১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯, বুধবার, ১০:০৯

ডেঙ্গুতে দু’মাসে ক্ষতি সাড়ে ৩০০ কোটির উপরে

এ বছরে ডেঙ্গুর প্রকোপে রাজধানীর প্রায় ঘরে ঘরে এবং সারা দেশে অগণিত মানুষকে ভুগতে হচ্ছে। সমপ্রতি এডিস মশাবাহিত রোগটিতে আক্রান্তের সংখ্যা কিছুটা কমে এলেও থামছে না মৃত্যু। প্রতিদিনই ডেঙ্গুতে মানুষ মারা যাচ্ছেন। ডেঙ্গুর এই ব্যাপক বিস্তারের মধ্যে গত আট মাসে কী পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয়েছে সেটা এখনো পর্যন্ত অজানা। সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ না জানালেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর নিয়মিত প্রকাশ করছে এ রোগে হাসপাতালে ভর্তি, সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরাসহ মৃতের সংখ্যা। তবে বেসরকারি একটি হিসাব বলছে, এ বছর ডেঙ্গুর কারণে (দু’মাসে) সাড়ে ৩০০ কোটি টাকার উপরে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। আর এই হিসাব দেখিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক। বিশ্ববিদ্যালয়টির স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে গবেষকদলের নেতৃত্ব দেন ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ।

দু’মাস (জুলাই মাসের মাঝামাঝি থেকে ১৩ই সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে তারা বলছেন, এই সাড়ে ৩০০ কোটি টাকার মধ্যে ডেঙ্গু আক্রান্তদের চিকিৎসায় সরাসরি খরচ হয়েছে অন্তত ২৩১ কোটি ৮৮ লাখ ১ হাজার ২০৫ টাকা। পাশাপাশি রোগীদের সঙ্গে হাসপাতালে অবস্থানকারীদের পেছনে খরচ ও তাদের কর্মঘণ্টার হিসাবে আরো ৮৩ কোটি ৫০ লাখ ৩৩ হাজার ৩৫৫ টাকার ক্ষতি ধরা হয়েছে এই সমীক্ষায়। যারা মারা গেছেন তাদের (ইয়ার অব লাইফ লস) অর্থনৈতিক ক্ষতি ধরা হয়েছে ৩৯ কোটি ৬১ লাখ ৫৫ হাজার ৫৭৬ টাকা। তাদের হিসাবে, সব মিলিয়ে এবার ডেঙ্গুতে উল্লিখিত সময়ে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ৩৫৪ কোটি ৯৯ লাখ ৯০ হাজার ১৩৬ টাকা।

তবে যারা হাসপাতালের বহিঃবিভাগে চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফিরে গেছেন তাদের খরচ এখানে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। তবে গবেষক দলের প্রধান ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ জানান, তাদের গবেষণায় প্রাপ্ত আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আদর্শ ধরা ঠিক হবে না। সরকারি তথ্যের ওপর ভিত্তি করে এ সমীক্ষা করে আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির হিসাব করা হয়েছে বলে জানান গবেষক দলের প্রধান। গবেষক দলের এই আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ বের করেছেন সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতাল, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য ও গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে হাসপাতালে ভর্তি, সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরাসহ মৃতের সংখ্যা নিয়ে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। সমীক্ষা প্রাপ্ত তথ্য বলছে, হাসপাতালে ভর্তি ফি, শয্যা ভাড়া, পরীক্ষার ফি, ডাক্তার ফি, ওষুধ ও খাবার খরচ মিলিয়ে স্থানীয় সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী প্রতি ব্যয় হয়েছে ১০ হাজার ৯৫২ টাকা। এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে পাঠানো রোগীর খরচ হয়েছে ২০ হাজার ৪৯৩ টাকা। গবেষক দল সরকারি-বেসকারি হাসপাতাল আবার বেসরকারি হাসপাতালকে দুটো ভাগে ভাগ করে খরচের পরিমাণ ধরা হয়েছে। সরকারি হাসপাতালে একজন রোগীর পেছনে আর্থিক খরচ ধরা হয়েছে ১০ হাজার ৯০০ টাকা উপরে, বেসকারি হাসপাতালের মধ্যে এ ক্যাটাগরিতে একজন রোগীর খরচ দরা হয়েছে ২ লাখ টাকা আর বি ক্যাটাগরি বেসরকারি হাসপাতালের খরচ ধরা হয়েছে ৪১ হাজার টাকা। সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, আমরা খরচের বিষয়টাকে সরকারি আলাদা আর বেসরকারির ক্ষেত্রে দুটো ক্যাটাগরি করে রোগীদের গড় হিসেব করে এ সমীক্ষা করেছি। এখানে আমরা রোগী ছাড়াও তাদের সঙ্গে যারা এসেছে তাদের বিভিন্ন খরচসহ কর্মঘণ্টার একটা হিসেব এনেছি। তিনি জানান, যারা মারা গেছেন তাদের জীবনের মূল্য তো আর্থিকভাবে হিসাব করা যাবে না। কিন্তু মাথাপিছু আয় বিবেচনা করে তাদের গড় বয়সের হিসাবে আর্থিক ক্ষতিটা তুলে ধরা হয়েছে।

