২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯, রবিবার, ১২:৫৮

১৩ প্রতিষ্ঠানের লকার জব্দ

চার যুবলীগ নেতার ক্যাসিনো সংযোগ

ক্যাসিনো, টেন্ডারবাজিসহ নানা অপকর্মের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে আইনের আওতায় আসা যুবলীগের শীর্ষ পর্যায়ের চার নেতার ১৩ প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ব্যাংকের ভল্ট বা লকারে থাকা সম্পদও জব্দ করার নির্দেশ দিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল সিআইসি। এর আগেই নজরদারির মধ্যে আনা হয়েছে এ ১৩ প্রতিষ্ঠানের নামে থাকা সব ধরনের হিসাবকে। এসব প্রতিষ্ঠানের যেকোনো মেয়াদি আমানত (এফডিআর ও এসটিডি), মেয়াদি সঞ্চয়ী হিসাব, চলতি হিসাব, ফরেন কারেন্সি অ্যাকাউন্টে থাকা অর্থ, ক্রেডিট কার্ড, সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ, এসব ব্যক্তি ও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে থাকা যেকোনো ধরনের সেভিং ইনস্ট্রুমেন্ট বা ইনভেস্টমেন্ট স্কিম বা ডিপোজিটকে জব্দ করার জন্য আগে একটি চিঠি দেয়া হয়েছে। সিআইসির নতুন এক চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকগুলো লকারে থাকা সম্পদ জব্দের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া শুরু করেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।

সিআইসির চিঠির বরাত দিয়ে দেশের প্রথম প্রজন্মের একটি ব্যাংকের শীর্ষ ব্যাংকার জানিয়েছেন, চার নেতার ১৩ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে যুবলীগ নেতা ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান রয়েছে তিনটি, জি কে শামীমের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান রয়েছে দুইটি, খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান আছে একটি আর নুরুন্নœবী চৌধুরী শাওনের নিজের ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান রয়েছে সাতটি।

যেসব সম্পদ জব্দের নির্দেশ দেয়া হয়েছে : সিআইসির চিঠিতে ১৩ প্রতিষ্ঠানের সম্পদ জব্দ করার তালিকার মধ্যে রয়েছে ব্যাংকের লকারে থাকা যেকোনো সম্পদ, যেকোনো মেয়াদি আমানত (এফডিআর ও এসটিডি), মেয়াদি সঞ্চয়ী হিসাব, চলতি হিসাব, ফরেন কারেন্সি অ্যাকাউন্টে থাকা অর্থ, ক্রেডিট কার্ড ও সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ। এর বাইরে এসব ব্যক্তি ও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে যেকোনো ধরনের সেভিং ইনস্ট্রুমেন্ট বা ইনভেস্টমেন্ট স্কিম বা ডিপোজিট থাকলে তাও জব্দ করতে বলা হয়েছে।

১৩ প্রতিষ্ঠান : ১৩ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান তিনটি হলোÑ মেসার্স শারমিন এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স হিজ মুভিজ ও প্রিন্সিপেল রিয়েল এস্টেট। এর মধ্যে মেসার্স শারমিন এন্টারপ্রাইজ প্রতিষ্ঠানটির প্রোপাইটর ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটের স্ত্রী শারমিন চৌধুরী আর মেসার্স হিজ মুভিজের স্বত্বাধিকারী ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট নিজে। তবে প্রিন্সিপাল রিয়েল এস্টেটের মালিক কে তার উল্লেখ নেই। জি কে শামীমের দুই প্রতিষ্ঠান হলো মেসার্স জি কে বিল্ডার্স ও জি কে বি অ্যান্ড কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড। জি কে বিল্ডার্সের প্রোপাইটর জি কে শামীম নিজেই। আর জি কে বি অ্যান্ড কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেডের কোনো মালিকের নাম উল্লেখ করা হয়নি। তবে টিআইএন দেয়া আছে-৩৭৮০৭০১৬৩২৪৫। অপর দিকে যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার প্রতিষ্ঠানটির নাম হলো মেসার্স অর্পণ প্রোপার্টিজ। প্রতিষ্ঠানটির মালিকানায় রয়েছেন খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া নিজেই। আর নুরুন্নবী চৌধুরী শাওনের সাতটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে মেসার্স নাওয়াল কনস্ট্রাকশন ও মেসার্স আয়েশা ট্রেডার্স। প্রতিষ্ঠান দুইটির মালিকের নাম উল্লেখ নেই। তবে উভয় প্রতিষ্ঠানের টিআইএন নম্বর-৩৬০২২৫৬৯২৪০৯। মেসার্স নাওয়াল কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড বিদ্যা নিকেতন প্রি-ক্যাডেট স্কুলের প্রোপাইটর নুরুন্নবী চৌধুরী নিজেই। এ ছাড়া নাওয়াল কনস্ট্রাকশন নামের আরো একটি প্রতিষ্ঠানের কোনো ঠিকানা উল্লেখ নেই, তবে টিআইএন নম্বর দেয়া আছে ১৫৯৪৪১৬৩৮৯৬৫। মেসার্স ফারজানা বুটিকের প্রোপাইটর ফারজানা চৌধুরী এবং মেসার্স ইনটিশার ফিশারিজ ও মেসার্স ডিজিটাল টেকের প্রোপাইটরের জায়গায় নুরুন্নবীর চৌধুরীর নাম উল্লেখ রয়েছে। ব্যাংকারেরা জানিয়েছেন, এসব প্রতিষ্ঠান নুরুন্নবী চৌধুরী ও তার স্ত্রী ফারজানা চৌধুরীর স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান।

