পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়
২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯, শনিবার, ১২:৩৯

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়: বিচারহীনতায় পিছু ছাড়ছে না অনিয়ম-দুর্নীতি

দোষী সাব্যস্ত হলেও সর্বোচ্চ শাস্তি অপসারণ, কখনও তাও হয় না * ইউজিসির তদন্তে ১০ আর্থিক অনিয়ম চিহ্নিত * আমরা সুপারিশ করি, ব্যবস্থা নেয়ার এখতিয়ার নেই -ইউজিসি চেয়ারম্যান

দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ভিসি বড় ধরনের অনিয়ম, দুর্নীতি বা অপকর্ম করলেও তাদের ফৌজদারি মামলা বা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির মুখোমুখি হতে হয় না। তবে কারও বিরুদ্ধে যদি অভিযোগের পাহাড় জমে, সেক্ষেত্রে গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি। কমিটির কাছে অভিযোগ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে দুর্নীতিবাজ ভিসিকে পদচ্যুত বা অপসারণ করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে সেটিও হয় না। ফলে অপকর্ম করেও নির্বিঘ্নে পার পেয়ে যাচ্ছেন সংশ্লিষ্ট ভিসিরা। এক্ষেত্রে বিচারহীনতা যেন স্থায়ী সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে।

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে অনিয়ম-দুর্নীতি পিছু ছাড়ছে না অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভিসি (ভাইস চ্যান্সেলর বা উপাচার্য) অপসারণ করা হলেও নতুন যিনি আসেন তিনিও সাবেকের দেখানো পথ অনুসরণ করেন। এই মুহূর্তে বিভিন্ন অনিয়মের ইস্যু নিয়ে অস্থিরতা চলছে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বিরুদ্ধে অনিয়ম করে শিক্ষার্থী ভর্তি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বিরুদ্ধে কমিশন ভাগাভাগি এবং গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে ছাত্র আন্দোলন গড়ে উঠেছে। আন্দোলনের মুখে ইতিমধ্যে গোপালগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করতে হয়েছে।

জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কাজী শহীদুল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, ভিসিদের ব্যাপারে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে সরকারি নির্দেশে আমরা তদন্ত করি। তবে আমরা নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ নই। ব্যবস্থা নেয়ার এখতিয়ারও আমাদের নেই। তাই আমরা কেবল সুপারিশ করে থাকি। দুর্নীতি-অনিয়মের কারণে অনেক সময় ভিসিদের অপসারণ করা হয়। তবে চাকরিচ্যুতি বা অন্য আইনি ব্যবস্থা নেয়ার নজির তেমন একটা নেই যে তা বলা যাবে না। কেননা রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি আবদুল জলিল মণ্ডলকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল। তবে আইনি ব্যবস্থার জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনে মামলাসহ অন্য ব্যবস্থা নেয়া দরকার।

জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. সোহরাব হোসাইন যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরা চাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আদর্শ প্রতিষ্ঠানরূপে গড়ে উঠুক। এ কারণে ভালো লোক দেখেই ভিসি নিয়োগ করা হয়। কিন্তু এরপরও বিভিন্ন অভিযোগ ওঠে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে চ্যান্সেলর হিসেবে মহামান্য রাষ্ট্রপতি ব্যবস্থা নেন। তবে স্বআইনে চলার কারণে অনেক সময় ব্যবস্থা নেয়া যায় না।’ তিনি আরও বলেন, তবে এটাও ঠিক যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা রাজনীতি আছে। তাই উত্থাপিত সব অভিযোগ সব সময় সঠিক হয় না।

দেশে বর্তমানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ৪৬টি। এগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ অনেক পুরনো। ইউজিসির সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দাখিল করা এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অডিট করার সময় সংস্থাটি ১০ ধরনের অনিয়ম পেয়েছে।

সেগুলো হচ্ছে, পূর্বানুমতি ছাড়া নতুন বিভাগ খোলা, অনুমোদন ছাড়াই বিজ্ঞপ্তির অতিরিক্ত জনবল নিয়োগ, এক খাতের টাকা অন্য খাতে ব্যয়, টেন্ডার ছাড়া কেনাকাটা, উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন প্রকল্পের (হেকেপ) টাকা লুটপাট, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বিভাগ, হলসহ বিভিন্ন পর্যায়ে নানা খাতে ফি আদায়, আদায় করা ফির সামান্য অংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে জমা দিয়ে বেশির ভাগই শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিজেদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা, নিজস্ব আয় গোপন, আবাসিক শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিধিবহির্ভূতভাবে বাড়িভাড়া ও ভাতা দেয়া, উচ্চতর ডিগ্রির জন্য ইনক্রিমেন্ট প্রদান এবং ইনক্রিমেন্টের ওপর ভিত্তি করে মহার্ঘ ভাতা, বিনোদন ও পেনশন প্রদান। এসব অনিয়মের ব্যাপারে ইউজিসি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে একাধিকবার চিঠি দিলেও ব্যবস্থা নেয়নি কর্তৃপক্ষ। তাই প্রশাসনিক ব্যবস্থার সুপারিশ করে গত সপ্তাহের শুরুতে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়া হয়।

