৪ অক্টোবর ২০১৯, শুক্রবার, ১১:৩৩

ক্যাসিনো আমদানি

২৯ চালানে আমদানিকারক ২০ প্রতিষ্ঠান

২০১৪ সালের পর ২৯টি চালানে দেশে ক্যাসিনো আমদানি করা হয়েছে। এসব চালান যাচাই-বাছাই কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর। তবে কী পরিমাণ আমদানি হয়েছে তা এখনও বের করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। ইতোমধ্যে ক্যাসিনো পণ্য আমদানিকারক ২০টি প্রতিষ্ঠানের নাম নিশ্চিত হয়ে এসব প্রতিষ্ঠানের মালিক ও সিএন্ডএফ এজেন্টকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে প্রতিষ্ঠানটি। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কখনও খেলনা, কখনও বার্থডে আইটেমসহ বিভিন্ন পণ্যের মিথ্যা ঘোষণার আড়ালে ক্যাসিনো পণ্য আমদানি করা হয়েছে বলে জিজ্ঞাসাবাদে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো তথ্য দিচ্ছে। সে সব তথ্যের ভিত্তিতে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান থেকে ক্যাসিনোর সামগ্রী মাহাজং আটক করা হয়েছে। সর্বশেষ গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর উত্তরা এলাকায় কেন্ট নামে এক চীনা নাগরিকের মালিকানাধীন আবাসিক হোস্টেল থেকে দু’টি ক্যাসিনোর ইলেক্ট্রিক গ্যাম্বলিং মেশিন ‘মাহাজং’ উদ্ধার করা হয়েছে। এ দু’টি ক্যাসিনো খেলার সরঞ্জাম কেন্টের মালিকানাধীন হবনব কফি হাউজ ও চাইনিজ রেস্টুরেন্টে ব্যবহার করা হতো। কাস্টমস সূত্র জানায়, বিকেল সাড়ে ৩টায় উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের গাউসুল আজম এভিনিউ এলাকার হবনব কফি হাউজ ও চাইনিজ রেস্টুরেন্ট এবং ওই চীনা নাগরিকের বাণিজ্যিক আবাসিক হোস্টেলে (সেক্টর-১৪, রোড-১৫, হাউস-৫৬, উত্তরা) অভিযান চালিয়ে এ ক্যাসিনো সামগ্রী দু’টি উদ্ধার করেছে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের একটি দল।

কাস্টমস কর্তৃপক্ষ জানায়, ক্যাসিনো খেলার ইলেকট্রিক মাহাজং মেশিন দু’টি মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে আমদানি করা হয়েছে। মাহাজং দু’টি খালাস করতে আনুমানিক দুই কোটি ৮৫ লাখ টাকা শুল্ক ফাঁকি দেয়া হয়েছে।
কাস্টমস কর্তৃপক্ষ জানায়, ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে এ অভিযান অব্যাহত থাকবে। এদিকে ক্যাসিনো পণ্যের আমদানি রোধে গেমস ও গেমস সামগ্রী চালান খালাসের ক্ষেত্রে সব কাস্টম হাউসকে নির্দেশনা দিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চেয়ারম্যানকে অনুরোধ করা হয়েছে।

গত সোমবার কাস্টমস গোয়েন্দা থেকে এনবিআর চেয়ারম্যানকে ক্যাসিনো বিষয়ে প্রতিবেদন দেয়া হয়। তাতে বলা হয়, অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেম থেকে ক্যাসিনো সামগ্রী আমদানির তথ্য যাচাই করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, এইচএস কোড হেডিং ৯৫০৪-এর বিপরীতে বিভিন্ন গেমস ও গেমস ইকুইপমেন্ট আমদানি করা হয়েছে। এর মধ্যে চারটি প্রতিষ্ঠান সরাসরি ক্যাসিনো সামগ্রী ঘোষণা দিয়ে আমদানি করেছে। এছাড়া গেমস ও বিভিন্ন ধরনের গেমস ইকুইপমেন্ট, যেমন মাহাজং গেম, কয়েন অপারেটেড মেশিন, স্পোর্টস টেবিল ও গেম মেশিন ঘোষণা সন্দেহে ২৯টি চালান শনাক্ত করা হয়েছে। এসব চালানের তথ্য কাস্টমস গোয়েন্দা নিবিড়ভাবে যাচাই-বাছাই করছে।

এতে বলা হয়, এরই মধ্যে দুই আমদানিকারক ও এক সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এর মধ্যে পুষ্পিতা এন্টারপ্রাইজ নামক প্রতিষ্ঠানটি সরাসরি ক্যাসিনো পণ্য ঘোষণা দিয়ে আমদানি করেছে। প্রতিষ্ঠানটি জিজ্ঞাসাবাদে ক্যাসিনো সামগ্রী কাদের কাছে বিক্রি করা হয়েছে এবং কারা ব্যবহার করছেন, সে বিষয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে।

