২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ৫:১৯

কী আছে ৫ ক্লাবের সিন্দুকে

যা এখনও খোলা হয়নি, ধারণা করা হচ্ছে বিপুল পরিমাণ টাকা ও বিদেশি মুদ্রায় ভর্তি বিশালাকৃতির এসব ডিজিটাল সিন্দুক * গুরুত্বপূর্ণ চার ক্লাবের অভিযান নিয়ে জিডি মামলা করেনি পুলিশ * তালিকা হচ্ছে ৫ শতাধিক জুয়াড়ি ডিলারের

ঢাকার সরগরম ক্লাবপাড়ায় এখন সুনসান নীরবতা। অভিযানের কারণে বন্ধ একাধিক ক্লাব। প্রধান ফটকে ঝুলছে পুলিশের সিলগালাকৃত তালা। ইতিমধ্যে ক্লাবের ভেতর থেকে জব্দ করা হয়েছে নানা ধরনের জুয়ার সামগ্রী।

উন্নত মানের ক্যাসিনো সরঞ্জাম। কিন্তু ক্যাসিনোর অভ্যন্তরে অনেক কিছুতেই এখনও হাত পড়েনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। এমনকি ক্লাবের সুরক্ষিত বড় সাইজের সিন্দুক খোলাই হয়নি। যা ব্যাংকের ভল্টের মতো।

অথচ রাজধানীর সূত্রাপুরে র‌্যাবের অভিযানে ইতিমধ্যে কয়েকটি সিন্দুকে মিলেছে কাঁড়ি কাঁড়ি জুয়ার টাকা। এ থেকেই ধারণা করা হচ্ছে, জুয়ার ক্লাব হিসেবে ক্যাসিনোর সিন্দুকগুলো নগদ টাকায় ভর্তি।

তবে কেউ কেউ বলছেন, ক্যাসিনোর সিন্দুকে আছে জুয়া খেলার চিপস, অস্ত্র এবং টাকা। তবে যাই থাকুক না কেন, সিন্দুকগুলো খোলা হলেই রহস্যের জট খুলবে।

পুলিশ বলছে, উন্নত প্রযুক্তির সিন্দুকগুলো ডিজিটাল পাসওয়ার্ড দিয়ে লক করা। এগুলো এতটাই সুরক্ষিত যে, হাতুড়ি দিয়ে ভাঙা তো দূরের কথা, গ্যাসকাটার দিয়েও কাটা সম্ভব নয়। তাই সিন্দুকের দরজা খুলতে ক্যাসিনোর মালিকদের খোঁজা হচ্ছে। তবে সবাই গা ঢাকা দিয়েছেন।

এদিকে পুলিশের পক্ষ থেকে ৪টি ক্লাবে অভিযান চালিয়ে সিলগালা করা হয়। এগুলো হল- ভিক্টরিয়া, দিলকুশা, মোহামেডান ও আরামবাগ ক্লাব। এছাড়া র‌্যাবের অভিযানে সিলগালা করা ইয়ংমেনস ক্লাবের সিন্দুকও খোলা যায়নি।

এ ঘটনায় র‌্যাব মামলা করলেও রহস্যজনক কারণে চারটি ক্লাবে অভিযানের ঘটনায় মামলা করেনি পুলিশ। শুধু জিডি করা হয়। আবার জিডিতে অভিযুক্ত হিসেবে কারও নামও উল্লেখ করা হয়নি। জিডির তদন্ত করছেন মতিঝিল থানার এসআই ফারুক হোসেন।

মামলা না করে জিডি করা হল কেন- এমন প্রশ্ন করা হলে এসআই ফারুক হোসেন বুধবার যুগান্তরকে বলেন, ক্লাবের ভেতরে কাউকে পাওয়া যায়নি। এ কারণে মামলা হয়নি। তবে কেন মামলা হয়নি তার ব্যাখ্যা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ভালোভাবে বলতে পারবেন।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, চারটি ক্লাব থেকে সিসি ক্যামেরার ডিভিআর জব্দ করা হয়েছে। এগুলো ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য সিআইডিতে পাঠানো হবে।

মতিঝিল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওমর ফারুক বলেন, মামলা না হলেও জিডির ভিত্তিতে একটি জব্দ তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। তবে তালিকাটি গণমাধ্যমে প্রকাশ করা যাবে না। বিষয়টি অতি গোপনীয়।

সিঙ্গাপুরে অবস্থানরত মোহামেডান ক্লাব ক্যাসিনোর অন্যতম এক মালিক বুধবার যুগান্তরকে বলেন, ক্যাসিনোর সিন্দুকে টাকা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কারণ প্রতিদিনই জুয়া খেলার জন্য বিপুল অঙ্কের নগদ টাকার প্রয়োজন হয়।

টাকা নিরাপদ রাখতে সিন্দুকের বিকল্প নেই। তিনি বলেন, ক্যাসিনোতে সিন্দুক না থাকলে জুয়ার ব্যবসা অসম্ভব। ব্যাংকে রাখা টাকা দিয়ে কখনও জুয়ার ব্যবসা চালানো যায় না।

