২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯, শনিবার, ১২:৫৫

দিনে চাঁদা কোটি টাকা

রাজধানীজুড়ে নিষিদ্ধ ইজিবাইক সিন্ডিকেট

বহু বছর ধরে নিষিদ্ধ ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক ও রিকশায় ঢাকাসহ সারাদেশই সয়লাব। ঢাকায় এসব চলাচলের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা থাকায় গড়ে উঠেছে চাঁদাবাজ সিন্ডিকেট। ক্ষমতাসীন দলের আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতারা এই সিন্ডিকেটের হোতা। তারা প্রতিদিন কোটি টাকা চাঁদা তুলছে। এই চাঁদার টাকায় অনেকেই বাড়ি-গাড়ির মালিক বনে গেছেন। এই সিন্ডিকেটের বদৌলতে বিদ্যুতের এক শ্রেণির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও পুলিশের পেটেও যাচ্ছে লাখ লাখ টাকা। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বার বার নিষিদ্ধ এসব যান বন্ধ করার কথা বলা হলেও বাস্তবে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। এতে দিন দিন এসব যানের সংখ্যা বাড়ছেই। বাড়ছে দুর্ঘটনা, প্রাণহানি। সাথে পরিবহন সেক্টরের বিশৃঙ্খলাতো আছেই। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গতকাল শুক্রবারও সিলেটে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, করিমন, নসিমনসহ তিন চাকার কোনো যানবাহন মহাসড়কে চলতে পারবে না। তিনি বলেন, এ সব যানবাহনের আমদানি বন্ধে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হয়েছে। নম্বরবিহীন সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলাচল বন্ধে প্রশাসনকে আগে থেকেই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে মন্ত্রী বহুবার এসব যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধের কথা বললেন। শুধু তাই নয়, এর আগে ২০১৭ সালে আইন করে মহাসড়কে এসব যান চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়। হাইকোর্টও এক আদেশে এসব যান চলাচল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে পুলিশকে কিছু নির্দেশনা দেয়। কিন্তু কোনো নিষেধাজ্ঞাই কার্যকর হয়নি। সিন্ডিকেটের কারণে বরাবরই ভেস্তে গেছে সরকারের উদ্যোগ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ব্যটারিচালিত ইজিবাইক ও রিকশার দাপট আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। প্রতিদিনই রাস্তায় নামছে এসব নিষিদ্ধ যানবাহন। ঢাকার কদমতলী, শ্যামপুর, ডেমরা, যাত্রাবাড়ী, মিরপুর, পল্লবী, শাহআলী, উত্তরখান, দক্ষিণখান, তুরাগ, মানিকদী, বাড্ডা, রামপুরা, সবুজবাগ এলাকায় এসব যানবাহন প্রকাশ্যেই চলাচল করে। এর বাইরে ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-মাওয়া, ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে চলাচল তো আছেই। অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীর কদমতলী থানা এলাকাতেই আছে তিন হাজারেরও বেশি ব্যটারীচালিত ইজিবাইক ও রিকশা। স্থানীয় সরকারদলীয় প্রভাবশালী নেতা ও থানা পুলিশকে ম্যানেজ করে চলছে এসব নিষিদ্ধ যান। আলাপকালে ভুক্তভোগিরা জানান, ব্যটারিচালিত যানের ভিড় এতোটাই বেড়েছে যে এখন রাস্তা দিয়ে হাঁটাই যায় না।

রাজধানীর প্রতিটি থানা এলাকার অলি-গলিতে এখন ব্যাটারীচালিত ইজিবাইক ও মোটরচালিত রিকশার ছড়াছড়ি। এগুলো চলাচলে বাধা দেয়ার উপায় নেই। কারণ এর নেপথ্যে আছে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতারা। আছে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ। নগরীর শ্যামপুর, কদমতলী ও যাত্রাবাড়ী এলাকায় হাজার হাজার ইজিবাইক ও মোটরচালিক রিকশার পরিচালনার নেপথ্যে রয়েছে স্থানীয় নেতা ও প্রভাবশালীরা। কদমতলী থানা এলাকায় ইজিবাইকের বেশ কয়েকটি রুটের মধ্যে রায়েরবাগ ও মোহাম্মদবাগ রুটে চলাচল করে তিন শতাধিক ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশা। রায়েরবাগের এই রুট নিয়ন্ত্রণ করে জাহাঙ্গীর নামে এক ব্যক্তি। মোহাম্মদবাগে নিয়ন্ত্রণ করে লিটন ও তার দুই ভাই। প্রতিদিন এখানে ইজিবাইক প্রতি ৫০ টাকা রিকশা প্রতি ২০ টাকা হারে চাঁদা তোলা হয়। এলাকাবাসীর হিসাব মতে, শুধু এই দুই রুট থেকেই মাসে সাড়ে তিন লাখ টাকা চাঁদা ওঠে। এছাড়া বড়ইতলা থেকে বিক্রমপুর প্লাজা, পোস্তগোলা থেকে পাগলা, ধোলাইরপাড় থেকে শনিরআখড়া, জুরাইন মেইন রাস্তা থেকে মুরাদপুর হয়ে কোদারবাজার পর্যন্ত আছে একটি করে রুট। প্রতিটি ইজিবাইক থেকে প্রতিদিন দেড়শ’ টাকা করে চাঁদা তোলা হয়। অনুসন্ধানে জানা গেছে, সহস্রাধিক ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশার ব্যাটারির চার্জ দেয়ার জন্য মুরাদপুর এলাকাতেই আছে কয়েকটি গ্যারেজ। যেগুলোতে অবৈধ বিদ্যুতের সংযোগ নেয়া আছে বিদ্যুত বিভাগের স্থানীয় প্রকৌশলীতে ম্যানেজ করে। স্থানীয়রা জানান, এই এলাকায় বিদ্যুত চুরির নেপথ্যে নাসির ও তার সিন্ডিকেটের লোকজন। ব্যাটারিচালিত রিকশা তৈরী করা হয় পাটেরবাগ, দনিয়া, রায়েরবাগ, ডেমরা, কাজলা, ভাঙ্গাপ্রেসসহ বিভিন্ন এলাকায়। দনিয়া এলাকায় চলাচলকারি আড়াইশ ইজিবাইক ও রিকশার চাঁদা তোলে মরণ নামে একজন। প্রভাবশালীদের হয়ে সে চাঁদার টাকা তোলে। সেখান থেকে মোটা অঙ্ক যায় থানায়।