প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী সুরঞ্জন শেঠ তাপস জানিয়েছেন, তিনি উত্তর কমলাপুরের সোহেলের অনুরোধে ক্যাসিনো ওয়্যার গেম টেবিল, পোকার গেম চিপস ও রোলেট গেম টেবিল আমদানি করেছেন। তদন্তে দেখা যায়, মো. ইলিয়াছ ওরফে সোহেল পণ্যগুলো গুলশান-১-এর দীনেশ ও রাজকুমারের কাছে বিক্রি করেছেন। এ বিষয়টি আমরা আরও তদন্ত করছি। এ-থ্রি থ্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, ভারত থেকে বার্থডে আইটেমের সঙ্গে রোলেট গেম সেট ও পোকার সেট আমদানি করা হয়েছে। এসব পণ্য প্রতিষ্ঠানটি অনলাইনে বিক্রি করে দিয়েছে। তবে যাদের কাছে বিক্রি করা হয়েছে তাদের তলব করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, কাস্টমস গোয়েন্দার তদন্তে দেখা যায়, বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান হংকং ও ম্যাকাও’র ক্যাসিনোর জুয়ায় ব্যবহত মাহাজং আমদানি করেছে। রাজধানীসহ সারা দেশে যেখানে চীন ও অন্যান্য দেশের নাগরিকরা কাজ করছে, সেখানে মাহাজং নামক জুয়া খেলা হয়। শুধু বিদেশি নয়, বাংলাদেশিরাও এ খেলায় মেতে উঠেছে। সহজে বহনযোগ্য মাহাজং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মিথ্যা ঘোষণায় আমদানি করা হয়েছে। তলব করা ২০টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১১টি প্রতিষ্ঠানই মিথ্যা ঘোষণার আড়ালে মাহাজং আমদানি করেছে।

কাস্টমস গোয়েন্দা গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে বেশ কিছু মাহাজং আটক করেছে। এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জের বেস্ট টাইকুন (বিডি) এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড নামক মোবাইল ফোন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান থেকে ক্যাসিনো আটক করা হয়। প্রতিষ্ঠানটি মোবাইল সামগ্রী ঘোষণা দিয়ে মাহাজং আমদানি করেছে। এছাড়া নারায়ণগঞ্জের ব্যাটারি প্রস্তুতকারী কারখানা লংজারভিটি ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড ও মুন্সীগঞ্জের নিউ হোপ এগ্রোটেক বাংলাদেশ লিমিটেড নামে পোলট্রি ফিড ফ্যাক্টরি থেকে মাহাজং আটক করা হয়।

প্রতিবেদনে সুপারিশ করে বলা হয়, আমদানি নীতির নিষিদ্ধ পণ্যের তালিকায় ক্যাসিনো সামগ্রী নেই। এছাড়া সংবিধানেও নেই। এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করতে মত দেয়া হয়েছে। ক্যাসিনোর জন্য আলাদা এইচএস কোড না করা পর্যন্ত গেমস চালানগুলো শতভাগ কায়িক পরীক্ষা করতে সব কাস্টম হাউসকে নির্দেশনা দেয়ার অনুরোধ করা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে।

আমাদানিকারক ২০টি প্রতিষ্ঠান
কাস্টমস গোয়েন্দার প্রতিবেদনে বলা হয়, ক্যাসিনো মেশিন ও সামগ্রী আমদানি করেছে এমন ২০টি প্রতিষ্ঠানের তথ্য পেয়েছে কাস্টমস গোয়েন্দা। এসব প্রতিষ্ঠানকে তলব করা হয়েছে। কিছু প্রতিষ্ঠানের শুনানি নেওয়া হয়েছে, কিছু প্রতিষ্ঠানের শুনানি চলমান রয়েছে। ২০টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১১টি প্রতিষ্ঠানই মাহাজং আমদানি করেছে বলে তথ্য পেয়েছে কাস্টমস গোয়েন্দা। ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে নিনাদ ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল ২০১৮ সালে তিনটি চালানে ক্যাসিনো কয়েন, মাহাজং মেশিন ও মেশিন টেবিল আমদানি করেছে। জাহিন ইন্টেরিয়র কম্পোনেন্ট নামে প্রতিষ্ঠানটি ২০১৮ সালে মাহাজং মেশিন, চৌধুরী ট্রেডার্স চলতি বছর চারটি চালানে মাহাজং মেশিন, মাহাজং টেবিল ও টেবিল পার্টস আমদানি করেছে। আলিক রক ইন্টারন্যাশনাল চলতি বছর মাহাজং মেশিন পার্টস, বিবি ইন্টারন্যাশনাল ২০১৮ সালে মাহাজং মেশিন, এভারগ্রিন প্রোডাক্টস ফ্যাক্টরি (বিডি) লিমিটেড ২০১৬ সালে মাহাজং মেশিন ও মেশিন পার্টস, নিউ হোপ এগ্রোটিচ বাংলাদেশ লিমিটেড ২০১৮ সালে মাহাজং, মুন ট্রেডিং কোম্পানি চলতি বছর মাহাজং এবং বেস্ট টাইকন (বিডি) এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড চলতি বছর মাহাজং টেবিল গেম আমদানি করেছে।

এছাড়া সিক্স সি করপোরেশন ২০১৮ সালে চারটি চালানে ক্যাসিনোর অন্যান্য সামগ্রীর পাশাপাশি মাহাজং মেশিন ও গেম এবং ডগজিন লংগারভিটি ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড ২০১৮ সালে ইলেকট্রনিক মাহাজং মেশিন আমদানি করেছে। মাহাজং ছাড়াও ৯টি প্রতিষ্ঠান ক্যাসিনোর অন্যান্য সামগ্রী আমদানি করেছে। এর মধ্যে রয়েছে এএম ইসলাম অ্যান্ড সন্স, পুষ্পিতা এন্টারপ্রাইজ, এ-থ্রি ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, রেডিয়েন্ট ইন্টারন্যাশনাল, আলিফ এন্টারপ্রাইজ, সোলডার জিয়ার, চায়না হোটেল সাপ্লাই, জান্নাত ট্রেডিং ও এমআর ইন্টারন্যাশনাল।

https://www.dailyinqilab.com/article/238708/