২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ৫:২০

পাঁচ বছর ধরে গেণ্ডারিয়ার আতঙ্ক তিন ভাই

জুয়ার টাকায় ১৫ বাড়ি

আটটি বিলাসবহুল গাড়ি ব্যবহার করেন পরিবারের সদস্যরা * নিজস্ব ক্যাডাররা মহড়া দেয় গাড়ির হর্ন বাজিয়ে * চারজনের বিরুদ্ধে ৫ মামলা * তিন ভাই স্থানীয় আ’লীগের নেতা

পুরান ঢাকার মূর্তিমান আতঙ্ক রশিদ, এনু ও রুপন তিন ভাই। গত পাঁচ বছরে গেণ্ডারিয়ার দক্ষিণ মৈসুন্দি এলাকার টিনশেডের একটি বাড়ি থেকে ১৫টি বহুতল বাড়ির মালিক হয়েছেন তারা। রাজধানীর গেণ্ডারিয়া এবং ওয়ারীসহ বিভিন্ন এলাকায় কিনেছেন এসব বাড়ি ও ফ্ল্যাট ।

আটটি বিলাসবহুল গাড়ি ব্যবহার করেন তাদের পরিবারের সদস্যরা। ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের জুয়া-ক্যাসিনো থেকে আয়ের কোটি কোটি টাকা দিয়েই এসব হয়েছে। এলাকাতেই গড়ে তুলেছেন ক্লাব। এখানেও জুয়া খেলা হয় বলে অভিযোগ উঠেছে।

জোর করে ভয় দেখিয়ে নাম মাত্র মূল্যে জমি লিখে নেয়ার অভিযোগও আছে ভাইদের বিরুদ্ধে। তারা ক্যাডার দিয়ে গড়ে তুলেছেন নিজস্ব বাহিনী। নিয়মিতভাবে এলাকায় গাড়ির হর্ণ বাজিয়ে মহড়া দেয় বাহিনীর সদস্যরা। এসব কারণে কেউ তাদের সামনে দাঁড়ানোর সাহস পায়নি।

ভয়ে কেউ মুখও খোলেনি। কিন্তু গত মঙ্গলবারের পর থেকে ধীরে হলেও অবস্থা পাল্টাতে শুরু করেছে। এদিন তাদের বাড়িতে র‌্যাবের অভিযানের পর আত্মগোপনে চলে গেছেন তিন ভাই। এ সুযোগে মানুষ মুখ খুলতে শুরু করেছে।

মঙ্গলবার সকাল ১০টা থেকে এনু, রুপন, তাদের এক কর্মচারী এবং বন্ধুর বাসায় র‌্যাব অভিযান চালিয়ে ৫ কোটি টাকা, ৮ কেজি স্বর্ণ, ৬টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করেছে।

এ ঘটনায় বুধবার পাঁচটি মামলা দায়ের হয়েছে। র‌্যাব-৩ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাফিউল্লাহ বুলবুল জানান, এনামুল হক এনুর কর্মচারী আবুল কালামের বিরুদ্ধে ওয়ারী থানায় মানি লন্ডারিং ও অস্ত্র আইনে দুটি মামলা (নং ৩৩ ও ৩৪) দায়ের করা হয়।

এদিকে গেণ্ডারিয়া থানায় এনুর বন্ধু হারুন অর রশিদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে একটি মামলা (নং ২৮) হয়েছে। রাতেই অস্ত্র ও মানি লন্ডারিং আইনে এনু ও রুপনের বিরুদ্ধে দুটি মামলা দায়ের হয়েছে।

র‌্যাবের অভিযানের পর দেখা গেছে বাড়িতে ব্যাংকের মতো ভল্ট বানিয়ে তাতে রাখা হয়েছে কোটি কোটি টাকা। কেজি কেজি স্বর্ণ। নিজ বাড়ির ভল্ট উপচে পড়ায় টাকা রেখেছেন কর্মচারী এবং বন্ধুর বাড়িতে।

তিন বাড়ি থেকে নানা ধরনের আগ্নেয়াস্ত্রও উদ্ধার করা হয়েছে। এসব কিছুর পেছনে ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের ক্যাসিনোর টাকা। ক্যাসিনো-জুয়ার বোর্ডের অংশীদার হিসেবে পেয়েছেন কোটি কোটি টাকা।

এ টাকাতেই তাদের গাড়ি-বাড়ি শানশওকত। এনু ও রুপন এবং তাদের দুই সহযোগীর বাড়িতে র‌্যাবের অভিযানের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের স্থাবর সম্পদের বিষয়ে সন্ধান শুরু করলে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য।

