১ অক্টোবর ২০১৯, মঙ্গলবার, ৭:০৭

ইলিশ বনাম পেঁয়াজ

দুই দেশের বন্ধুত্বের নিদর্শন

এই হলো ভারতের বন্ধুত্বের নিদর্শন! পূজা উপলক্ষে বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে বাংলাদেশ শুভেচ্ছা উপহার হিসেবে ৫০০ মেট্রিক টন ইলিশ ভারতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়। ২৯ সেপ্টেম্বর ২৪ মেট্রিক টন ইলিশের চালান কলকাতায় পৌঁছানো হয়। মিডিয়ায় এই খবর প্রচারের পরই দিল্লি থেকে বাংলাদেশে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধের ঘোষণা দেয়া হয়। হঠাৎ পেঁয়াজ রফতানি বন্ধের ঘোষণা দেয়ায় ভারত থেকে পেঁয়াজের যেসব ট্রাক বেনাপোল, বুড়িমারি ও হিলি স্থলবন্দরের দিকে আসছিল সেগুলো আটক করে দেয়া হয়। বিজ্ঞানের বদৌলতে এ খবর প্রচার হতে না হতেই বাংলাদেশ হুহু করে বাড়তে থাকে পেঁয়াজের দাম। ৩০ টাকা কেজি দরের যে পেঁয়াজ ৭০ টাকা দরে বিক্রি হতো সেই পেঁয়াজের দাম এক দিনে ৪০ থেকে ৫০ টাকা বেড়ে ১১০ থেকে ১২০ টাকা দর হয়ে যায়। ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের ওপর অধিক নির্ভরশীল হওয়ায় বাংলাদেশকে এই পরিণতি ভোগ করতে হচ্ছে।

জানা যায়, দেশের ভোক্তা চাহিদা মেটাতেই ২০১২ সালের পর থেকে ভারতে ইলিশ রফতানি বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশ। এরপর থেকে বৈধভাবে বাংলাদেশের ইলিশ পশ্চিমবঙ্গে যায়নি। কিন্তু গত ২৭ সেপ্টেম্বর বুধবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় পূজা উপলক্ষে ভারতে ইলিশ রফতানির সিদ্ধান্ত নেয়। গত রোববার যশোরের বেনাপোল হয়ে উপহারের ২৪ মেট্রিক টন ইলিশের চালান পাঠানো পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় পৌঁছায়। গেল সপ্তাহের বুধবার ইলিশ পাঠানোর এ অনুমোদন দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। প্রতি কেজি ইলিশের মূল্য ছয় ডলার (প্রায় ৫০০ টাকা) ধরা হয়। ইলিশের চালানের মধ্যে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কেনো শুল্ক ধরা হয়নি। ইলিশ ব্যবসায়ী সৈয়দ মহিতুল হক রুবাই জানান, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে পূজা উপলক্ষে ভারতে যে ৫০০ মেট্রিক টন ইলিশ রফতানি শুরু হয়েছে; তা আগামী ১০ অক্টোবরের মধ্যে তা রফতানি র নির্দেশনা রয়েছে। বাণিজ্য সচিব ড. মো. জাফর উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, দুর্গাপূজার শুভেচ্ছা হিসেবে ভারতে ৫০০ টন ইলিশ পাঠানো হচ্ছে। তবে এটি রফতানির কোনো বিষয় নয়। দুর্গাপূজা উপলক্ষে শুধু পাঠানো হবে। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা ভারতের কলকাতায় ইলিশ নিয়ে যাবেন। পরে সেখানকার বাজারে তা বিক্রি করবেন। মূলত কলকাতার বাজারেই এ ইলিশ বিক্রি হবে।

ইলিশের শুল্কমুক্ত প্রথম চালান ভারতে পৌঁছানের দিনই (২৯ সেপেন্টম্বর) ভারত সরকার বাংলাদেশে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দেয়। হঠাৎ করে পেঁয়াজ আসা বন্ধ হওয়ায় বাংলাদেশে অস্বাভাবিকভাবে বেড়েই চলছে পেঁয়াজের দাম। গত কয়েকদিনে খুচরা বাজারে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম গড়ে প্রায় ৪০-৪৫ টাকা বেড়েছে। আর আর ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ হওয়ার ঘোষণায় এই নিত্যপণ্যটির দাম অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়েছে। কোথাও কোথাও একশ’ টাকার বেশি দামেও পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, পেঁয়াজের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। তারপরও অসাধু ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন। তাদের ধরতে মাঠে নেমেছে মনিটরিং টিম।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ভারত থেকে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধের ঘোষণায় ঢাকার পাইকারি বাজারগুলো থেকে হঠাৎ পেঁয়াজ উধাও হয়ে যায়। ব্যবসায়ীরা সুযোগ পেয়ে যে যার মতো দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন। ১২০ টাকা কেজি দরেও পেঁয়াজ বিক্রির খবর পাওয়া গেছে। খুঁচরা বাজারে পেঁয়াজের দামবৃদ্ধি সরকারের নজরে আসায় তা নিয়ন্ত্রণে মনিটরিং টিম মাঠে নামানো হয়। আর পেঁয়াজের চাহিদা মেটাতে ইতিমধ্যে মিয়ানমার থেকে আমদানি করা দুই জাহাজ পেঁয়াজ চট্টগ্রাম বন্দরে এসে পৌঁছেছে। দু’একদিনের মধ্যেই সেগুলো বাজারে পৌঁছে যাবে। তাই সরবরাহ কম এই অজুহাত দেয়ার সুযোগ থাকবে না। ফলে দাম অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আসবে এমন বক্তব্য সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের।