সূত্র বলছে, বাসাবাড়িতে থাকা সাধারণ সিন্দুকের সঙ্গে ক্যাসিনোর সিন্দুকের বেশ পার্থক্য আছে। প্রায় প্রতিটি ক্যাসিনোতেই যেসব সিন্দুক থাকে তা আকারে হয় অনেক বড়। অনেকটা ব্যাংকের বিশালাকার ভল্টের মতো।

ভিক্টোরিয়া, দিলকুশা, মোহামেডান ও আরামবাগ ক্লাবের ক্যাসিনোতে ব্যাংকের ভল্টের চেয়েও বড় সিন্দুক আছে। এগুলোর একেকটির ওজন অন্তত ৪শ’ কেজি। আগুন প্রতিরোধী সিন্দুকগুলো স্টিলের ঢালাইয়ে তৈরি।

ফলে গ্যাসকাটার দিয়েও কাটা অসম্ভব। একজন ক্লাব কর্মকর্তা বলেন, আরামবাগ ক্লাবের ক্যাসিনোর সিন্দুকে নগদ টাকা ছাড়াও বিদেশি মুদ্রা ও জুয়া খেলার চিপস থাকে। পিস্তল ও অস্ত্রের গুলিও রাখা হতো।

প্রতিটি ক্লাবের সিন্দুক ডিজিটাল লকযুক্ত থাকায় খোলা যায়নি। একাধিকবার খোলার চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হয় পুলিশ। প্রচুর ভারি হওয়ায় থানায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। ক্যাসিনোর ভেতরেই সিন্দুক রয়ে গেছে।

রাজধানীর বাজার ঘুরে জানা যায়, রাজধানীতে সিন্দুকের সবচেয়ে বড় বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান চারুতা লিমিডেট। এর সবচেয়ে বড় শোরুম গুলশান-২ এর ৯৪ নম্বর রোডে। এখানে ভারতীয় গোদরেজ ব্র্যান্ডের বিভিন্ন আকারের সিন্দুক বিক্রি করা হয়।

শোরুমের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ অঞ্জন কুমার দত্ত বুধবার যুগান্তরকে বলেন, সিন্দুক খুবই শ্লো আইটেম। মাসে হয়তো ৩-৪টি বিক্রি হয়। মূলত ব্যাংক ও গার্মেন্টসহ বড় বড় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সিন্দুকের মূল ক্রেতা।

তবে ব্যক্তি পর্যায়েও অনেকে সিন্দুক কেনেন। এছাড়া গুলশান-১ নম্বরেও বেশ কয়েকটি সিন্দুক বিক্রির দোকান রয়েছে। সিন্দুকের পাশাপাশি দোকানগুলোতে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বিদেশি ফার্নিচার বিক্রি হয়।

গুলশান-১ এর বীরউত্তম একে খন্দকার রোডে জহির অ্যান্ড ব্রাদার্স নামের শোরুমে চীনের তৈরি সিন্দুক বিক্রি হয়। শোরুমের সেলস ম্যানেজার যুবরাজ রিদান বলেন, আগে সিন্দুকের বিক্রি ভালোই ছিল।

তবে এখন ব্যবসা-বাণিজ্যের মন্দা অবস্থার কারণে সিন্দুকের বিক্রিও কম। ক্যাসিনোতে সিন্দুকের ব্যবহার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কোথায় ব্যবহারের জন্য সিন্দুক কেনা হচ্ছে তার খোঁজ নেয়ার অধিকার তাদের নেই।

তবে এটা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অনুসন্ধান করে দেখতে পারে। গুলশানের আরেকটি সিন্দুক বিক্রির শোরুম জারা এন্টারপ্রাইজের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার আসাদুজ্জামান গাজী বলেন, ক্যাসিনোর সিন্দুক ধরা পড়ার পর দোকানে নানা ধরনের লোকজন আসছে।

কেউই নিজেদের পরিচয় দেয় না। ক্রেতা হিসেবে দরদাম জিজ্ঞেস করে। কেউ কেউ ছবিও তোলে তারপর চলে যায়।

সূত্র বলছে, ক্যাসিনোতে অর্থ নিরাপদ রাখতে যেমন সিন্দুক রাখা হয়, তেমনি ক্যাসিনো ঘিরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা হয় একেবারেই নিশ্ছিদ্র। ক্যাসিনোর প্রতিটি ইঞ্চি থাকে সিসি ক্যামেরার আওতায়।

এর কারণ ব্যাখ্যা করেন সাবেক একজন ক্যাসিনো মালিক। তিনি বলেন, একটি ১৮ থেকে ২০ ইঞ্চি পুকার বোর্ডের ওপর অন্তত ৩টি সিসি ক্যামেরা ফিট করা থাকে। যাতে জুয়াড়িদের ‘চিটিংয়ের’ পথ বন্ধ হয়। জুয়াড়িরা কোনো ডিল হেরে গেলে অনেক সময় ক্রিকেট খেলার মতোই রিভিউর আবেদন করেন।

