১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯, রবিবার, ১২:২৬

মালয়েশিয়ায় চরম ভোগান্তি বাংলাদেশী শ্রমিকদের

দালাল সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য

সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত হাজার হাজার শ্রমিক। ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় তারা সহায় সম্বল বিক্রি করে লাখ লাখ টাকা খরচ করে বিদেশে পাড়ি দিলেও একটি অসাধু চক্রের কারণে তাদের সেই স্বপ্ন ভেঙে যাচ্ছে। বাংলাদেশের শ্রমিকদের জিম্মি করে চক্রটি হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা।

নরসিংদীর মনোহরদী উপজেলার বাসিন্দা রফিক উদ্দিন ১০ বছর ধরে মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছেন। সেখানের একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে কৃষি খামারে কাজ করে কোনোভাবে টিকে আছেন। কিন্তু দশ বছরে বিদেশের মাটিতে কঠোর শ্রম দিয়েও ভাগ্যের তেমন উন্নয়ন ঘটেনি। ভিসার মেয়াদ বৃদ্ধি বা পাসপোর্ট করানোর নামে দালাল সিন্ডিকেট হাতিয়ে নিচ্ছে তার টাকা। অভিযোগ করেন, ভিসা অথবা পাসপোর্টের মেয়াদ বাড়াতে তারা মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশনের দারস্থ হন। কিন্তু সেখানে গিয়েও তারা দালাল সিন্ডিকেটের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছেন না। দালালদের কবলে পড়ে দুই থেকে তিন গুণ টাকা খরচ করে তাদের প্রয়োজন সারাতে হচ্ছে। এতে করে তারা সর্বস্বান্ত হচ্ছেন।

এভাবে ঝিনাইদহের শিপন, রাজবাড়ীর ইয়াকুব, খোরশেদ, শরিয়তপুরের খোকন, শাহ আলম, কুমিল্লার দেলোয়ার, খুলনার সবুজ, কুষ্টিয়ার হাসমত, নওগাঁর কাফি, টাঙ্গাইলের রফিকসহ মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত হাজার হাজার শ্রমিক দালাল সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে সিমাহীন দুর্ভোগের মধ্যে রয়েছেন।

শ্রমিকরা অভিযোগ করেন, মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত কয়েক লাখ শ্রমিকের ভাগ্য নিয়ে খেলছে ১০টি দালাল সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের অন্যতম হোতা হচ্ছেন আমিনুল ইসলাম বিন আব্দুল নূর। যিনি সেখানে দাতু আমিন নামে পরিচিত। তার নেতৃত্বে হাজার হাজার বৈধ ও অবৈধ বাংলাদেশী শ্রমিকদের জিম্মি করে হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। ভুক্তভোগী শ্রমিকদের অভিযোগ, মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশন নিয়ন্ত্রণ করছে এই ১০ দালাল সিন্ডিকেটকে। মালয়েশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশ হাইকমিশনার শহীদুল ইসলামকে হাত করে সিন্ডিকেটের হোতা আমিনুল ইসলাম এই অবৈধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন। অভিযোগ রয়েছে, একই স্থানে ৯ বছর ধরে দায়িত্বে থাকা হাইকমিশনার বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির সাথে জড়িত। তার আশ্রয়-প্রশ্রয়ে গড়ে ওঠা দালাল সিন্ডিকেটের কারণে মালয়েশিয়ায় অবস্থানকারী বৈধ ও অবৈধ মিলে প্রায় ৬ লাখ শ্রমিকের ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে।

ভুক্তভোগী শ্রমিকদের অভিযোগ, পাসপোর্ট নবায়নের নামে চলে লুটপাট। নবায়ন বিল হিসেবে প্রতিটি পাসপোর্টে ব্যক্তির কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। এমনকি মালয়েশিয়ায় স্থায়ীভাবে বসবাসকারী লোকজনের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। অভিযোগ রয়েছে, এ সব কিছু কর্মকাণ্ডের মূলে রয়েছেন দালাল সিন্ডিকেটের হোতা আমিনুল ইসলাম। হাইকমিশনকে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে এই কাজ চালিয়ে যাচ্ছে সে।

