১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯, সোমবার, ১:২৮

সরকারি গাড়ি অপব্যবহারে নির্বিঘ্ন মহোৎসব

সুদমুক্ত ঋণ সুবিধায় গাড়ি কেনার পরও বেশিরভাগ কর্মকর্তা দেদার ব্যবহার করছেন সরকারি গাড়ি * খোদ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে যথেচ্ছ অপব্যবহার, এক কর্মকর্তা ৬৭ দিনে জ্বালানি তেল নিয়েছেন ৮৪৪ লিটার

প্রশাসনে সরকারি গাড়ি অপব্যবহারের রীতিমতো মহোৎসব চলছে। কিন্তু এ নিয়ে প্রশ্ন তোলার যেন কেউ নেই। এখন পর্যন্ত প্রায় ৪ হাজার কর্মকর্তাকে সুদমুক্ত সুবিধায় ৩০ লাখ টাকা করে গাড়ি কেনার বিশেষ সুযোগ দেয়া হয়েছে। কিন্তু যানবাহন খাতে রাষ্ট্রের অর্থব্যয় সাশ্রয় হচ্ছে না।

বেশিরভাগ কর্মকর্তা আগের মতো মন্ত্রণালয় ও দফতর সংস্থার গাড়ি ব্যবহার করছেন। কেউ কেউ প্রকল্পের দামি গাড়ি হাঁকাচ্ছেন দিনরাত।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অধিকাংশ মন্ত্রণালয় ও বিভাগে গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণ ও জ্বালানি ব্যয় আগের তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে। খোদ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ও এ অনিয়মের বাইরে নয়। এখানকার যেসব কর্মকর্তা ঋণ সুবিধায় গাড়ি কিনেছেন, তাদের অনেকে মন্ত্রণালয়ের গাড়ি ব্যবহার করছেন।

এ ছাড়া জ্বালানি তেল নিচ্ছেন দেদার। একজন অতিরিক্ত সচিব ৬৭ দিনে জ্বালানি নিয়েছেন ৮৪৪ লিটার, যা অবিশ্বাস্য বটে।

প্রসঙ্গত, যুগ্ম সচিব থেকে তদূর্ধ্ব পদমর্যাদার কর্মকর্তারা ২০১১ সাল থেকে গাড়ি কেনার ঋণ সুবিধা পাচ্ছেন। পরবর্তী সময়ে উপসচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তাদেরও এ সুবিধার আওতায় আনা হয়। এখন পর্যন্ত ৩ হাজার ৭১৯ জন কর্মকর্তা ঋণ সুবিধায় গাড়ি কিনেছেন। এটি সম্পূর্ণ সুদমুক্ত ঋণ।

বরং নির্দিষ্ট হারে অবচয় বাদ দিয়ে একজন কর্মকর্তাকে শেষ পর্যন্ত ঋণ পরিশোধ করতে হবে ১০-১২ লাখ টাকা। তাছাড়া গাড়ির চালক ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় হিসেবে প্রতি মাসে অতিরিক্ত ৫০ হাজার টাকা ভাতা দেয়া হয়। নীতিমালা অনুসরণ করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পরিবহন শাখা থেকে এ ঋণ সুবিধা দেয়া হয়।

সরকারি পরিবহন পুল ও গাড়ি চালকদের কয়েকটি সূত্র জানায়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এপিডি উইংয়ের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ঋণ সুবিধায় সরকারি গাড়ি নেয়ার পরও দিব্যি ফুলটাইম সরকারি গাড়ি ব্যবহার করছেন। তার ব্যবহারিত সরকারি গাড়িতে গত ৪ জুলাই থেকে ৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৮৪৪ লিটার অকটেন নেয়া হয়েছে।

এই জ্বালানি তেল নেয়া হয় রাজধানীর শাহবাগের মেঘনা পেট্রোলিয়াম তেল পাম্প থেকে। এখান থেকে বেশিরভাগ সরকারি গাড়িতে জ্বালানি তেল নেয়া হয়। দেখা গেছে, ৪ জুলাই নেয়া হয়েছে ৭২ লিটার, ১০ জুলাই ৪৫, ১৬ জুলাই ৮১, ১৭ জুলাই ৪৭, ২৪ জুলাই ৪৯, ২৮ জুলাই ৫০, ১ আগস্ট ৬০, ৫ আগস্ট ৫০, ৬ আগস্ট ৫০, ৭ আগস্ট ৪৫, ১৯ আগস্ট ৪৮, ২০ আগস্ট ৫০, ২৬ আগস্ট ৪৭, ১ সেপ্টেম্বর ৫০, ৩ সেপ্টেম্বর ৫০ এবং ৮ সেপ্টেম্বর ৫০ লিটার।

