২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯, রবিবার, ১:০৯

বাংলাদেশের অর্থনীতি দুর্নীতিতে আক্রান্ত

হারুন-আর-রশিদ

ভোগবাদী গোষ্ঠীর কারণে আমাদের প্রত্যাশিত দু’টি জিনিস ‘গণতন্ত্র এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য’ অপ্রত্যাশিত থেকে যায়। যে দু’টি মৌলিক বিষয় নিয়ে আমরা যুদ্ধ করেছিলাম, সেটা যদি ৪৮ বছর পর্যন্ত অপেক্ষার পরও অর্জিত না হয়Ñ তাহলে আরেকটি বড় ধরনের সামাজিক অধিকারের জন্য বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে একীভূত করে আন্দোলনের প্রয়োজন আছে বলে মনে করি।

স্বাধীনতাপূর্ব সময়ে আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য বিরোধী দল জনগণের কাছে একটি লিফলেট বিতরণ করেছিল। লিফলেটের হেডলাইন ছিলÑ পূর্ব বাংলা শ্মশান কেনÑ জবাব চাই আইয়ুব শাহী। ওই লিফলেটে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্যের একটি চিত্র তুলে ধরা হয়। যেমন পশ্চিম পাকিস্তানে প্রতি দিস্তা কাগজের দাম ছয়আনা আর পূর্ব পাকিস্তানে সেই একই কাগজ ১০ আনা কেন হবে? কাগজের মিলগুলোর সব ক’টি পূর্ব পাকিস্তানে ছিল; তার পরও এ ধরনের বৈষম্য থাকায় মানুষের মধ্যে হতাশা দেখা দেয়। ৪৮ বছর পর আমরা কী দেখছি। আমরা দেখছি, সেই কাগজের মিলগুলো বন্ধ হয়ে গেছে নতুবা রুগ্ণতায় ভুগছে। পরিতাপের বিষয়, আমরা বহু বছর ধরে আমদানি করা কাগজে লিখি।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের আরেকটি প্রত্যাশিত বিষয় ছিল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। দুঃখজনক যে, ৪৮ বছরের বেশির ভাগ সময়ে দেশে সামরিক ও উত্তরাধিকারী শাসন বজায় ছিল। একটি শক্তিশালী, স্বাধীন নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনারের অধীনে সরাসরি জনগণের নির্বাচিত সরকারকে বলা হয় গণতান্ত্রিক সরকার। এটা থেকেও আমরা বঞ্চিত হলাম। ’৭০-এর নির্বাচিত সরকারের কাছে আমরা যেটা চেয়েছিলাম সেটা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাড়ে তিন বছর শাসনামলে পাইনি। পরবর্তী সব সরকারই জনগণের কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে যেনতেনভাবে ক্ষমতায় গিয়ে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সেই রাজনৈতিক সংস্কৃতি এখনো চলছে।

