১২ সেপ্টেম্বর ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ৬:০৩

নেপথ্যে প্রকৌশলী-ঠিকাদারের চক্র

মহাসড়ক মেরামতে ব্যয়-উল্লাস

ভারত, চীন, ইউরোপের বিভিন্ন দেশের তুলনায় বাংলাদেশে মহাসড়ক নির্মাণ ব্যয় প্রতি কিলোমিটারে সবচেয়ে বেশি। উন্নত দেশগুলোয় মহাসড়ক নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ও গাড়ির ওজন নিয়ন্ত্রণের ফলে টেকেও নির্ধারিত আয়ুর সমান। তবে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের প্রকৌশলী-ঠিকাদারদের চক্র নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ প্রায় বাদ দিয়ে নিয়মিত মেয়াদি প্রকল্প নিয়ে এমন অবস্থা তৈরি করেছে যে কয়েক বছরে মেরামতে যে ব্যয় করা হচ্ছে তা দিয়ে নতুন মহাসড়ক নির্মাণ করা যায়। নিজেদের চোখের সামনে ছোট গর্ত বড় হলে জনগণের দুর্ভোগকে পুঁজি করে স্থানীয় সংসদ সদস্যদের অনুরোধপত্র কাজে লাগিয়ে প্রকৌশলী-ঠিকাদাররা এই চক্র জিইয়ে রাখছে। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে এখনো জমে আছে সংসদ সদস্যদের এ কাজের অনুরোধ তথা ডিও লেটার-আধাসরকারি পত্র।

সওজ অধিদপ্তরের প্রকৌশলীরা জানান, নতুনভাবে নির্মাণের পর ২০ বা ১০ বছর, পুনর্নির্মাণের পর ১০ বছর, মেরামতের পর পাঁচ বছর টেকে মহাসড়ক।

২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত ১০ বছরে সওজ অধিদপ্তর মহাসড়ক নির্মাণ, মেরামত ও প্রশস্ত করতে ৫৭ হাজার ৫২৮ কোটি টাকা খরচ করেছে। এক হাজার কিলোমিটার বাদ দিয়ে সব মহাসড়কে মেরামত বা উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। কিন্তু এত অর্থ খরচের পরও মেরামতকাজ টিকছে না। প্রতিবছরই মেয়াদি প্রকল্প বা কর্মসূচি নেওয়া হচ্ছে। চলতি অর্থবছরে মেয়াদি মেরামতের জন্য ৫৪ জেলায় কিলোমিটারপ্রতি গড়ে এক কোটি ৪৩ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে।

সওজ সূত্রে জানা গেছে, ১০ বছরে রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় চার গুণ বেড়েছে। নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ, দু-তিন বছর পর হালকা মেরামত, ৫-১০ বছর পর ভারী মেরামত ও দুর্যোগের পর জরুরি মেরামত—এই চার ধাপে সড়ক মেরামত করার বরাদ্দ থাকে। তবে নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ এড়িয়ে যান সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী-ঠিকাদাররা। তাতে ব্যয় বাড়ছে মন্তব্য করে বুয়েটের অধ্যাপক ড. সামছুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ছোট গর্ত বড় না হলে এ দেশে মহাসড়ক উন্নয়ন কাজ হয় না।

দেখা গেছে, সামান্য বিটুমিন দিয়ে গর্ত ভরাট না করে বা পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না করে প্রকৌশলীরা প্রতিবছর মেরামতের পেছনে সরকারের টাকা খরচ করতে চাইছেন। তার বড় কারণ প্রকৌশলীদের কমিশন বাণিজ্য।

ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন মহাসড়ক নির্মাণে কিলোমিটারে ব্যয় হয়েছে ১৯ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। তদুপরি চলতি অর্থবছরে মহাসড়কের স্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে ৭৯৩ কোটি ১৪ লাখ টাকার প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। তাতে এক দফায়ই মেরামতে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় হবে প্রায় চার কোটি টাকা। ২০১৬ সালের জুলাইয়ে উদ্বোধনের পর সওজ অধিদপ্তর বলেছিল, ১০ বছরের আয়ুষ্কাল থাকবে এ মহাসড়কের। চার লেন প্রকল্পের একাধিক কর্মকর্তা জানান, এই মহাসড়কে ১০ বছরে ওজন বহনের মাত্রা ধরা হয়েছিল ৯ কোটি ৮০ লাখ এক্সেল, কিন্তু দেড় বছরেই এই পরিমাণ ওজন মহাসড়কের ওপর দিয়ে চলে যাওয়ায় এটি ঝুঁকিপুর্ণ হয়ে পড়তে শুরু করেছে। জানা গেছে, ৯ বছরে ছয় দফা ব্যয় বাড়িয়ে মহাসড়কটি দুই লেন থেকে চার লেন করা হয়েছে। মহাসড়কের স্থায়িত্ব ধরে রাখার জন্য নতুন প্রকল্পের আওতায় সড়ক বাঁধ, ওয়্যারিং কোর্স, র‌্যাট কারেকশন করা হবে।

স্থায়িত্ব ধরে রাখতে এ মাসে প্রকল্প অনুমোদন হলেও একই মহাসড়কের কাজলা থেকে শিমরাইল পর্যন্ত সাত হাজার ৬০০ মিটার সংস্কারে পিরিয়ডিক মেইনটেন্যান্স প্রগ্রামের (পিএমপি) আওতায় প্রায় ২১ কোটি টাকার বরাদ্দ অনুমোদন করা হয়েছে, এ অংশে প্রতি কিলোমিটার সংস্কারে খরচ হবে দুই কোটি টাকার বেশি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের ৮ দশমিক ৪ কিলোমিটার সংস্কারে পাঁচ বছরে ব্যয় হয়েছে ৩০ কোটি টাকা, প্রতি কিলোমিটারে খরচ হয়েছে সাড়ে তিন কোটি টাকার বেশি। এ সড়ক মেরামতে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১৮ কোটি ১৪ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। চার লেনের আঞ্চলিক মহাসড়কে ২০১৪ সালের ৬ এপ্রিল থেকে ৫ সেপ্টেম্বর বিটুমিনের গভীর আস্তরণ দিলেও সওজ অধিদপ্তরই প্রতিবেদনে বলেছিল, নিম্নমানের কাজের ফলে বছর না যেতেই ছয় কিলোমিটার অংশে গর্ত ও সরু ফাটল দেখা দেয়। এভাবে প্রতিবছর মেরামতের জন্য বরাদ্দ দেওয়ার পর কাজ হচ্ছে, কিন্তু সড়কটি ভেঙে যাচ্ছে বা গর্ত তৈরি হচ্ছে।

