৩ অক্টোবর ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ১১:৫৬

বালিশ ২৭০০০, কভার ২৮০০০ টাকা

স্বাস্থ্যের তুঘলকি প্রস্তাবে তোলপাড়

এবার চট্টগ্রামের বালিশ-কভার কাহিনী রূপপুরের বালিশ কাহিনীকেও হার মানিয়েছে। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্পের বালিশ-কভার কেনার অস্বাভাবিক দর প্রস্তাবে তোলপাড় চলছে। ২৭ হাজার টাকায় বালিশ আর ২৮ হাজারে কভার কেনার প্রস্তাবটি ইতোমধ্যে ফিরিয়ে দিয়েছে পরিকল্পনা বিভাগ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয়ে এ ধরনের পুকুরচুরি ও দুর্নীতির প্রস্তাব কীভাবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কিংবা ভিসির মাধ্যমে এলো, এমন প্রশ্ন সর্বত্র। চলছে নানা হিসাব নিকেশ। জানা গেছে, ফিউচার আইটি নামের একটি ফার্ম চিকিৎসা সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতি ক্রয়ের নজীরবিহীন ডিপিপি তৈরি করেছিল। আজ বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) নিয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। এতে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে।

প্রচলিত সরকারি বিধিবিধান অনুসারে ৫০ কোটি টাকার ওপর কোনো প্রতিষ্ঠানের স্থাপন প্রকল্প পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানোর আগে প্রস্তাবিত স্থানের সম্ভাব্যতা (ফিজিবিলিটি স্টাডি) যাচাই করা বাধ্যতামূলক।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্পটি অনুমোদনের জন্য স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় থেকে তড়িঘড়ি করে পরিকল্পনা কমিশনের আর্থসামাজিক অবকাঠামো বিভাগে পাঠানো হয়। তবে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্পের চিকিৎসা সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতি ক্রয়ের খরচের যে প্রস্তাবনাটি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে সেই প্রস্তাবে ‘সম্ভাব্য দুর্নীতি’ রূপকথার গল্পকেও হার মানিয়েছে।

চলতি বছরের মে মাসে দেশের অন্যতম মেগা প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বসবাসের জন্য নির্মিত গ্রিন সিটিতে আসবাবপত্র ও অন্যান্য জিনিসপত্র ক্রয়ে লাগামছাড়া দুর্নীতির তথ্য ফাঁস হয়। একটি বালিশের পেছনে ব্যয় দেখানো হয় ৬ হাজার ৭১৭ টাকা। এর মধ্যে এর দাম বাবদ ৫ হাজার ৯৫৭ টাকা আর সেই বালিশ নিচ থেকে ফ্ল্যাটে ওঠাতে খরচ ৭৬০ টাকা উল্লেখ করা হয়।

এবার সেই বালিশের চেয়ে পাঁচগুণ বেশি দামি বালিশ কেনার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সম্ভাব্য নির্মাণ প্রকল্প ব্যয় তালিকায়। এ প্রকল্পে একটি ২ হাজার টাকা দামের পিলোর (বালিশ) দর ২৭ হাজার ৭২০ টাকা আর কভারের দাম ধরা হয়েছে ২৮ হাজার টাকা। কিন্তু প্রচলিত বাজারে এর দাম তিন থেকে চারশ টাকা হতে পারে। একটি সার্জিক্যাল ক্যাপ ও মাস্কের বর্তমান বাজারমূল্য সর্বোচ্চ ২০০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা হলেও প্রতিটির দাম ৮৪ হাজার কোটি টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। একইভাবে সর্বোচ্চ ৫০ টাকা দামের টেস্টটিউব প্রতিটির দাম ৫৬ হাজার টাকা, ২০ থেকে ৫০ টাকা দামের একটি স্টেরাইল হ্যান্ড গ্লোভসের দাম ধরা হয়েছে ৩৫ হাজার টাকা। এছাড়া ডিসপোজেবল সার্জিক্যাল ক্যাপ ও মাস্ক প্রতিটির মূল্য ধরা হয়েছে ৮০ হাজার টাকা।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) তৈরি করে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। গত ২রা সেপ্টেম্বর পরিকল্পনা কমিশনে আর্থসামাজিক অবকাঠামো বিভাগের সদস্য আবুল কালাম আজাদের সভাপতিত্বে প্রকল্পের মূল্যায়ন কমিটির বৈঠকে যন্ত্রপাতি ও চিকিৎসা সরঞ্জাম ক্রয়ে সম্ভাব্য দুর্নীতির বিষয়টি ধরা পড়ে। বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের জন্য ১২টি চিকিৎসা সরঞ্জামের দাম অতিরঞ্জিত ও যথেচ্ছভাবে প্রাক্কলন করা হয়েছে। মূল্যায়ন কমিটির ওই বৈঠকে এই প্রকল্পের খরচের হিসাব নিয়ে অসন্তোষ ও চরমভাবে আপত্তি জানিয়ে ডিপিপি রিভাইসের জন্য স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে ফেরত পাঠানো হয়।