অন্যদিকে, নগরীর মিরপুর ১০ নং গোলচক্কর থেকে ইজিবাইক,প্রাইভেট সিএনজি ও চ্যাম্পিয়ন নামের কিছু বাস চলাচল করে। ১৫০ টাকা থেকে শুরু করে প্রতিদিন ৪০০ টাকা হারে চাঁদা দিয়ে চলছে এসব অবৈধ যানবাহন। স্থানীয় যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতারা এসব অবৈধ যান থেকে চাঁদা তোলে। স্থানীয়রা জানান, এই এলাকায় ৩ শতাধিক যান চলাচল করে। এর মধ্যে কিছু চলে ১০ নং গোলচক্কর থেকে মিরপুর ১৪ হয়ে ভাষানটেক এবং কিছু মিরপুর ১৪ হয়ে কচুক্ষেত পর্যন্ত চলাচল করে। এ ছাড়া শতাধিক প্রাইভেট সিএনজি ও চ্যাম্পিয়ন বাস রুট পারমিট ও চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়াই চলাচল করে। মিরপুর ১১ নং সেকশনের পল্লবী মিডটাউন শপিং মলের সামনে থেকে রূপনগর আবাসিক এলাকা পর্যন্ত চলাচল করে প্রায় একশ’ ইজিবাইক। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করেন স্থানীয় সরকারদলীয় কয়েকজন নেতা। মিরপুর ১ নম্বর থেকে আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় চলে ১০০-১৫০টি ইজিবাইক। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করেন স্থানীয় শ্রমিক লীগ নেতা দেলোয়ার হোসেন। তার নিয়োগকৃত লাইনম্যানরা প্রত্যেক ইজিবাইক থেকে টাকা আদায় করে।

ঢাকা বিমানবন্দর রেলস্টেশনের পাশে আশকোনা এলাকায় কয়েকশ’ ইজিবাইক চলাচল করছে। স্থানীয়দের মতে, এখানে ইজিবাইকের সংখ্যা ৬ শতাধিক ছাড়িয়ে গেছে। বিমানবন্দর রেল ক্রসিং থেকে আশকোনা হয়ে বউড়া ও হলান পর্যন্ত চলাচল করে আড়াইশ ইজিবাইক। বিমানবন্দর রেল ক্রসিং থেকে দক্ষিণখান ও কাঁচকুড়া পর্যন্ত চলাচল করে প্রায় সাড়ে ৩শ’। এই এলাকায় ইজিবাইক চালানোর জন্য প্রতিদিন ১৫০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। স্থানীয়রা জানান, নিষিদ্ধ এ যানগুলো মাঝে মধ্যেই উত্তরার প্রধান সড়কে উঠে যায়। পুলিশকে টাকা দিয়ে চলাচল করে বলে এরা প্রধান সড়কে উঠতেও দ্বিধা করে না। চালকরা জানান, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ইমরানের লোকজন এই টাকা তোলে। চালকরা জানান, এই এলাকায় ইজিবাইক নামানোর সময় ১৬শ’ টাকা করে দিতে হয়। রামপুরা টিভি সেন্টারের কাছ থেকে বনশ্রী হয়ে সিপাহীবাগ চলাচল করে শতাধিক ইজিবাইক। এ ছাড়া বেশ কিছু লেগুনা চলাচল করে। যেগুলোর কোনো বৈধ কাগজপত্র নেই এবং সেগুলোর ফিটনেসও নেই। লেগুনাগুলো রামপুরা টিভি সেন্টারের কাছ থেকে বনশ্রী হয়ে মাদারটেক প্রজেক্টের মুখ পর্যন্ত যায়। একজন ইজিবাইক চালক জানান, বাইক চলাচলের জন্য তারা প্রতিদিন ৫০ টাকা করে দেন। এ টাকা নেয় সিপাহীবাগের এক নেতা। এ ছাড়া তারা মাসে ২০০ টাকা করে ট্রাফিক পুলিশকে দিতে হয়। সবুজবাগ থানার খিলগাঁও বিশ্বরোড থেকে বাসাবো হয়ে মাদারটেক, নন্দীপাড়া ব্রিজ পর্যন্ত প্রায় দেড়শ’ ইজিবাইক চলাচল করে। প্রত্যেকটি ইজিবাইক থেকে প্রতিদিন ৫০ টাকা করে চাঁদা দিতে হয়। পরিবহন শ্রমিক নেতারাই স্বীকার করেছেন, গোটা রাজধানীতে ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশা থেকে দিনে কোটি টাকা চাঁদাবাজি হচ্ছে। এই চাঁদার টাকার ভাগ অনেকেই পায়। যে কারণে সরকার বার বার উদ্যোগ নেয়ার পরেও এগুলো বন্ধ হচ্ছে না।

 

https://www.dailyinqilab.com/article/237259