জানা গেছে, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে জুলাই মাসে শুধু জ্বালানি বিল দেয়া হয়েছে ৯ লাখ ৮৮ হাজার ৬৪৯ টাকা। ঈদের জন্য কয়েকদিন বন্ধ থাকার পরও আগস্ট মাসে বিল এসেছে ৮ লাখ ১৬ হাজার ১১৬ টাকা। ১৫টি মাইক্রোবাস, ২৬টি কার, ১টি জিপ ও ৫টি মোটরসাইকেলের জন্য এই জ্বালানি ব্যয় করা হয়। এর মধ্যে যুগ্ম সচিবের (উনি) কার (গাড়ি নম্বর : ৮৫৭৭)-এর পেছনে জুলাই মাসে জ্বালানি ব্যয় ২৯ হাজার ৮১৫ টাকা, আগস্টে ১৬ হাজার ৭৩২ টাকা, যুগ্ম সচিবের (পরিবহন) কার (গাড়ি নম্বর : ৪৪০১)-এর পেছনে জুলাই মাসে জ্বালানি ব্যয় ১৪ হাজার ৯৫২ টাকা, আগস্টে ১০ হাজার ৬৮০ টাকা, অতিরিক্ত সচিবের (এপিডি) কার (গাড়ি নম্বর : ৩৭৮৩)-এর পেছনে জুলাই মাসে জ্বালানি ব্যয় ৩০ হাজার ৬১৬ টাকা, আগস্টে (গাড়ি নম্বর : ৫২৪) ৩১ হাজার ১৫০ টাকা, অতিরিক্ত সচিবের (বিধি)-এর কার (গাড়ি নম্বর : ৩৭১১)-এর জ্বালানি ব্যয় জুলাই মাসে ১০ হাজার ৬৮০ টাকা এবং আগস্টে ১০ হাজার ৬৮০ টাকা, যুগ্ম সচিবের (মাঠ প্রশাসন) কার (গাড়ি নম্বর : ৩৭০৮)-এর জ্বালানি ব্যয় জুলাই মাসে ১০ হাজার ৮৫৮ টাকা, আগস্টে (গাড়ি নম্বর : ৫৪৯৮) ১০ হাজার ৬৮০ টাকা, অতিরিক্ত সচিবের (প্রশাসন) কার (গাড়ি নম্বর : ০৪৯৮)-এর জ্বালানি ব্যয় জুলাই মাসে ২৫ হাজার ৩৬৫ টাকা এবং আগস্টে ২৮ হাজার ৪৮০ টাকা। এ ছাড়া অতিরিক্ত সচিবের (সিপিটি) কার (গাড়ি নম্বর : ৭৮০০)-এর পেছনে জুলাই মাসে জ্বালানি ব্যয় ৯ হাজার ৫২৩ টাকা এবং আগস্টে ১০ হাজার ৫৯১ টাকা।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রোববার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব ফয়েজ আহম্মদ যুগান্তরকে বলেন, যারা গাড়ি কেনার ঋণ সুবিধা পেয়েছেন, তারা অফিসে আসা-যাওয়ার ক্ষেত্রে সরকারি গাড়ি ব্যবহার করতে পারবেন না।

তবে সরকারি কাজে কোনো কর্মকর্তাকে যদি দূরে যেতে হয়, তাহলে তিনি রিকুইজিশন দিয়ে গাড়ি নিতে পারবেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এপিডি উইংয়ের অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ উদ্দীন চৌধুরী রোববার যুগান্তরকে বলেন, তিনি ঋণ সুবিধায় গাড়ি কিনেছেন। তবে অনেকদিন অফিস সময় শেষ হওয়ার পরও জরুরি প্রয়োজনে অফিসে অতিরিক্ত সময় কাজ করতে হয়। এ জন্য তখন ব্যক্তিগত গাড়ির পরিবর্তে অফিসের গাড়ি ব্যবহার করা হয়। তাছাড়া তিনি ব্যক্তিগত প্রাইভেট কার ব্যবহার করে থাকেন।

সূত্র জানায়, এসব গাড়ি যারা ব্যবহার করেন, এভাবে জ্বালানি তেল নিয়েছেন, তাদের প্রত্যেকে সরকারি ঋণ সুবিধায় প্রাইভেট কার কিনেছেন। এ ছাড়া একইভাবে যেসব কর্মকর্তা অফিসে আসা-যাওয়ার জন্য মন্ত্রণালয়ের মাইক্রোবাস ব্যবহার করছেন, তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা ঋণ সুবিধায় গাড়ি কিনেছেন।

কিন্তু বাস্তবতা হল- ঋণ সুবিধায় কেনা প্রাইভেট কার বেশিরভাগ কর্মকর্তা অফিসে যাতায়াতের কাজে ব্যবহার করছেন না। সেটি ব্যবহারিত হচ্ছে বাসাবাড়ির কাজে। কেউ আবার বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া ব্যবহার করেন না। অনেকে অফিসের সরকারি চালক দিয়ে মাঝেমধ্যে ব্যক্তিগত গাড়ি সচল রাখেন।

তবে পাশাপাশি এটিও সত্য যে, সৎ ও নীতিবান কর্মকর্তাদের অনেকে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সরকারি গাড়ি ব্যবহার করেন না।

ঋণ সুবিধায় গাড়ি কেনার পর থেকে তারা ব্যক্তিগত প্রাইভেট কার ব্যবহার করছেন। এমন কর্মকর্তাদের কয়েকজন যুগান্তরকে বলেন, এভাবে যারা ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন তারা প্রকারান্তরে দুর্নীতিই করছেন। কেননা, ঋণ সুবিধায় গাড়ি কেনার পর এভাবে সরকারি গাড়ি ব্যবহার করার কোনো নৈতিক অধিকার আর থাকে না।

এক প্রশ্নের জবাবে তারা বলেন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় একটি রেগুলেটরি মন্ত্রণালয়; সেখানে যদি এই অবস্থা হয় তাহলে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সংশ্লিষ্ট বৃহৎ মন্ত্রণালয়গুলোতে কী হচ্ছে সেটি সহজে অনুমান করা যায়। তারা মনে করেন, এটি সরকারের তরফ থেকে শক্তভাবে দমন করা প্রয়োজন। না হলে জনগণের ট্যাক্সের টাকার অপচয় আরও বেড়ে যাবে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/221005/