খোদ ইউজিসি চেয়ারম্যান জানিয়েছেন, নানান ধরনের অভিযোগ ওঠায় বর্তমানে ১৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির ব্যাপারে তদন্ত চলছে। এর মধ্যে বর্তমানে অস্থিরতা বিরাজ করা গোপালগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে আগে থেকেই তদন্ত হচ্ছে। ইতিমধ্যে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি সরেজমিন পরিদর্শন করেছে। এছাড়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও কয়েকটির ব্যাপারে উত্থাপিত নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত কার্যক্রম চলমান।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে একের পর এক নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। এসব অভিযোগের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- বিভিন্ন পদে নিয়োগ, পদায়ন ও আপগ্রেডেশনে নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করা। অবিশ্বাস্য গতিতে একই দিনে মৌখিক পরীক্ষার চিঠি ইস্যু, পরীক্ষা গ্রহণ এমনকি যোগদানের মতো ঘটনাও ঘটেছে। গত ঈদের ছুটি শুরুর পর দেয়া হয়েছে গণনিয়োগ। এসব নিয়ে শিক্ষক-কর্মচারীদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে। এ বিষয়ে ভিসি অধ্যাপক ড. মো. আলাউদ্দিন ২৩ আগস্ট যুগান্তরকে বলেন, আমি কাজে যোগদানের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নতি ঘটেছে। আর কিছু না পেয়ে কিছু লোক ইস্যু তৈরির চেষ্টা করছে।

একইভাবে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে নিয়োগে অনিয়ম, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আবুল কাশেমের বিরুদ্ধে নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদায়নে অনিয়ম, ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আহসান উল্লাহর বিরুদ্ধে প্রভাষক নিয়োগ ইস্যুতে নৈতিক স্খলনের অভিযোগ তদন্ত করছে ইউজিসি।

এছাড়া ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ সংক্রান্ত অনিয়মের অভিযোগও তদন্ত হচ্ছে। পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (পাবিপ্রবি) ভিসি অধ্যাপক ড. এম রোস্তম আলীর বিরুদ্ধে নিয়মনীতি ভঙ্গ করে আপন ভাগ্নেসহ ২২ জন নিকট-আত্মীয়কে চাকরি দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) ভিসির বিরুদ্ধে বেনামে একটি দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হয়েছে। যেটি ইউজিসিতে জমা পড়েছে।

সাবেক ভিসিদের মধ্যে বরিশালের প্রথম ভিসি অধ্যাপক হারুনর রশিদ খান ও অধ্যাপক এসএম ইমামুল হক, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অহিদুজ্জামানের বিরুদ্ধেও তদন্ত চলছে। এর আগে কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ও শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ভিসির বিরুদ্ধে নিয়োগসহ বিভিন্ন আর্থিক অভিযোগ তদন্ত করে ইউজিসি। পৃথক দুই কমিটির প্রতিবেদনেই দুই ভিসিকে সরিয়ে দেয়া সুপারিশ করা হয়। ২০০৯ সালের পর রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসিদের বিরুদ্ধে নানা দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। এগুলোর মধ্যে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক আবদুল জলিল মণ্ডল ও ইবির ভিসি অধ্যাপক আবদুল হাকিমকে অপসারণ করা হয়েছিল।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট (২০০১-২০০৬) সরকারের আমলে বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বিরুদ্ধে সীমাহীন নিয়োগ বাণিজ্য, গণনিয়োগ, আর্থিক কেলেঙ্কারিসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, মাওলানা ভাসানী, পটুয়াখালী, নোয়াখালী, কুমিল্লাসহ ৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির ব্যাপক অভিযোগ ওঠে।

ইউজিসির তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হলে ২০০৭ সালের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সংশ্লিষ্ট ভিসিদের অপসারণ করা হয়। এর মধ্যে কেবল ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বিরুদ্ধে দুদক একটি মামলা করেছিল। কিন্তু সেই মামলার ভবিষ্যৎ জানা যায়নি। ২০০৯ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্নীতির শ্বেতপত্র তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চিঠি দেয়ার মধ্যেই সেই উদ্যোগ সীমাবদ্ধ থাকে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/225796/