অতি কৌশলে ভ্যাট ও ট্যাক্সের নামে নানা রকম করের বোঝা মধ্যবিত্ত ও নি¤œমধ্যবিত্ত মানুষের ওপর চাপিয়ে দিয়ে তাদের ভোগান্তি আরো বাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। উন্নত বিশ্বের উদাহরণ টেনে যারা বলেনÑ ‘তাদের নাগরিক মৌলিক চাহিদা অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা, বাসস্থান ও শিক্ষা ক্ষেত্রে সুযোগ-সুবিধা এত বেশি যে, ওই সব দেশের নাগরিকেরা ট্যাক্স ও ভ্যাট দিতে কার্পণ্যবোধ করে না। বাংলাদেশের মানুষ অতি সহিষ্ণু জাতি বললে ভুল হবে না। তারা সময় দিয়েছে ৪৮ বছর। এই ৪৮ বছর ধরে তারা শুধু শোষিত হচ্ছে। সেই সাথে গণতন্ত্র ধ্বংসস্তূপে পরিণত। আজকাল জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট প্রয়োজন পড়ে না। পৃথিবীর কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ভোট ছাড়া ক্ষমতায় আসা একটি বিরল ঘটনা। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটি উদাহরণ সৃষ্টি করল। এটাও এক ধরনের দুর্নীতি। ক্ষমতায় এসে রাস্তার মোড়ে মোড়ে বিলবোর্ড, সাইনবোর্ড এবং রঙিন কাগজের পোস্টার লাগিয়ে হাজার কোটি টাকার অপচয় করা হচ্ছে। এ টাকাও জনগণের। রাষ্ট্রের কোনো টাকা নেই। জনগণের টাকায় তাদের বিলাসবহুল জীবনযাপন পরিচালিত হয়। এ ধরনের অপচয় প্রতিনিয়ত হচ্ছে। এটা একটা বিশাল অঙ্কের দুর্নীতি। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭০, এই ২৩ বছরে যে দুর্নীতি হয়েছেÑ তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি দুর্নীতি হয়েছে স্বাধীনতা-উত্তর ৪৮ বছরে। দুর্নীতি নেই কোথাও। তার জায়মান উদাহরণ র্যাবের সাম্প্রতিক ক্ষমতাসীন নেতাদের দুর্নীতিবিরোধী অভিযান।

অনেক সময় শুনতে হয়Ñ দুর্নীতিও এক ধরনের উন্নয়ন। উন্নয়ন করতে হলে দুর্নীতি করতে হয়। কাজ করলে যেমন কাজ হয়, তেমনি দুর্নীতি করলেও কাজ হয়। একদিন পদ্মা সেতু খুলে দেয়া হবেÑ যার পেছনে ব্যাপক অঙ্কের দুর্নীতির কথা শোনা যায়।

টিআইবির রিপোর্ট (০৯-৯-১৯) জমি রেজিস্ট্রিতে ঘুষ লাগে ৫০০ টাকা থেকে পাঁচ লাখ টাকা। দলিল নিবন্ধনের জন্য প্রতিটি দলিলে দলিল লেখক সমিতিকে ৫০০ থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা বা ঘুষ দিতে হয়। এখন দলিল ও দুর্নীতি সমার্থক শব্দ হয়ে গেছে। এই সেবা খাতে ক্রমাগত দুর্নীতি বেড়েই চলছে। দেশব্যাপী কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া দেশের সব সাব-রেজিস্টার অফিসে ঘুষ লেনদেন স্বাভাবিক চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। ৯ সেপ্টেম্বর রাজধানীর ধানমন্ডির মাইডাস সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ভূমি দলিল নিবন্ধনে সেবায় সুশাসনের ঘাটতি ব্যাপক। এ খাত ব্যাপক দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। নাম জারি করতে গেলেও এসি ল্যান্ডকে মোটা অঙ্কের ঘুষ দিতে হয়। ভ্রাম্যমাণ আদালত খাদ্যে ভেজালবিরোধী অভিযানে জরিমানা করছে। এতে কি ভেজাল কমেছে? এ প্রশ্ন ভোক্তাদের। উত্তর মোটেও না। এটি একটি আইওয়াশ। রাজধানীতে কালো ধোঁয়ার আগ্রাসন এবং ভয়াবহ শব্দদূষণÑ এসব পরিবহনের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ঘুষের বিনিময়ে এসব পরিবহন দেদার নগরীতে চলছে। গরিব মানুষেরা এসব পরিবহনের যাত্রী। এ জন্যই কি তাদের প্রতি সুনজর দেয়া হচ্ছে না।

