ফাইল ছবি
২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯, মঙ্গলবার, ১:১৭

অভিযানেও অভিযুক্ত পুলিশ

১৯ বিদেশি জুয়াড়িকে পালাতে সহায়তার অভিযোগ, সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে তিনজনকে

বুধবার রাত ১১টা ২৮ মিনিট ১৫ সেকেন্ড। রাজধানীর সেগুনবাগিচার ৬/৬ নম্বর বাসা থেকে এক এক করে বেরিয়ে আসছিলেন তিন ব্যক্তি। তাদের একজনের হাতে একটি ব্যাগ। সিসিটিভির ফুটেজে ধরা পড়েছে ওই দৃশ্যপট। পরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই বাসার পঞ্চম তলার একটি ফ্ল্যাটে ভাড়ায় ছিল ছয় নেপালি নাগরিক। বুধবার দিনের বেলায় র‌্যাব রাজধানীতে অভিযান শুরুর পর রাত সাড়ে ১০টার দিকে ওই বাসায় পুলিশ পরিচয়ে তিন ব্যক্তি ঢুকেছিলেন। এক ঘণ্টা ফ্ল্যাটে অবস্থানের পর সন্দেহজনকভাবে একটি ব্যাগ নিয়ে তারা ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে আসেন। সংশ্নিষ্ট সূত্র বলছে, টাকার বিনিময়ে বিদেশি জুয়াড়িদের তথ্য দিয়ে পালাতে সহায়তা করেছেন পুলিশের এই অসাধু সদস্যরা।

পুলিশ সেগুনবাগিচার ওই বাসা থেকে বের হওয়ার রাতেই একে একে পালিয়ে যায় বিদেশি জুয়াড়িরা। ওই বাসায় র‌্যাবের অভিযানের আগে তারা সটকে পড়ে। সেগুনবাগিচার ওই বাসার পাশাপাশি রাজধানীর আরও দুটি ফ্ল্যাট থেকে মোট ১৯ বিদেশি জুয়াড়ি পালিয়ে গেছে। তারা দীর্ঘদিন ধরে ঢাকায় ক্যাসিনো পরিচালনায় যুক্ত ছিল। ক্যাসিনো পরিচালনায় কিছু পুলিশ সদস্যের যোগসাজশ ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। এবার অভিযানের মধ্যেও তাদের দেখা গেল প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকায়।

একটি দায়িত্বশীল গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ক্যাসিনো ঘিরে পুলিশের অনৈতিক তৎপরতার তথ্য তুলে ধরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ মহাপরিদর্শক ও ডিএমপি কমিশনারকে চিঠি দেওয়া হবে। এতে অভিযুক্তদের ব্যাপারে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশও করবে ওই সংস্থা।

সেগুনবাগিচার ৬/৬ নম্বর বাড়ির পঞ্চম তলার যে ফ্ল্যাটে বিদেশি জুয়াড়িরা ভাড়া থাকত, ওই ফ্ল্যাটের মালিক সৈয়দা হাছনা আহম্মদ। তবে হাছনার ফ্ল্যাট দেখভাল করছিলেন তার ভাই সৈয়দ বেলায়েত হোসেন। বেলায়েত গতকাল সমকালকে জানান, মোহামেডান ক্লাবের কর্মকর্তা পরিচয়ে মাস দুয়েক আগে মো. মাছুম নামে এক ব্যক্তি মাসে ৪০ হাজার টাকায় ওই ফ্ল্যাট ভাড়া নেন। ভাড়া নেওয়ার সময় মাসুম জানান, সেখানে ছয় বিদেশি থাকবেন। মাসখানেক পরে বিদেশিদের সহধর্মিণীরা আসবেন। তবে মাসখানেক পরও কোনো বিদেশির স্ত্রী না আসায় তার সন্দেহ হয়। এরপরই তিনি বাসা ছেড়ে দিতে মাছুমকে নোটিশ দেন। এরই মধ্যে গত বুধবার হঠাৎ মধ্যরাতে কাউকে কিছু না জানিয়ে বিদেশিরা বাসা ত্যাগ করে। বিদেশি নাগরিকদের ওই বাসায় থাকার তথ্য আগেই রমনা থানা পুলিশকে অবহিত করা হয়েছিল বলে জানান বেলায়েত।

