সড়ক দুর্ঘটনা। ফাইল ছবি
১০ সেপ্টেম্বর ২০১৯, মঙ্গলবার, ১২:৪১

মামলা-জরিমানা বাড়লেও শৃঙ্খলা ফেরেনি সড়কে

২০১৮ সালে জরিমানা আদায় ৮৬ কোটি টাকা * শুধু মামলা ও জরিমানা করে আচরণে পরিবর্তন আনা সম্ভব নয় : অধ্যাপক ড. আবদুল হাকিম

সড়ক-মহাসড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে মামলা ও জরিমানার হার বাড়লেও দূর করা যায়নি দীর্ঘ দিনের চেপে বসা বিশৃঙ্খলা। রাস্তা পারাপারে যাত্রীদের সচেতনতা যেমন বাড়েনি, তেমনি বন্ধ করা যায়নি বাসের পাল্লাপাল্লি ও রেষারেষি।

একটি আরেকটিকে পেছনে ফেলতে গিয়ে কখনও আস্ত বাস উঠে যাচ্ছে ফুটপাতে। এতে কেউ পা-হারাচ্ছেন আবার কারও জীবন যাচ্ছে। তবে ট্রাফিক আইনে মামলা ও জরিমানার দিকে তাকালে অবশ্য বোঝা যায় ট্রাফিক পুলিশের তৎপরতা বেড়েছে।

২০১৫ সালে ঢাকায় ট্রাফিক আইনে যেখানে ৫ লাখ ৬৬ হাজার ৬৭টি মামলায় জরিমানা করা হয় ১৮ কোটি ২৮ লাখ ৯৫ হাজার ৯৫০ টাকা। এ বছর জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতেই মামলার সংখ্যা গিয়ে ঠেকেছে ৩ লাখ ৯৮ হাজার ৮০২টিতে।

জরিমানা করা হয়েছে ১৭ কোটি ৮৭ লাখ ৩২ হাজার টাকা। এরপরও বাস্তব অবস্থা হচ্ছে- নগরীতে সড়কে বিশৃঙ্খলা চলছেই। সড়কে এখনও চলছে লক্কড়-ঝক্কড় বাস। যেখানে-সেখানে বাস থামিয়ে যাত্রী উঠানো, পাল্লা দিয়ে গাড়ি চালানো, সিটিং সার্ভিসের নামে বাড়তি ভাড়া আদায়, প্রাইভেট কার চালানোর লাইসেন্স নিয়ে বাধাহীনভাবে চালাচ্ছেন বড় বাস।

অনেক সময় লাইসেন্সও থাকে না। বেপরোয়া গাড়ি চালানোর প্রবণতা তো আছেই। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে পুলিশ ও মালিক পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে নানা প্রতিশ্রুতি দেয়া হলেও বাস্তবে এর কোনো প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। বিভিন্ন সড়কে কোম্পানিভিত্তিক বাস চালানোর প্রতিশ্রুতি তো চাপাই পড়ে গেছে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থার কারণেই সড়কে শৃঙ্খলা ফিরছে না। উন্নত বিশ্বেও মামলা ও জারিমানা হয়। তবে উন্নত বিশ্বে মামলার টাকা পরিশোধ করতে হয় চালককে, আর আমাদের দেশে তা পরিশোধ করেন মালিক পক্ষ।

তিনি বলেন, যতক্ষণ চালককে লাগাম লাগানো না যাবে ততক্ষণ এর সুফল মিলবে না। তিনি বলেন, আমাদের দেশে যে সব গাড়ির কাগজপত্র ঠিক থাকে সেই সব গাড়িতেই মামলা এবং জরিমানা বেশি হয়। অথচ যে গাড়ি ভাঙাচোরা, যার কাগজপত্রই নাই সেখানে মামলা হয় না।

কারণ তারা মাসোহারা দেয়। আইন প্রয়োগের সঙ্গে জড়িতরা দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক ভিত্তিক অর্থ পেয়ে থাকেন। তিনি বলেন শুধু মামলা-জরিমানা করে সড়কে যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয় তার প্রমাণ ডিএমপির মামলা এবং জরিমানার চিত্র।’

৫ সেপ্টেম্বর রাজধানীর উত্তরায় ভিক্টর পরিবহনের বাসের চাপায় প্রাণ হারান সঙ্গীত পরিচালক কণ্ঠশিল্পী পারভেজ রব, এর ঠিক ২ দিন পর উত্তরায়ই ওই একই ভিক্টর পরিবহনের বাসের চাপায় গুরুতর আহত হন পারভেজ রবের ছেলে আলভী ও তার বন্ধু মেহেদী হাসান ছোটন।

ছোটন পরে হাসপাতালে মারা যান। ওই একই দিন রাজধানীর মহাখালী-বিমানবন্দর সড়কে বনানীতে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থাকা কর্মজীবী নারী ফারহানাকে একটি যাত্রীবাসী বাস চাপা দিলে তিনি প্রাণ হারান।