সড়ক পরিবহনে যে কী পরিমাণ দুর্নীতি হয় তা লিখে শেষ করা যাবে না। এখানে যাত্রীর সেবার নামে নারী নির্যাতন হচ্ছে। সিটিং সার্ভিসের নামে যাত্রীর পকেট কাটা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এ ছাড়া মানুষের জীবনও সড়কপথে নিরাপদ নয়। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, বাংলাদেশ পুলিশ বিভাগের তথ্য অনুসারে গত পাঁচ বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ১২ হাজার ৫৪ জন মানুষ। ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৯ পত্রিকায় হেডলাইন ছিলÑ পরিবহন খাতে রাতে ভয়ঙ্কর ছিনতাইকারী দিনে পরিবহন শ্রমিক। পুলিশ প্রশাসনও দুর্নীতির সাথে জড়িত। তারা যদি দুর্নীতি না করতেন তাহলে এত মানুষ প্রাণ হারাত না। উপযুক্ত শাস্তির বিধান না থাকার কারণে পরিবহন খাতে দুর্নীতি বাড়ছে বলে নগরবিদেরাও বলছেন। ভোলায় সড়ক ও জনপথের ২৪ কোটি টাকার কাজে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। নতুন করে দু’টি সেতু নির্মাণ, ৩৪টি বাঁক সরলীকরণ মিলে এসব কাজে যেন অনিয়মকে নিয়মে পরিণত করা হয়েছে।

যেনতেনভাবে কাজ শেষ করে ডিসেম্বরের (২০১৯) মধ্যে বিল তুলে নেয়ার প্রক্রিয়া শেষ হতে চলেছে (সূত্র : কালের কণ্ঠ, ০৯/৯/১৯) সাম্প্রতিক সময়ে এমন দু’টি ঘটনায় একজন পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন, আরেকজনের হয়েছে মৃত্যু। উল্লেখ্য, বেপরোয়া বাস ফুটপাথে উঠে যাওয়ার কারণে এসব দুর্ঘটনা ঘটছে। দেশে আর্থিক অব্যবস্থাপনার কারণে বেতন দিতে পারছে না ৫৯ পৌরসভা। পৌরসভার নিজস্ব আয়ের বড় অংশ আসে গৃহকর (হোল্ডিং ট্যাক্স) থেকে। ট্রেড লাইসেন্স প্রদান ও নবায়ন থেকেও উল্লেখযোগ্য রাজস্ব পায় পৌর কর্তৃপক্ষ। আয়ের আরেক বড় উৎস হাটবাজার ইজারা। পৌরসভার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনভাতাও হয় এ আয় থেকেই। আর্থিক দুর্নীতির কারণে অনেক পৌরসভা এসব উৎস থেকে কাক্সিক্ষত আয়বঞ্চিত হচ্ছে। আয় না থাকার কারণে বেতনও পাচ্ছেন না এসব পৌরসভার কর্মচারীরা। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় বেতনভাতা পরিশোধ না করতে পারা এমন ৫৯টি পৌরসভার তালিকা করেছে। সর্বনি¤œ ১০ মাস থেকে ৬৪ মাস পর্যন্ত কর্মচারীদের বেতন বকেয়া রেখেছে এসব পৌরসভা।

