২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯, বুধবার, ৭:৫৭

দলীয় পরিচয়ও সরিয়ে নিচ্ছেন তাঁরা

ক্যাসিনোকাণ্ডে জড়িত, টেন্ডারবাজ ও চাঁদাবাজ নেতাদের অনেকে এরই মধ্যে গাঢাকা দিয়েছেন। কেউ কেউ দেশও ছেড়েছেন। অনেকে দেশ ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করছেন। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের বেশির ভাগ কাউন্সিলরকে তিন ধরে কার্যালয়ে দেখা যাচ্ছে না। বন্ধ রয়েছে ঢাকা শহরে যুবলীগের কার্যালয়গুলোও। গতকাল মঙ্গলবার বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে যুবলীগ কার্যালয়ে গিয়ে কোনো নেতাকে পাওয়া যায়নি। অফিস সহকারী দীনেশকে একা বসে থাকতে দেখা গেছে। যুবলীগ ঢাকা দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশের একটি সূত্র।

যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য নুরুন্নবী চৌধুরী শাওনের ব্যাংক হিসাব তলব করার খবরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যেও। একটি গোয়েন্দা সূত্র জানায়, যুবলীগ-স্বেছাসেবক লীগ ও আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন

নেতার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞার আদেশ সংশ্লিষ্ট স্থানগুলোতে পাঠানো হয়েছে। ঢাকার যুবলীগ নেতারা তাঁদের নামে ছাপানো পোস্টার, ব্যানার, বিলবোর্ড নিজেদের উদ্যোগে রাতের আঁধারে সরিয়ে নিচ্ছেন। অন্যদিকে দেখা গেছে, যুবলীগ নেতারা তাঁদের সব ফেসবুক ওয়াল লক করে দিয়েছেন।

আওয়ামী লীগের একজন সংসদ সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রথমে মনে করেছিলাম যুবলীগের উচ্ছৃঙ্খল কয়েকজনকে ধরা হবে অন্যদের ভয় দেখানোর জন্য, কিন্তু শাওনের ব্যাংক হিসাব তলব করার পর আতঙ্কেই আছি। মান-ইজ্জতের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াচ্ছে।’

একটি গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, ক্যাসিনো, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে মানুষের জায়গা-জমি দখলের রিপোর্ট পেয়ে প্রধানমন্ত্রী প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়ে এসবের সঙ্গে জড়িতদের তালিকা করে আইনের আওতায় আনার নির্দেশ দেন।

ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের ঘনিষ্ঠ বেশ কয়েকজন নেতা এরই মধ্যে দেশ ত্যাগ করেছেন। দক্ষিণ যুবলীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য জাকির হোসেন ইয়ংমেনস ক্লাবে অভিযানের পরদিনই দেশ ছেড়েছেন। তিনি বর্তমানে সিঙ্গাপুরে অবস্থান করছেন। জাকির হোসেনের একজন নিকটাত্মীয় জানান, সম্রাটের প্রায় ৩০০ কোটি টাকা গচ্ছিত রয়েছে জাকিরের কাছে। গতকাল জাকির হোসেনের পল্টনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, পরিবারের কেউ বাসায় নেই। লোক ভাড়া করে রাতারাতি সেগুনবাগিচা, পল্টন লাইন এলাকায় সাঁটানো তাঁর পোস্টারগুলো ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে, বিলবোর্ড, ফেস্টুন সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।

ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগের অন্যতম দাপুটে নেতা গুলিস্তান এলাকার ২০ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি শাহাবুদ্দিনকে মুক্তিযোদ্ধা ক্লাবে অভিযানের পর থেকে আর প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। গুলিস্তান, বঙ্গবাজার, ফুলবাড়িয়াসহ পাঁচটি মার্কেট নিয়ন্ত্রণ করেন শাহাবুদ্দিন। মুক্তিযোদ্ধা ক্লাবের ক্যাসিনোর মালিক আলী হোসেন ও সম্রাটের ঘনিষ্ঠ শাহাবুদ্দিনকে ওই ক্লাবের ক্যাসিনোর আয় থেকে প্রতিদিন দেওয়া হতো ৩০ হাজার টাকা। এলাকা থেকে শাহাবুদ্দিনের বিলবোর্ডও সরিয়ে ফেলা হয়েছে।

ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের ঘনিষ্ঠ যে কজন যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা নিয়মিত সিঙ্গাপুরে গিয়ে জুয়া খেলেন তাঁদের অন্যতম রবিউল ইসলাম সোহেল। তিনি ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগ উত্তরের সাবেক সভাপতি। আগামী দিনে ঢাকা মহানগর উত্তর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি পদপ্রত্যাশী। ক্যাসিনো পরিচালনার সঙ্গে জড়িত এই সোহেলও দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। বর্তমানে তিনি সিঙ্গাপুরে অবস্থান করছেন বলে তাঁর নিকটজনরা জানিয়েছেন।