চিকিৎসা সরঞ্জামাদির নাম, প্রতিটি পণ্যের প্রস্তাবিত মূল্য (একক হিসাবে) ও সম্ভাব্য বাজারমূল্য (সরবরাহকারীর লাভ, ভ্যাট ও ট্যাক্সসহ) নিচে দেয়া হলো- (১) স্টরাইল হ্যান্ড গ্লোভসের দাম ধরা হয়েছে ৩৫ হাজার টাকা, যার বাজারমূল্য ২০ টাকা থেকে ৫০ টাকা (২) টেস্টটিউব-গ্লাস মেড, সাইজ ৫ এমএল ৫৬ হাজার টাকা, যার বাজারমূল্য ১৫ টাকা থেকে ৫ হাজার টাকা (৩) মাল্টিপ্লাগ উইথ এক্সটেনশন কর্ড, থ্রি-পিন ফ্লাগ বা রাউন্ড প্লাগ ৬ হাজার ৩০০ টাকা, যার বাজারমূল্য ২৫০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা (৪) রাবার ক্লথ ১০ হাজার টাকা, যার বাজার মূল্য ৫০০ টাকা থেকে ৭০০ টাকা (৫) রেক্সিন ৮৪ হাজার টাকা, যার বাজারমূল্য ৩০০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা (৬) কটন টাওয়েল ৫ হাজার ৮৮০ টাকা, যার বাজারমূল্য ২৫০ টাকা থেকে ১ হাজার টাকা (৭) হোয়াইট গাউন ৪৯ হাজার টাকা, যার বাজারমূল্য ১০০ টাকা থেকে ২০০ টাকা (৮) ডিসপোজেবল সার্জিক্যাল ক্যাপ ও মাস্ক ৮৪ হাজার টাকা, যার বাজার মূল্য ১ হাজার থেকে ২ হাজার টাকা (৯) ডিসপোজেবল সুকভার ১৭ হাজার ৫০০ টাকা, যার বাজারমূল্য ২০ টাকা থেকে ৫ হাজার টাকা (১০) বালিশ ২৭ হাজার ৭২০ টাকা, বাজারমূল্য ৭৫০ টাকা ২ হাজার টাকা (১১) বালিশের কভার ২৮ হাজার টাকা, বাজারমূল্য ৫০০ টাকা থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা।

পর্যালোচনায় দেখা যায়, ৫৪ ইঞ্চি আকারের একটি সাদা গাউনের দাম ধরা হয়েছে ৪৯ হাজার টাকা, যার বর্তমান বাজারদর সর্বোচ্চ ২ হাজার টাকা। প্রকল্পে ২২ ইঞ্চি বাই ৩৬ ইঞ্চি আকারের কটন টাওয়েলের দাম ধরা হয়েছে ৫ হাজার ৮৮০ টাকা, যার বাজারমূল্য হলো মানভেদে ২৫০ থেকে সর্বোচ্চ এক হাজার টাকা। ৫৪ ইঞ্চি আকারের একটি রেক্সিনের দাম ধরা হয়েছে ৮৪ হাজার টাকা, যার বাজারদর ৩শ থেকে ৫শ টাকা। ৫৪ ইঞ্চি আকারের রাবার ক্লথ ধরা হয়েছে ১০ হাজার টাকা। বাজারে গিয়ে দাম জানা গেছে ৫শ থেকে ৭শ টাকা।

চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসির দায়িত্ব পালন করছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের সাবেক প্রিন্সিপাল অধ্যাপক ডা. মো. ইসমাইল খান। প্রকল্পের অস্বাভাবিক ব্যয় প্রস্তাব সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা বিভাগ থেকে প্রককল্পটির প্রস্তাবনা তৈরি করা হয়। কনসালটেন্ট নিয়োগ করে নির্মাণ ব্যয় প্রস্তাবনা তৈরি করে তা পরিকল্পনা কমিশনে পেশ করা হয়। গত ২রা সেপ্টেম্বর পরিকল্পনা কমিশনে আর্থসামাজিক অবকাঠামো বিভাগের সদস্য আবুল কালাম আজাদের সভাপতিত্বে প্রকল্পের মূল্যায়ন কমিটির বৈঠকে যন্ত্রপাতি ও চিকিৎসা সরঞ্জাম ক্রয়ে বহুগুণ বেশি দাম দেখানোর বিষয়টি ধরা পড়ে। তিনি বলেন, ভিসি হিসেবে প্রস্তাবিত প্রকল্পটিতে তার স্বাক্ষর থাকলেও তিনি প্রকল্পের খরচের সব পৃষ্ঠা পড়ে দেখেননি। একাডেমিশিয়ান হিসেবে শুধু মুখবন্ধসহ প্রকল্পটিতে চিকিৎসা, শিক্ষা ও গবেষণার উন্নয়নে কী কী প্রস্তাব করা হয়েছে তা দেখেছেন তিনি। ভিসি হিসেবে তারও সব দেখার কথা থাকলেও সেখানে তার ভুল হয়েছে। কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা বিভাগের প্রকল্পটির প্রতিটি পৃষ্ঠা পড়ে স্বাক্ষর করার কথা। অধ্যাপক ডা. মো. ইসমাইল খান বলেন, প্রকল্পটি নিয়ে গত ২রা সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত বৈঠকে তিনি নিজেই আপত্তি তুলছিলেন। তিনি বলেন, শিক্ষক হিসেবে লজ্জিত বোধ করছি। দীর্ঘদিনের অর্জিত সুনাম নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়েছে।

ডিপিপি নিয়ে মন্ত্রী যা বললেন: এদিকে চট্টগ্রামে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনায় (ডিপিপি) ৭৫০ টাকার বালিশ ক্রয়ে ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে ২৭ হাজার ৭২০ টাকা। আর বালিশের কভারের দাম ধরা হয়েছে ২৮ হাজার টাকা। গতকাল বিএসএমএমইউতে এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকরা এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, এই ডিপিপিতে ভুল হয়েছে। যারা এ ডিপিপির সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, আমি তো গতকালই( মঙ্গলবার) দেশে এসেছি। এটা অবশ্যই আমি দেখব। এ ডিপিপিটি সবেমাত্র প্রস্তাব আকারে গেছে। এ ধরনের একটি প্রস্তাব প্রায় ২ হাজার পেজের হয়। এতে হাজার হাজার আইটেম থাকে। সেখানে যদি কোনো ভুল হয়ে থাকে, পরিকল্পনা কমিশন এগুলোর বিষয়ে আমাদের বলেছে। এগুলো ঠিক করে দেয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
ডিপিপি থেকে জানা গেছে, দেশের স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে চট্টগ্রামে আন্তর্জাতিক মানের মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণ করতে যাচ্ছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এ জন্য ২২ তলাবিশিষ্ট এক হাজার বেডের দুটি হাসপাতাল ভবন নির্মাণ করা হবে। এছাড়া ২০ তলাবিশিষ্ট দুই বেজমেন্টের প্রশাসনিক ভবন করা হবে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চট্টগ্রাম বন্দর বাইপাস সড়কের পাশে ২৮ দশমিক ৪২ একর জায়গা জুড়ে হবে বিশ্ববিদ্যালয়টি। প্রাথমিকভাবে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। অনুমোদন পেলে চলতি বছর থেকে ২০২২ সালের জুন মাসের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হওয়ার কথা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রকল্পের একটি চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

http://mzamin.com/article.php?mzamin=192961