অর্থবছর ২০১৯-২০২৯ জুলাই-আগস্টে রফতানি কমেছে দশমিক ৯২ শতাংশ। এক বছরের ব্যবধানে চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্টে গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৬ কোটি ২৮ লাখ ৫০ হাজার ডলারের কম পণ্য রফতানি হয়েছে। রফতানিবাণিজ্য কমে যাওয়া মানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে টান পড়া। বণিক বার্তা ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৯ প্রথম পৃষ্ঠার লিড নিউজ ছিলÑ দশ মাসে বন্ধ ২০৯ শিল্প কারখানা। এসব প্রতিষ্ঠানে চাকরিচ্যুত শ্রমিকের সংখ্যা ১৯ হাজারেরও বেশি। গত ১০ মাসে সবচেয়ে বেশি কারখানা বন্ধ হয়েছে গাজীপুর এলাকায়। ২০১৯ সালের নভেম্বর থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত এ এলাকায় বন্ধ হয়েছে ১২৯টি কারখানা। এ ছাড়া আশুলিয়া শিল্প এলাকায় বন্ধ হয়েছে ৪৫টি, নারায়ণগঞ্জে ২৫টি, চট্টগ্রামে ৭ এবং ময়মনসিংহে একটি কারখানা। জানা গেছে, বন্ধ কারখানার বেশির ভাগই পোশাক শিল্পের। এর মধ্যে এমন অনেক কারখানা আছে, যেগুলোর ত্রুটি সংশোধনের পথ খোলা নেই। কারখানাগুলোতে এ কারণে ক্রেতারা ক্রয়াদেশ দিচ্ছেন না। ফলে ব্যবসাও করতে পারছেন না তারা। সংসদে রেলমন্ত্রী বলেছেন, রেলে আয়ের তুলনায় ব্যয় দ্বিগুণ। দুর্নীতি এখনো আছে। এরশাদ সরকারের ওষুধ নীতির কারণে বাংলাদেশ থেকে ফাইজার, গ্ল্যাক্সো, ফাইসন্স, স্কুইবসহ মোট ৯টি বৃহৎ ওষুধ শিল্প তাদের বিনিয়োগ গুটিয়ে ফেলে। এসব কোম্পানি ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কায় রয়েছে, তারা বিতাড়িত করেনি। বাংলাদেশ করেছে। শোনা যায়Ñ একটি বিরাট অঙ্কের দুর্নীতি হয়েছিল ওষুধ শিল্পে। ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিষয়টি জানেন। এরশাদ সরকারের আমলে ওষুধ নীতি ১৯৮২ ঘোষণার পর থেকে দেখা যায়, বিদেশী সব ওষুধ কোম্পানি দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। তখন ওষুধ শিল্পে একটি প্রতিযোগিতা ছিল। এখন যেভাবে ওষুধে ভেজাল পাওয়া যাচ্ছেÑ সেটা দুই দশক আগে আমরা চিন্তাও করতে পারিনি। যে কোম্পানিগুলো দেশ ছেড়ে চলে গেছেÑ তারা স্বেচ্ছায় যায়নি তাদের বিরুদ্ধে সক্রিয় ছিল বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত বড় বড় দেশীয় ওষুধ কোম্পানি। ওষুধ নীতি এখন কল্যাণ নয়, অকল্যাণে পরিণত হয়েছে। নকল ওষুধ এবং ভেজাল মিশ্রিত ওষুধে বাজার ছেয়ে গেছে। ওষুধের বাজার মিটফোর্ড ভারতীয় ওষুধে ছেয়ে গেছে। নকল ওষুধ দেদার বিক্রি হচ্ছে। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয় এমন ওষুধ বাজারে কম নয়। ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়াও ব্যথানাশক ও অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ বাজারে বিক্রি হচ্ছে। দুর্নীতির কারণে এসব অস্বাস্থ্যবান্ধব ওষুধ প্রতিটি ফার্মেসিতে চিরুনি অভিযান না চালালে তা প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলো থেকে বহু লোককে চাকরিচ্যুত করার কারণে বেকারের সংখ্যাও কম নয়।

পরিশেষে বলব, বাংলাদেশের আর্থিক খাত একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। দেশের খ্যাতিমান বিশেষজ্ঞরা এ খাতে সংস্কারের সুপারিশ করে আসছেন। অর্থমন্ত্রী বিভিন্ন সময়ে বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলেও কোনো পদক্ষেপ নেননি এখনো। স্বীকার করতেই হবে যে, প্রতি বছর জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে। খরচের সাথে সামঞ্জস্য বজায় রেখে একটি টাকাও করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো হয়নি। আমরা প্রত্যাশা করব, দেশের অর্থনীতির বিকাশ সাধনে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন অর্থনীতিতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। সরকার এ কাজটি করবে বলে প্রত্যাশা করি। হ
লেখক : গ্রন্থকার
বস:যধৎঁহধৎংযরফধৎ@মসধরষ.পড়স

http://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/443852/