সেগুনবাগিচার ওই বাসার নিরাপত্তারক্ষী উজ্জ্বল আলী সমকালকে বলেন, ছয়জন নিরাপত্তারক্ষী ওই বাসার গেটে পালাক্রমে দায়িত্ব পালন করেন। বুধবার রাতে গেটের দায়িত্বে ছিলেন উজ্জ্বল ও মামুন। রাত সাড়ে ১০টার দিকে তিনজন সাদা পোশাকে বাসার গেটে এসে জানান, তারা পঞ্চমতলায় বিদেশিদের ফ্ল্যাটে যাবেন। পরিচয় জানতে চাইলে তারা পুলিশের লোক বলে জানান। তাদের হাতে ওয়াকিটকি ছিল। নাম জানতে চাইলে তারা বলেন, বিদেশিরা তাদের আগে থেকে চেনে, কোনো সমস্যা নেই। এরপর উজ্জ্বল তাদের তিনজনকে নিয়ে পঞ্চম তলার ফ্ল্যাটে যান। সেখানে যাওয়ার পর ওই তিনজন ভেতরে ঢোকেন। উজ্জ্বলকে ভেতরে ঢুকতে নিষেধ করেন। ঘণ্টাখানেক পর তারা বেরিয়ে আসেন। তখন তাদের একজনের হাতে একটি ব্যাগ ছিল। তবে ফ্ল্যাটে ঢোকার সময় তাদের হাতে কোনো ব্যাগ ছিল না। পুলিশ পরিচয়ে তিনজন বাসা থেকে বের হওয়ার পর ওই ফ্ল্যাটে ঢুকে উজ্জ্বল জানতে চান, তাদের কোনো সমস্যা হয়েছে কি-না। তখন তারা বলে, 'নো প্রবলেম।'

উজ্জ্বল আরও জানান, পুলিশ পরিচয়ে বাসায় আসা ব্যক্তিরা দুটি মোটরসাইকেল নিয়ে আসে। তবে মোটরসাইকেল বাসার গেট থেকে অনেক দূরে রাখা হয়। বিদেশিরা যখন মধ্যরাতে বের হচ্ছিল, তখন উজ্জ্বলকে জানায় যে তারা আবার আসবে।

সমকালের হাতে আসা একটি ফুটেজে দেখা যায়, পুলিশ পরিচয়ে ওই ফ্ল্যাটে আসা তিন ব্যক্তি রাত ১১টার দিকে দ্রুত ওই বাসা থেকে বেরিয়ে যান। এরপর রাত ১টা ৪৬ মিনিট ৪০ সেকেন্ডে প্রথমে চার বিদেশি নাগরিক ওই বাসা থেকে বেরিয়ে আসে। তাদের সবার সঙ্গে ছিল ব্যাগ। এরপর আরও চারজন ওই বাসা থেকে বের হয়। তাদের সঙ্গেও একাধিক ব্যাগ ছিল। কয়েক সেকেন্ড পর আরও চারজন বেরিয়ে আসে। সর্বশেষ বের হয় তিনজন। সব মিলিয়ে ওই ফ্ল্যাট থেকে পালিয়েছে ১৫ জন।

মাছুমের সঙ্গে ওই ফ্ল্যাট মালিকের যে চুক্তি হয়, সেখানে বলা হয়, নেপালি নাগরিকরা সেখানে থাকবে। তারা হলো- রাধাকৃষ্ণ নায়াজু, বচন রঞ্জিত, গৌতম নাকারমি, ইন্দ্র প্রসাদ, বিকাশ মান ডাঙ্গল, নিরোজ সিধি ও প্রবীন প্রসীন।

জানা গেছে, বুধবার আরামবাগে ফকিরাপুল ইয়ংমেনস ক্লাব ও ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবসহ চারটি ক্লাবে অভিযান চালায় র‌্যাব। এরপরই তারা ক্যাসিনো পরিচালনায় যুক্ত বিদেশি নাগরিকদের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট তথ্য পায়। তবে বিদেশি জুয়াড়িরা যেসব বাসায় অবস্থান করছে, সেখানে অভিযানের আগে তারা পালিয়ে যায়। পরে খবর নিয়ে জানা যায়, পুলিশের অসাধু কিছু সদস্য তাদের আগাম তথ্য দিয়ে পালাতে সহায়তা করেছে।