হাটিকুমরুল-চান্দাইকোনা ও হাটিকুমরুল-বনপাড়া মহাসড়কের অংশ পড়েছে সিরাজগঞ্জ সড়ক বিভাগের অধীনে। গত ঈদুল ফিতরের আগে এসব মহাসড়কসহ বিভিন্ন মহাসড়ক মেরামত করা হয়। তার পরও বাস্তবে ‘মেরামত’ শেষ হয়নি। এবার বন্যায় দেশে যে ২৬ জেলার মহাসড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সিরাজগঞ্জ জেলার। এর দৈর্ঘ্য ১৮৫ কিলোমিটার। সিরাজগঞ্জ সড়ক বিভাগের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মোহাম্মদ আনোয়ার পারভেজ বলেন, হাটিকুমরুল-বনপাড়া মহাসড়কের ২৫ কিলোমিটারের মধ্যে ১৬ কিলোমিটারের মেরামত এক বছর আগে শেষ হয়েছে। এ অর্থবছরে বাকি ৯ কিলোমিটারের মেরামত করতে ২৮ কোটি টাকার দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু সেতু উদ্বোধনের পর ১৯৯৮ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত সাড়ে ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫৫ কিলোমিটার হাটিকুমরুল-বনপাড়া মহাসড়ক নির্মাণ করা হয়। ব্যয় হয় কিলোমিটারপ্রতি প্রায় ছয় কোটি টাকা। সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে জানা গেছে, এই মহাড়কের খালকুলা থেকে মান্নাননগর পর্যন্ত ৯ কিলোমিটার অংশ প্রতিবছর যান চলাচলের অনুপযোগী থাকছে। এই অংশ মেরামতেই অংশটুকুর নির্মাণ ব্যয়ের চেয়ে এ পর্যন্ত তিন গুণ বেশি অর্থ খরচ হয়ে গেছে। উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মোহাম্মদ আনোয়ার পারভেজ বলেন, মাছবাহী গাড়ির পানিতে এ মহাসড়ক নষ্ট হচ্ছে। সিরাজগঞ্জ সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুল ইসলাম বলেন, এবার এক বছরের মধ্যেই অবশিষ্ট কাজ শেষ করতে হবে।

যশোর-খুলনা মহাসড়কে মেরামতে ধীরগতিতে সম্প্রতি একনেক সভায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী। যশোরের পালবাড়ী থেকে অভয়নগর উপজেলার রাজঘাট পর্যন্ত ৩৪ কিলোমিটার মেরামতে ২০১৩ সালে ২২ কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। সময়মতো কাজ হয়নি। একপর্যায়ে ২০১৪ সালে সড়কমন্ত্রী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করেন। পরে অন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেরামতকাজ শেষ করে। গত অর্থবছর থেকে ৩২১ কোটি টাকার উন্নয়নকাজ শুরু হয়েছে।

বগুড়া সড়ক বিভাগের ৬৫ কিলোমিটার মহাসড়ক মেরামতে কয়েক বছরের ব্যবধানে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ১০০ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২৩ কোটি ৪২ লাখ টাকা ব্যয় হয়। এ অর্থবছরে বরাদ্দ আছে ১৮ কোটি টাকা। পিরিয়ডিক মেইনটেন্যান্স প্রগ্রামের (পিএমপি) আওতায় এবারও এ সড়ক বিভাগে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

এ অর্থবছর যশোরে ক্যান্টনমেন্ট-স্বাধীনতা সরণি সড়কের এক কিলোমিটার মেরামতেই ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ছয় কোটি টাকা, যা অন্যান্য মহাসড়কের মেরামতকাজের চেয়ে তিন গুণের বেশি। রাজশাহী শহর বাইপাসের মেরামতে কিলোমিটারে ব্যয় ধরা হয়েছে গড় ব্যয়ের দ্বিগুণের বেশি।

সওজ অধিদপ্তর ৫৪টি জেলায় ৮৭০ দশমিক ৩৮ কিলোমিটার ক্ষতিগ্রস্ত মহাসড়ক স্থায়ীভাবে মেরামত করতে প্রায় এক হাজার ২৪৫ কোটি টাকার বরাদ্দ পাচ্ছে। গত ২৯ আগস্ট সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় বরাদ্দসংক্রান্ত নির্দেশ দিয়েছে সওজ অধিদপ্তরে। তাতে গড়ে প্রতি কিলোমিটার মহাসড়ক মেরামতে ব্যয় হবে প্রায় এক কোটি ৪৩ লাখ টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরের পিএমপির আওতায় এসব বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। মন্ত্রণালয় থেকে ১০ কোটি টাকার বেশি মূল্যের প্যাকেজ (অংশ) করাসহ ২৯টি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে সওজকে। দেখা গেছে, সম্প্রতি নির্মাণ ও সংস্কার হয়েছে এমন মহাসড়কও মেরামত করা হবে এ কর্মসূচির আওতায়। সবচেয়ে বেশি মহাসড়কের অংশ মেরামত করা হবে চট্টগ্রাম জোনে—১১৩ কিলোমিটার, সবচেয়ে কম ময়মনসিংহ জোনে—৫৮ কিলোমিটার।