এনু-রুপনদের দৃশ্যমান কোনো পেশার তথ্য দিতে পারেনি স্থানীয়রা।

র‌্যাব-৩ এর অধিনায়ক শাফিউল্লাহ বুলবুল যুগান্তরকে বলেন, এখন পর্যন্ত অনুসন্ধানে এনু ও রুপনের ১৫টি বাড়ির বিষয়ে তথ্য পাওয়া গেছে। এগুলোর বিষয়ে খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে তাদের আরও বাড়ি আছে কিনা সে বিষয়ে খোঁজখবর চলছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, সিরাজের পুরো পরিবারই জুয়াড়ি। তাদের বাবার নাম সিরাজুল ইসলাম ওরফে সিরাজ। তিনি ভবঘুরে ছিলেন। একসময় জুয়ার বোর্ড চালাতেন। বাবার পথ ধরেই তিন ছেলে জুয়ার সঙ্গে জড়ায়।

এরই ধারাবাহিকতায় এখন তারা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের ক্যাসিনো পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তাদের পুরো পরিবারকেই এলাকায় জুয়াড়ি পরিবার হিসেবে চেনে। স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, এনু-রুপন নিজ এলাকাতেও ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেছেন।

সেখানেও জুয়ার আসর বসত। ক্যাসিনোর টাকার গরমে তারা হাতিয়ে নিয়েছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ পদ-পদবিও। শুধু তারাই নন, তাদের সহযোগীদেরও যুক্ত করেছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ পদে।

আর ক্যাসিনোর কোটি কোটি টাকা হালাল করেছেন স্বর্ণ, জমি, ফ্ল্যাট এবং বাড়ি করে। এছাড়া বিদেশ থেকে নানা ধরনের পণ্য আমদানির ব্যবসা আছে বলে প্রচারের চেষ্টা করেছেন। সরেজমিন এনু রুপন স্টিল হাউস নামে সাইনবোর্ড ঝুলানো একটি দোকানও দেখা গেছে।

পুরান ঢাকার একাধিক ব্যক্তি বুধবার যুগান্তরকে বলেন, শুধু গেণ্ডারিয়া ও নারিন্দায় এনু, রুপন ও রশিদের ১৫টি বাড়ি রয়েছে। অভিযানের পরপরই এসব বাড়ির হোল্ডিং নম্বর তুলে ফেলা হচ্ছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি রয়েছে নির্মাণাধীন।

আর কয়েকটির নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে ৬ মাস থেকে ১ বছরের মধ্যে। কোনোটি ৬ তলা, কোনো কোনোটি ১০ তলা বাড়ি।

স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধি যুগান্তরকে বলেন, জুয়াড়ি সিরাজের পরিবার কখনও আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সংশ্লিষ্ট ছিল না। এদের সাদেক হোসেন খোকার ক্যাডার হিসেবেই চিনতেন এলাকার লোকজন।

সিরাজ প্রায় ৩০ বছর ধরে জুয়ার আড্ডা চালাতেন পুরান ঢাকার বিভিন্ন স্থানে। সিরাজের ছেলেদের মধ্যে ছোট ছেলে ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।

গেণ্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, এনু, রশিদ ও রুপন তিন সহোদর দীর্ঘদিন ধরে ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে ক্যাসিনো পরিচালনা করে আসছেন। ক্যাসিনো পরিচালনার আগে তারা বিভিন্ন এলাকায় জুয়ার বোর্ড বসিয়ে অর্থ কামিয়েছেন।

এরপর শুরু করেন ওয়ান-টেন নামে জুয়াবাণিজ্য। তারপর ক্লাবের সঙ্গে জড়ান। স্থানীয়দের কাছে জুয়াড়ি ছাড়া তাদের আর কোনো পেশা নেই।

এলাকার একাধিক বাসিন্দা জানিয়েছেন- বানিয়ানগর, মুরগিটোলা, দয়াগঞ্জ নতুন রাস্তার মোড়ে এনু ও রুপনদের ছয়তলা বাড়ি আছে। নতুন এ বাড়ির প্রথম তিনতলা রুপনের, পরের তিনটি এনুর। দামি আসবাবে ঘর সাজানো হলেও তারা কেউই এ বাসায় থাকেন না।

তারা থাকেন পুরান ঢাকার লালমোহন সাহা স্ট্রিটের ১০৬ নম্বর হোল্ডিংয়ের বাড়িতে। তবে সেখানে গিয়ে প্রধান ফটক তালাবদ্ধ পাওয়া যায়। বাড়ির নিচতলার প্রধান ফটক ও তার ভেতরের যতটা দেখা যায় তাতে জৌলুসের ছাপ স্পষ্ট।

অনেক ডাকাডাকি করেও বাড়ির ভেতর থেকে কারও সাড়া মেলেনি। মুরগিটোলার ছয়তলা বাড়িতে ঢুকেই দোতলায় একজনের সঙ্গে কথা হলে তিনি নিজেকে ভাড়াটিয়া হিসেবে দাবি করেন।