তখন সিসি ক্যামেরার ফুটেজ পর্যালোচনা করা হয়। ভিডিও ফুটেজ পর্যালোচনার জন্য সার্বক্ষণিক অপারেটর রাখা হয়। তার কাজই হচ্ছে ২৪ ঘণ্টার ভিডিও ফুটেজের ওপর নজর রাখা।

সিসি ক্যামেরায় কঠোর নজরদারির কারণে ক্যাসিনোতে জাল-জালিয়াতি প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। তারপরও কেউ জালিয়াতি করে ধরা পড়লে তাকে ব্ল্যাকলিস্ট করা হয়।

তালিকা হচ্ছে ক্যাসিনো ডিলারদের : ক্যাসিনো ব্যবসা চালাতে জুয়ায় পারদর্শী লোকজনের দরকার পড়ে। এদের ডিলার বলা হয়। প্রতিটি ক্যাসিনোতে ডিলারদের নির্দিষ্ট পোশাক পরতে হয়।

যাতে জুয়াড়িদের থেকে সহজেই তাদের আলাদা করে চেনা যায়। ক্যাসিনো ব্যবসার সঙ্গে জড়িত একাধিক ব্যক্তি যুগান্তরকে বলেন, ৫-৬ বছর আগে ঢাকায় ক্যাসিনো ব্যবসা শুরুর দিকে নেপাল থেকে উচ্চ বেতনে ডিলার ভাড়া করে আনা হতো।

কিন্তু ঢাকায় ধীরে ধীরে ক্যাসিনোর সংখ্যা বাড়তে থাকলে স্থানীয়ভাবে ডিলার তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়। বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে ডিলার তৈরির এ কাজটি করেন মূলত নেপালিরা।

ডিলারদের এমনভাবে দক্ষ জুয়াড়িতে পরিণত করা হয় যাতে ক্যাসিনো খেলতে আসা বাঘা বাঘা জুয়াড়িকে পরাস্ত করা যায়। জুয়াড়িদের উপর্যুপরি পরাস্ত করতে না পারলে ডিলার হিসাবে চাকরি বেশিদিন টেকে না।

কোনো ক্যাসিনোতেই অদক্ষ ডিলারের কোনো স্থান নেই। দক্ষতার ভিত্তিতে জুয়াড়িদের বেতন নির্ধারিত হয়। কারণ একজন ডিলার যত বেশি জুয়াড়িকে হারাতে পারবেন তত বেশি লাভ হবে ক্যাসিনো মালিকের। ডিলার হেরে যাওয়া মানে ক্যাসিনো মালিকের লোকসান।

সূত্র বলছে, ঢাকার অনেক ক্যাসিনোতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারীরাও ডিলার হিসেবে কাজ করছেন। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারীও আছেন ভূরি ভূরি। প্রতি ক্যাসিনোতে ডিলারদের দায়িত্ব ২ শিফটে।

সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত এক সিফট। রাত ৮-৯টার পর আরেক সিফট শুরু হয়। দুই শিফটে পালা করে ডিউটি করেন ক্যাসিনো ডিলাররা। প্রত্যেক ক্যাসিনোতে অল্প বয়সী তরুণ ও যুবকরাই মূলত ডিলারের কাজ করেন।

পুরুষের পাশাপাশি তরুণীরাও ক্যাসিনো ডিলার হন। তবে নারীদের ক্ষেত্রে কাজের ধরন ভিন্ন। অনেক সময় নারীদের ক্যাসিনো মার্কেটিংয়ের কাজে ব্যবহার করা হয়। হাস্যকর শোনালেও ক্যাসিনো মার্কেটিংয়ের অর্থ হল, বড় বড় জুয়াড়িকে নানা ধরনের প্রলোভন দিয়ে ক্যাসিনো পর্যন্ত নিয়ে আসা।

অবিশ্বাস্য শোনালেও বাস্তবতা হচ্ছে- ঢাকার ক্যাসিনোতে ডিলার হিসেবে চাকরির জন্য দৈনিক পত্রিকায় বিজ্ঞাপনও দেয়া হয়। আর সেই বিজ্ঞাপন দেখে শত শত তরুণ-যুবক বায়োডাটা হাতে ভিড় করেন ইন্টারভিউয়ের জন্য। মূলত চতুর ও কৌশলী স্মার্টরাই ডিলার হিসেবে কাজ পান।

ঢাকায় ক্যাসিনোতে ডিলার সবচেয়ে বেশি কাজ করেন বরিশাল, কুমিল্লা, চাঁদপুর ও নোয়াখালী অঞ্চলের যুবকরা। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের হিসাব মতে, প্রতিটি ক্যাসিনোতে ৭০ থেকে ৮০ জন করে ডিলার থাকে।

৬০টি ক্যাসিনোতে ডিলার হিসেবে চাকরিরত তরুণ-যুবকের সংখ্যা ৫ শতাধিক। তবে ক্যাসিনোতে ক্যাটারিং সার্ভিস, ওয়েটার, ক্লিনার থেকে আরও বেশকিছু পদে চাকরি করেন অনেকে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/224847/