বাজার মূল্য ১০০-২০০ টাকা হওয়ার কথা, সেখানে ধরা হয়েছে ৮৪ হাজার টাকা।

৩০০-৫০০ টাকার রেক্সিনের দাম প্রস্তাব করা হয়েছে ৮৪ হাজার টাকা, স্টেরাইল হ্যান্ড গ্লোভসের দাম যেখানে ২০-৫০ টাকা হওয়ার কথা, সেখানে প্রস্তাব করা হয়েছে ৩৫ হাজার টাকা।

২৫০-১০০০ টাকা দামের কটন টাওয়েলের দাম ধরা হয়েছে ৫ হাজার ৮৮০ টাকা। এরকম ১২টি পণ্যের উদাহরণ দিয়ে প্রকল্পটি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ‘চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন’ প্রকল্পটি ফেরত দিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। এছাড়া আরেক প্রকল্পে একটি স্যালাইন স্ট্যান্ডের দাম প্রস্তাব করা হয়েছে ৬০ হাজার টাকা ও লুকিং গ্লাসের দাম ২০ হাজার টাকা।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/228582/