চার লেনে ব্যয় আরো বাড়ছে : ভারতে নতুন চার লেনের মহাসড়ক নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় হয় সাড়ে ১০ কোটি টাকা, চীনে তা ১০ কোটি টাকা, ইউরোপে তা ২৯ কোটি টাকা। বাংলাদেশের ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা মহাসড়কসহ ছয়টি প্রকল্পেই নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছিল কিলোমিটারে ৫৪ কোটি টাকা, তা তিন বছরে আরো বেড়েছে। যেমন ঢাকা-সিলেট চার লেন মহাসড়কে ব্যয় ধরা হয়েছে কিলোমিটারে ৫৩ কোটি টাকা। ৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ জয়দেবপুর-এলেঙ্গা চার লেনে কিলোমিটারে ব্যয় হচ্ছে ৫৮ কোটি আট লাখ ১৪ হাজার টাকা। এলেঙ্গা-রংপুর চার লেন প্রকল্পে কিলোমিটারে ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৩ কোটি টাকা।

ভূমি অধিগ্রহণ, যানবাহনের আলাদা সার্ভিস লেন, উড়াল সড়ক নির্মাণে ব্যয় বাড়ছে বলে সওজ অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী হাসান ইবনে আলম দাবি করেছেন। তবে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) বিশেষজ্ঞদের গবেষণা অনুযায়ী, চার লেন মহাসড়কের কিলোমিটার প্রতি নির্মাণ ব্যয় ১২ কোটি টাকা হওয়ার কথা।

দ্বিগুণ ওজনে ১৬ গুণ ক্ষতি : সওজ অধিদপ্তরের ঢাকা সড়ক সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সবুজ উদ্দিন খান বলেন, ‘মহাসড়কে একটি গাড়ি সর্বোচ্চ ২২ টন ওজন বহন করতে পারবে। শেষ পর্যন্ত মন্ত্রণালয় তা ৩০ টন পর্যন্ত অনুমোদন দিয়েছে। এখন বালু ও পাথরবাহী গাড়ি ৫০ টন বা এর চেয়েও বেশি ওজন পরিবহন করছে। নির্ধারিত ওজনের দ্বিগুণ ওজন বহন করলেই মহাসড়কের ১৬ গুণ ক্ষতি হয়। এ নিয়ে আমরা বড় সমস্যায় আছি।’

ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডে বেশি ওজনবাহী গাড়ি চলছে। তার ওপর এর দেড়-দুই কিলোমিটারের মাটির নিচের অংশ নাজুক উল্লেখ করে সবুজ উদ্দিন খান স্বীকার করেন, ‘মেরামতে অর্থ খরচ হলেও তা টিকছে না। এ জন্য সড়কটি নতুন করে নির্মাণ করতে হবে।’

সওজ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, গাড়ির অতিরিক্ত ওজন নিয়ন্ত্রণের জন্য বিভিন্ন মহাসড়কে ২১টি ওজন স্কেল স্থাপনের জন্য গত ৩ সেপ্টেম্বর এক হাজার ৬৩০ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন করা হয়েছে একনেক বৈঠকে। এগুলো স্থাপন করা হবে গাজীপুর সদর, কেরানীগঞ্জ, হালুয়াঘাট, নালিতাবাড়ী, বুড়িচং, ফেনী সদর, সাতকানিয়া, চট্টগ্রাম সদর, সীতাকুণ্ড, নবীগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, রামপাল, সাতক্ষীরা সদর, দামুড়হুদা, শিবগঞ্জ, হাকিমপুর, রৌমারী, তেঁতুলিয়া, সৈয়দপুর, শিবচর ও কালিহাতী উপজেলায়।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2019/09/12/813704