মিজানুর রহমান মিজানের বাড়ি বরিশালের মুলাদী উপজেলায়। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি হিজলা-মুলাদী আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। কেন্দ্রীয় যুবলীগের সহসম্পাদক, সাবেক এক প্রতিমন্ত্রীর এপিএস মিজান নিয়মিত সিঙ্গাপুর গিয়ে জুয়া খেলেন। গত বছর শেষের দিকে সম্রাটের আয়োজনে সিঙ্গাপুরের এক অভিজাত হোটেলে তাঁর চীনা বান্ধবী মিন্ডি লির জন্মদিন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মিজান। ক্যাসিনোসংশ্লিষ্ট মিজান অঢেল সম্পদের মালিক। গত কদিন ধরে তাঁরও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। ‘মিজানুর রহমান হাওলাদার’ নামে পরিচালিত তাঁর দুটি ফেসবুক আইডির একটি থেকে সব ধরনের ছবি মুছে ফেলা হয়েছে। অন্য আইডি অকার্যকর করা হয়েছে।

যুবলীগ দক্ষিণের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোমিনুল হক সাঈদ বর্তমানে সিঙ্গাপুরে অবস্থান করছেন। তাঁর নিয়ন্ত্রিত ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে অভিযানের আগেই তিনি সিঙ্গাপুর যান ছেলের চিকিৎসার জন্য। সিঙ্গাপুরে বসেই তিনি অভিযানের খবর পান। এরপর ছেলের চিকিৎসা শেষ হলেও তিনি আর দেশে ফেরেননি।

সেগুনবাগিচা থেকে শুরু করে আরামবাগ, ফকিরাপুল, মতিঝিল, ব্যাংলাদেশ ব্যাংক হয়ে শাহজাহানপুর ও খিলগাঁও পর্যন্ত এলাকা সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, ওই যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতাদের কোনো পোস্টার, ব্যানার, বিলবোর্ড নেই। রাতের আঁধারে সেগুলো সরিয়ে ফেলা হয়েছে। বিজয়নগর এলাকায় যুবলীগ ঢাকা দক্ষিণের কার্যনির্বাহী কমিটি সদস্য জাকির হোসেনের ঘনিষ্ঠ বাদল নামের একজন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ভাই সিঙ্গাপুর থেকে ফোন করে বলে দিয়েছেন দেয়ালের সব পোস্টার ছিঁড়ে ফেলতে, ব্যানার নামিয়ে ফেলতে। আমি সে দায়িত্ব পালন করেছি।’ কী কারণে পোস্টার সরানোর কথা বলেছেন জানতে চাইলে বাদল বলেন, ‘পোস্টার থাকলে সাংবাদিকরা নিয়ে পত্রিকায় দেবে, আবার র‌্যাব নিয়ে যাবে। সে কারণে ভাই বিদেশ থেকে নির্দেশ দিয়েছেন সরিয়ে ফেলতে।’

পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা, ব্যানার-বিলবোর্ড সরিয়ে নেওয়ার দৃশ্য চোখে পড়েছে রাজধানীর অন্য এলাকাগুলোতেও।

গতকাল সকালে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মিরপুর এলাকার একজন কাউন্সিলরের কার্যালয়ে নানা জরুরি কাজে এসেছিলেন বেশ কিছু লোক। কিন্তু সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ওই কাউন্সিলরের গাড়ির চালক এসে জানান, কাউন্সিলর আজ (গতকাল) আফিসে আসবেন না। তিনি অন্য একটি কাজে বাইরে গেছেন।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৬৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মাহমুদুল হাসান পলিনকে এলাকায় প্রকাশ্যে দেখা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছে ওই এলাকার সাধারণ মানুষ। পলিন একসময় ছিলেন যুবদল নেতা। এখন তিনি ৬৮ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি।

যুবলীগ ঢাকা উত্তরের সভাপতি মাঈনুল হোসেন খান নিখিল ও সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেনকে প্রকাশ্য কোনো কর্মকাণ্ডে দেখা যাচ্ছে না। তাঁদের ব্যাবসায়িক কার্যালয়ও বন্ধ রয়েছে।

রাজধানীর ওয়ার্ড যুবলীগের কার্যালয়গুলো খোলা হচ্ছে না তিন দিন ধরে। ওয়ার্ড নেতারাও লাপাত্তা। বেশির ভাগ গাঢাকা দিয়েছেন। শাহজাহানপুর রেলগেট এলাকায় যুবলীগের কার্যালয়টি দিন-রাত সরগরম থাকত। গতকাল গিয়ে দেখা যায় কার্যালয়টি বন্ধ। ওই কার্যালয়ের পাশের একজন দোকানি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘খালেদ ভাই ধরা পড়ার পর থেকে যুবলীগের কেউ আর এখানে আসে না।’

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2019/09/25/818582