এরআগে গত ১৩ সেপ্টেম্বর ভারত সরকার পেঁয়াজ রফতানিতে ন্যূনতম মূল্য টন প্রতি ৮৫০ ডলার বেঁধে দেয়। এরপর থেকেই বেশি মূল্যে পেঁয়াজ আমদানি করে আসছে হিলি স্থলবন্দরের আমদানিকারকরা। ফলে তখন থেকে বাড়তে থাকে পেঁয়াজের দাম। সর্বশেষ গত রোববার পেঁয়াজের উৎপাদন সঙ্কট দেখিয়ে প্রতি বছরের মতো এবারও বাংলাদেশে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দেয় ভারত সরকার। আর এর প্রভাব পড়েছে পাইকারি ও খোলা বাজারে। কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে কেজি প্রতি বেড়েছে ৪০ থেকে ৪৫ টাকা।

মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, ভারত সরকার নিজেদের রফতানি নীতি সংশোধন করে পেঁয়াজকে রফতানি নিষিদ্ধ পণ্যের তালিকায় ঢুকিয়েছে। ফলে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ থাকবে। তবে এ খবর পেয়েই বাংলাদেশের অসাধু সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন। এ সমস্যা বেশিদিন থাকবে না। মিশর, তুরস্ক ও মিয়ানমার থেকে পেঁয়াজ আমদানির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ফলে ভারত রফতানি বন্ধ করলেও বাজারে পেঁয়াজের সঙ্কট হবে না। আর টিসিবি গত রোববার থেকে রাজধানীর ১৯টি পয়েন্টে ৪৫ টাকা দরে পেঁয়াজ বিক্রি শুরু করেছে।

রাজধানীর কয়েকটি বাজার সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, ভারতের পেঁয়াজ রফতানি বন্ধের খবরে গত রোববার রাত থেকেই দাম বাড়িয়ে দেন ব্যবসায়ীরা। গত কয়েকদিনের ক্রমাগত দাম বৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় একধাপ পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধি পেয়ে একশ’ টাকা ছাড়িয়েছে। ফলে বিপাকে পড়েছেন সাধারণ ক্রেতারা। ভোক্তারা বলছেন, অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারণে পেঁয়াজের দাম ক্রমাগত বাড়ছে। দুইদিন আগেও বাজারে যে পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৭০ থেকে ৮৫ টাকা কেজি দরে। একদিনের ব্যবধানে বাজার ভেদে সেই পেঁয়াজের দাম ১০০ থেকে ১২০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন, পেঁয়াজসহ সবকিছুতেই বর্তমান সরকার ভারতের ওপর অধিক নির্ভরশীল হওয়ায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। যদি ভারতের পাশাপাশি আগে থেকেই মিশর, তুরস্ক, মিয়ানমার থেকে পেঁয়াজ আমদানির সিদ্ধান্ত হতো তাহলে এখন বিপাকে পড়তে হতো না।

এ বিষয়ে বাণিজ্য সচিব ড. মো. জাফর উদ্দিন বলেন, ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি করতে না পারলেও দেশে পেঁয়াজের ঘাটতি হবে না। কারণ আমরা অন্যান্য আরো কয়েকটি দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানির উদ্যোগ নিয়েছি। ইতোমধ্যে মিয়ানমার থেকে দুই জাহাজ পেঁয়াজ চট্টগ্রাম বন্দরে এসে পৌঁছেছে। এসব পেঁয়াজ বাজারে আসলে আর সঙ্কট থাকবে না। আমি মনে করি আজকের (৩০ সেপ্টেম্বর) মধ্যেই পেঁয়াজের দাম কমবে। সচিব আরো বলেন, আমাদের পর্যাপ্ত মজুদ থাকা সত্তে¡ও অসাধু ব্যবসায়ীরা বাজারে পেঁয়াজের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন, তাদের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে মাঠে নেমেছে মনিটরিং টিম। তারা অবৈধভাবে পেঁয়াজ মজুদ ও বাড়তি দামে বিক্রি করা ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন।

এ বিষয়ে আমদানি ও রফতানি নিয়ন্ত্রণ দফতরের নিয়ন্ত্রক (চলতি দায়িত্ব) মোহাম্মদ আওলাদ হোসেন বলেন, পেঁয়াজের দাম বাড়ার জন্য নতুন করে কোনো দেশ থেকে আরো বেশি পেঁয়াজ আমদানি করা হবে কি না সে সিদ্ধান্ত আসে মন্ত্রণালয় থেকে। মন্ত্রণালয় থেকে যে সিদ্ধান্ত আসবে আমরা সেভাবেই ব্যবস্থা নেব। এ ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হবে না। উল্লেখ, কয়েকদিন আগে পেঁয়াজের মূল্য বৃদ্ধি রেখে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ব্যবসায়ীসহ স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে বৈঠকের আয়োজন করে। সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা যাননি; এমনিক বাণিজ্য মন্ত্রী নিজেও উপস্থিত হননি। সচিব ওই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেছিলেন।
একদিনে পূজা উপলক্ষে বাংলাদেশ সরকার ভারতে ইলিশ রফতানির সিদ্ধান্ত নেয়; অথচ অন্যদিকে হঠাৎ ভারত পেঁয়াজের রফতানি বন্ধ করে দেয়। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ভারতের এই আচরণ থেকে বাংলাদেশের শিক্ষা নেয়া উচিত।

https://www.dailyinqilab.com/article/237974/