সংশ্লিষ্ট এক ব্যাংকার বৃহস্পতিবার নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, বিভিন্ন সময় সিআইসি থেকে ব্যাংকগুলোতে চিঠি পাঠাচ্ছে। আলোচিত চার নেতার ১৩ প্রতিষ্ঠানের সম্পদের খোঁজে চিঠি পাঠায় ২৩ ও ২৪ সেপ্টেম্বর। চিঠিতে বলা হয়, আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪-এর ১১৩(এফ) ধারা মোতাবেক ২০১২ সালের ১ জুলাই থেকে গত ২৩ ও ২৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আলোচ্য প্রতিষ্ঠানগুলোর লেনদেনের সব ধরনের তথ্য সিআইসির কাছে পাঠাতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দেয়া হলো। আর আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪-এর ১১৬ এ মোতাবেক আলোচ্য ১৩ প্রতিষ্ঠান ও চার নেতার নামে বেনামে থাকা সব ধরনের সম্পদ ব্যাংক থেকে উত্তোলন করতে না পারে অর্থাৎ এসব অ্যাকাউন্ট স্থগিত করার নির্দেশ দেয়া হয়। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে জরুরি ভিত্তিতে সিআইসিকে অবহিত করতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দেয়া হয়।

প্রসঙ্গত, ক্যাসিনো, জুয়া, টেন্ডারবাজিসহ অসামাজিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে চলমান অভিযানের অংশ হিসেবে এর আগে রথ্যাব সদস্যরা জি কে শামীমকে আইনের আওতায় আনেন। একই সাথে তার ব্যক্তিগত কার্যালয়ে হানা দিয়ে তাকে ও তার সাত দেহরক্ষীকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর সেখান থেকে এক কোটি ৮০ লাখ টাকা, ১৬৫ কোটি টাকার স্থায়ী আমানতের (এফডিআর) কাগজপত্র (তার মায়ের নামে ১৪০ কোটি), ৯ হাজার ইউএস ডলার, ৭৫২ সিঙ্গাপুরি ডলার, একটি আগ্নেয়াস্ত্র এবং মদের বোতল জব্দ করে রথ্যাব। অস্ত্র ও মাদক মামলায় জি কে শামীম এখন ১০ দিনের রিমান্ডে আছেন।

এর আগে বুধবার অবৈধ অস্ত্র ও ইয়াবা রাখার অপরাধে আরেক যুবলীগ নেতা খালেদকে গ্রেফতার করে র্যাব। পরদিন তার বিরুদ্ধে অস্ত্র, মাদক ও মানিলন্ডারিং মামলা করা হয়। এর মধ্যে মাদক ও অস্ত্র মামলায় সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, চলমান অভিযানে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ও সামাজিক মাধ্যমে যাদের নাম বিভিন্ন অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িত থাকার অভিযোগ আসছে তাদের বিষয়েই সতর্ক দৃষ্টি রাখা হচ্ছে। ব্যাংকগুলোতে থাকা অর্থ ও সম্পদ উত্তোলন বা স্থানান্তর করতে না পারে সে বিষয়ে খেয়াল রাখা হচ্ছে। এমন প্রায় শতাধিক ব্যক্তি ও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান রয়েছে বলে ওই সূত্র জানিয়েছে।

http://www.dailynayadiganta.com/first-page/443889/