অভিযোগ আছে, দীর্ঘদিন ধরে মতিঝিলসহ রাজধানীর অনেক এলাকায় পুলিশের নাকের ডগায় বসেই ক্যাসিনো চালিয়ে আসছিল একটি গ্রুপ। মতিঝিল থানার পাশেই একাধিক ক্যাসিনো ছিল। পুলিশের পাহারায় এসব ক্যাসিনো চলছিল। এর বিনিময়ে সেখান থেকে মোটা অঙ্কের টাকা পেত পুলিশের অসাধু সদস্যরা। এমনকি অনেক ক্যাসিনোতে নামকাওয়াস্তে অভিযান চালিয়ে চাঁদার রেট বাড়ানো হতো। গণমাধ্যমে বিভিন্ন সময় ক্লাবপাড়ায় ক্যাসিনো নিয়ে প্রতিবেদন হলেও তা আমলে নেয়নি পুলিশ। যুবলীগের কিছু নেতার সঙ্গে মিলেমিশেই এ কারবার চালিয়ে আসছিল অসাধু পুলিশ সদস্যরা। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অনেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ক্যাসিনো থেকে মাসোহারা নেওয়ার অভিযোগ আছে।

সংশ্নিষ্ট একটি সূত্র জানায়, ক্যাসিনো ও জুয়ার বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত থাকবে। গ্রেফতার হবে আরও অনেকে। এরই মধ্যে দেশি-বিদেশি কয়েকজনকে গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখা হয়েছে। তারা যাতে দেশ ত্যাগ করতে না পারে, নেওয়া হচ্ছে সেই ব্যবস্থা। জব্দ করা হয়েছে বিদেশিদের পাসপোর্ট। গোয়েন্দা সূত্রসহ একাধিক মাধ্যম থেকে জানা গেছে, আরও যাদের ব্যাপারে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে, তাদের মধ্যে রয়েছেন উত্তরা পশ্চিম থানার এক শ্রমিক লীগ নেতা। উত্তরা ১ নম্বরে পূবালী ব্যাংকের দ্বিতীয় তলায় ক্যাসিনো পরিচালনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এ ছাড়া খোঁজ নেওয়া হচ্ছে ঢাকা মহানগর যুবলীগের উত্তরের এক নেতার ব্যাপারে। বনানীর আহমেদ টাওয়ার, হোটেল সারিনায় তার বিরুদ্ধে ক্যাসিনো পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টরে অ্যাপেক্স ভবনে যুবলীগের আরেক নেতা ক্যাসিনো চালান। এ ছাড়া উত্তরার ৯ নম্বর সেক্টরে আকাশ প্লাজার টপ ফ্লোরে ক্যাসিনোর আসর বসত। উত্তরাকেন্দ্রিক এসব ক্যাসিনোর টাকা পেতেন ছাত্রলীগের এক সাবেক নেতা। বর্তমানে তিনি বেশির ভাগ সময় বিদেশে অবস্থান করেন। এ ছাড়া অবৈধভাবে ক্যাসিনোর সরঞ্জাম কীভাবে দেশে ঢুকেছে, সে ব্যাপারে গোয়েন্দারা তথ্য নিচ্ছেন। সূত্র জানায়, পুলিশের এক এসআই ঢাকার একটি বড় অংশের ক্যাসিনোসহ অন্যান্য জায়গা থেকে 'তোলা' তুলত। এরপর তা পুলিশের অনেকের মধ্যে ভাগ হয়ে যেত।

সংশ্নিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া ও 'ঠিকাদার মোগল' গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জি কে শামীম গ্রেফতারের পর অনেকেই আতঙ্কে। এরই মধ্যে খালেদ ও শামীম অনেকের নাম ফাঁস করেছেন, যারা নিয়মিত তাদের কাছ থেকে কমিশন নিতেন। তাদের মধ্যে পুলিশ সদস্যরাও রয়েছেন।

খালেদ ঠিকাদারির পাশাপাশি ক্যাসিনো চালাতেন। আর শামীম মোটা কমিশন দিয়ে সরকারি প্রকল্পের অধিকাংশ কাজ বাগিয়ে নিতেন। ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে অভিযানের ঘটনায় দায়ের করা মামলা তদন্ত করবে র‌্যাব। আপাতত থানা পুলিশ ও ডিবি মামলার তদন্ত করলেও তা র‌্যাবের কাছে ন্যস্ত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

https://www.samakal.com/todays-print-edition/tp-first-page/article/19094492/