তিনি জানান, বাড়িটির নিচতলা, দোতলা ও তিনতলা রুপনের এবং চার, পাঁচ ও ছয়তলা এনুর। পাঁচতলার তিন কক্ষের মধ্যে দুটি কক্ষ রেখে একটি কক্ষ ভাড়া দেয়া। সাবলেটে ভাড়া নেয়া সিরাজের স্ত্রী মর্জিনা বুধবার এ তথ্য জানিয়েছেন যুগান্তরকে।

চারদিকে শুধু বাড়ি : স্থানীয় একাধিক সূত্র যুগান্তরকে জানিয়েছে, দক্ষিণ মৈসুন্দির জুয়াড়ি সিরাজের একটি টিনশেড বাড়ি ছিল। কিন্তু গত কয়েক বছরে টাকার গরমে স্থানীয় নিরীহ মানুষদের ভয়ভীতি দেখিয়ে নামমাত্র মূল্যে লিখে নেন বাড়ি।

ভজহরি সাহা স্ট্রিটে এনু ও রুপনদের একটি বাড়ি আছে। এছাড়া নন্দলালের গলির ধোপাপট্টির একটি বাড়ি, দক্ষিণ মৈসুন্দিতে বাড়ি একটি, সাহেব লেনের একটি বাড়ি, বানিয়া নগরের দুটি বাড়ি, শরৎচন্দ্র রোডের একটি, লালমোহন সাহা স্ট্রিটের মমতাজ ভিলাসহ আরও বিভিন্ন জায়গায় তাদের বাড়ি আছে।

এনু ও রুপনের উত্থান সম্পর্কে স্থানীয়রা বলেন, তারা জুয়ার টাকা দিয়ে শুধু জমি আর বাড়ি কিনছেন। গেণ্ডারিয়া এবং আশপাশের এলাকায় যেদিকেই যাবেন সেদিকেই তাদের বাড়ি আছে।

বিলাসবহুল আট গাড়ি : স্থানীয়রা জানান, ৫ বছর আগেও তাদের পকেটে রিকশায় চড়ার টাকা থাকত না। সেই এনু ও রুপন এখন চড়েন দামি গাড়িতে। তাদের পরিবারের সদস্যরা এখন আটটি বিলাসবহুল গাড়ি ব্যবহার করেন।

এলাকাবাসী জানান, তারা কয়েক বছরের ব্যবধানে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন এটা সহজেই বোঝা যাচ্ছিল। একের পর এক বাড়ি আর গাড়ি কিনছিলেন তারা।

হর্ন বাজিয়ে চলত দেড়শ’ ক্যাডারের মহড়া : স্থানীয় একাধিক সূত্র জানিয়েছে, এনু ও রুপনের রয়েছে নিজস্ব বাহিনী। এলাকায় আতঙ্ক তৈরি করতে এরা প্রতি রাতে মোটরসাইকেলের হর্ন বাজিয়ে মহড়া দিত ৪০, ৪১ ও ৪৪নং ওয়ার্ডের বিভিন্ন গলিতে। কেউ মুখ খুললেই শুরু হতো এদের নির্যাতন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এনু ও রুপনের দলে ভিড় করা ক্যাডারদের অধিকাংশই ডাকাত শহীদের অনুসারী ছিল।

ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের স্টাফদেরও ভিড়িয়েছেন দলে : গেণ্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগ সহ-সভাপতির পদে রয়েছেন এনামুল হক এনু, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক পদে তার ভাই রুপন ভূঁইয়া। এছাড়া ওয়ারী থানা আওয়ামী লীগ সহ-সভাপতি পদে রয়েছেন আরেক ভাই রশিদুল হক ভূঁইয়া রশিদ।

৪১নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদে রয়েছেন তাদের আরেক ভাই বাতেনুল হক ভূঁইয়া। এছাড়া ৪১নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি পদে রয়েছেন তাবিবুল হক তানিম।

এছাড়া ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের স্টাফ তারেক ৪১নং ওয়ার্ড যুবলীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক, মো. রতন কৃষিবিষয়ক সম্পাদক। ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের জুয়ার বোর্ডের ক্যাশিয়ার পাভেল ৪০নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি।

তবে গেণ্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি শহীদুল্লাহ মিয়া জানিয়েছেন, দলের কেউ ক্যাসিনো ব্যবসায় জড়িত থাকলে আইনগত ব্যবস্থার পাশাপাশি দলীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

আর র‌্যাব-৩-এর অধিনায়ক শাফিউল্লাহ বুলবুল যুগান্তরকে বলেছেন, র‌্যাবের অনুসন্ধান অব্যাহত আছে। ক্যাসিনো ব্যবসায় জড়িত অন্যদের গ্রেফতারে তৎপরতা অব্যাহত আছে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/224843/