এবছর যারা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন তাদের ৬৫ শতাংশই ২৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। আর আমাদের গড় আয়ু ৭০-এর উপরে। তবে হাসপাতালে ভর্তি ছাড়া ডেঙ্গু আক্রান্তদের চিকিৎসা খরচের পাশাপাশি এই রোগ থেকে বাঁচতে মশা প্রতিরোধে সেপ্র, কয়েল, মশারিসহ বিভিন্ন ধরনের সরঞ্জাম কেনার খরচ গবেষণার বাইরে রাখা হয়েছে। অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, আমাদের এই সমীক্ষা একেবারে আদর্শ বলা যাবে না। তাছাড়া এই সমীক্ষা মূলত কাউকে দোষারোপ করার জন্য নয়। তিনি সরকারকে ধন্যবাদ দিয়ে বলেন, তাদের এই গবেষণায় এটা বের করা হয়েছে সরকারের নীতি নির্ধারণীদের দেয়ার জন্য, যেন পরবর্তী সময়ে এ বিষয়ে সচেতন থেকে আমাদের এই ক্ষতির পরিমাণ কমানো যায়। ভবিষ্যতে এক্ষেত্রে গুরুত্ব দেয়ার জন। সরকার ও সাধারণ মানুষকে ডেঙ্গু নিয়ে সচেতন থাকার পরামর্শ দিয়ে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, এবারের ডেঙ্গু চিত্র প্রমাণ করে দিয়েছে আমরা কতটা অসচেতন। তাই সবার প্রতি অনুরোধ থাকবে সবাই যেন এ বিষয়ে সচেতন থাকি।

এ বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৮২ হাজার ৪৫৪ জন রোগী সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। তাদের মধ্যে ঢাকা শহরের বাইরে ছিল ৩৭ হাজার ৭৭ জন। আর রাজধানীতে ৪৫ হাজার ৩৭৭ জন। বেসরকারি হিসাবে এটা কয়েকগুণ বেশি হবে। বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো রোগে আক্রান্ত হয়ে এত বেশিসংখ্যক রোগী এর আগে হাসপাতালে ভর্তি হয়নি। ইতিমধ্যে চিকিৎসা শেষে হাসপাতাল ছেড়েছে ৭৯ হাজার ৭৬৬ জন। অর্থাৎ ৯৭ শতাংশ। চলতি বছর ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে সারা দেশে এ পর্যন্ত ২০৩ জনের মৃত্যুর খবর পেয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তা পর্যালোচনার জন্য সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে(আইইডিসিআর) পাঠানো হয়েছে। সংস্থাটি এর মধ্যে ১১৬টি মৃত্যু ঘটনা পর্যালোচনা করে ৬৮ জনের মৃত্যু ডেঙ্গুজনিত বলে নিশ্চিত হয়েছে। এখনও পর্যালোচনা অব্যাহত রয়েছে। বিভিন্ন হাসপাতাল সূত্র বলছে, ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা আরো বেশি হবে। চলতি মাসের ১৭ দিনে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১১ হাজার ৩৫৭ জন। গত মাসে এই সংখ্যা ছিল ৫২ হাজার ৬৩৬ জন। জুলাই মাসে ১৬ হাজার ২৫৩ জন, জুনে ১ হাজার ৮৮৪ জন, মে মাসে ১৯৩ জন, এপ্রিলে ৫৮ জন, মার্চে ১৭ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১৮ জন এবং জানুয়ারিতে ৩৮ জন ভর্তি হন। এদিকে ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৬১৫ জন ডেঙ্গু রোগী।

http://mzamin.com/article.php?mzamin=190769