জানা গেছে, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বারবার হোঁচট খাচ্ছে কোনো না কোনো দুষ্টুচক্রের কবলে পড়ে। বিশেষ করে সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে বেশি টাকা আদায় করার অভিযোগে বারবার বন্ধ হয়েছে বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় শ্রমিক রফতানি।

অভিযোগ রয়েছে, বরাবরই এই চক্র বা সিন্ডিকেট গড়ে ওঠে একটি নির্দিষ্ট বলয়কে ঘিরে। যার কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে কুয়ালালামপুরে বাংলাদেশ হাইকমিশনে। তবে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মাধ্যমে শ্রমবাজারের সিন্ডিকেট বা চক্র নিয়ে অনেক টানা-হেঁচড়া, আলোচনা-সমালোচনা হলেও এর মূল হোতা কুয়ালালামপুরে অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশনের কিছু কর্মকর্তার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেনি কেউ। বরাবরই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে অঢেল বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়েছেন এসব কর্মকর্তা আর হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় শ্রমবাজারকে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পরিবর্তনের অঙ্গীকার নিয়ে ক্ষমতায় আসা ডক্টর মাহাথির মোহাম্মদ ক্ষমতা গ্রহণের কয়েক মাস পেরোতেই এক সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেন, বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক আনায় ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে। স্পষ্টই জানিয়ে দেন শ্রমিক আনতে দশটি লাইসেন্স যে সিন্ডিকেট করেছে বা দশ লাইসেন্সকে যে অনুমতিপত্র দেয়া হয়েছে তা সঠিক ছিল না এবং এ প্রক্রিয়ায় ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। নতুন প্রক্রিয়া চালু করে আগের সিন্ডিকেট বাতিলেরও ঘোষণা দেন তিনি।

তবে বরাবরের মতো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে সিন্ডিকেটের মূল হোতা আমিনুল ইসলাম। মালয়েশিয়াস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনার শহীদুল ইসলামের আশ্রয়-প্রশ্রয় থাকায় সে বরাবরই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে মূলত হাইকমিশনারই দশ সিন্ডিকেটকে চুক্তি করতে সহযোগিতা করেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, যদিও শ্রমবাজার চালুর আগে হাইকমিশনার বিভিন্ন সভা-সমাবেশে সিন্ডিকেটের বাইরে গিয়ে কম খরচে শ্রমিক আনার প্রতিশ্রুতি দেন মালয়েশিয়া প্রবাসী বাংলাদেশী লোকজনের কাছে। তবে দিনশেষে তিনি সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে যে লোক দেখানো বিরোধিতা করেছিলেন তা পরবর্তিতে স্পষ্ট হয়। কারণ হাইকমিশনার সিন্ডিকেটকে স্বাগত জানিয়ে ঢাকা থেকে কুয়ালালামপুরে আসা শ্রমিকবাহী প্রথম ফ্লাইটটি বরণ করে নিতে কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরে যান এবং কৌশলে শ্রমিকদের দিয়ে বলতে বাধ্য করান যে, তারা ৩৫ হাজার টাকায় বাংলাদেশ থেকে এসেছেন।

কিন্তু এসব করেও শ্রমিকরা সিন্ডিকেটের কবল থেকে পার পাচ্ছেন না। বিদেশের মাটিতে কঠোর পরিশ্রম করে উপার্জিত তাদের অর্থের বেশির ভাগই চলে যাচ্ছে দালাল সিন্ডিকেটের পকেটে। ফলে তারা সিমাহীন দুর্ভোগে দিন কাটাচ্ছেন।

http://www.dailynayadiganta.com/last-page/440200/