গত মাসের শেষ সপ্তাহে রাজধানীর বাংলামোটরে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থাকা বিআইডব্লিউটিসির এক নারী কর্মকর্তাকে একটি বাস চাপা দিলে শরীর থেকে তার পা-বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। রাজধানীবাসীর প্রশ্ন ফুটপাতও যদি এভাবে পথচারীদের জন্য অনিরাপদ হয়ে উঠে তা হলে মানুষ কী ঘরে বসেই থাকবে। এভাবে চলতে পারে না।

কথা হয় ঢাকা মহানগর ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্বে থাকা ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মফিজ উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে। তিনি রাজধানীর ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে থাকার দাবি করে যুগান্তরকে বলেন, মামলা দেয়ার কারণেই আগের চেয়ে ট্রাফিক ব্যবস্থা বেশ নিয়ন্ত্রণে আছে।

তিনি জানান, ট্রাফিক ব্যবস্থায় জরিমানা বিশ্বব্যাপী। এটা একটা বৈধ পদ্ধতি। এটা আছে বলেই ঢাকা শহরে লাখ লাখ গাড়ি চলে, শৃঙ্খলা ধরে রাখা গেছে, তা না হলে আরও খারাপ অবস্থা হতো। দুর্ঘটনা ও অনিয়ম আরও বেশি হতো।

তিনি বলেন, মামলা এবং জরিমানা যে আহামরি বৃদ্ধি পেয়েছে বিষয়টি এমন নয়। তিনি বলেন, সম্প্রতি রজধানীতে বেশ ক’টি বড় দুর্ঘটনায় আন্দোলন হয়েছে। সে কারণে ট্রাফিক সচেতনতার সঙ্গে ট্রাফিক শৃঙ্খলায় পুলিশ বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। আইন প্রয়োগ বেড়েছে। তিনি বলেন, তবে মামলা দেয়ার ব্যাপারে সার্জনদের ওপরে চাপ নেই।’

ঢাকা মহানগর ট্রাফিক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ সালে ট্রাফিক আইনে ঢাকায় ৫ লাখ ৬৬ হাজার ৬৭টি মামলায় জরিমানা করা হয়েছে ১৮ কোটি ২৮ লাখ ৯৫ হাজার ৯৫০ টাকা। ২০১৬ সালে মামলা হয়েছে ৮ লাখ ৯২ হাজার ৭১৩টি।

জরিমানা করা হয়েছে ৪১ কোটি ২৫ লাখ ১৩ হাজার ৭৫৪ টাকা। ২০১৭ সালে মামলা হয়েছে ১০ লাখ ২১ হাজার ৬০৭টি। জরিমানা করা হয়েছে ৪০ কোটি ৭৫ লাখ ৫১ টাকা। ২০১৮ সালে মামলা হয়েছে ১৪ লাখ ৩৭ হাজার ৬৫টি।

জরিমানা করা হয়েছে ৮৬ কোটি ৯ লাখ ৪০১ টাকা। সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে মোটরসাইকেল, কাভার্ড ভ্যান, হিউম্যান হলার-লেগুনা ও সিএনজি অটোরিকশার ক্ষেত্রে। এ বছর প্রথম ২ মাসে মামলা হয়েছে ৩ লাখ ৯৮ হাজার ৮০২টি। জরিমানা ১৭ কোটি ৮৭ লাখ ৩২ হাজার টাকা।

ট্রাফিক বিভাগ বলছে, ড্রাইভিং লাইসেন্স, হেলমেট না থাকা, মোটরসাইকেলে অতিরিক্ত আরোহী নেয়া ছাড়াও কাগজপত্র না থাকা, যত্রতত্র পার্কিং, রুট পারমিট ও ফিটনেস না থাকার কারণে মামলা ও জরিমানা আদায় করা হয়েছে।

ঢাকায় কর্মরত একজন সার্জেন্ট জানান, মামলা কম হলেই দুশ্চিন্তা হয়। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা মনে করেন সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেননি। তেজগাঁও বিজয় সরণি এলাকায় কর্মরত সার্জেন্ট একটি মোটরসাইকেল দেখিয়ে বলেন, দেখেন বাইকগুলো উল্টোপথে যাচ্ছে। কারও কারও হেলমেট নেই। আটক করলে দেখা যাবে ড্রাইভিং লাইসেন্সও নেই। স্যাররা এসব দেখলে ক্ষেপে যান। তখন বাধ্য হয়েই মামলা দেয়ার প্রতিযোগিতায় নামতে হয়।

তবে গাড়িচালক ও মোটরসাইকেল আরোহীদের অভিযোগ, কোনো একটা সুযোগ পেলেই মামলা ঠুকে দেন সার্জেন্টরা। কখনও কখনও রেকার লাগানো হয়। ট্রাকচালক আবু জাফর জানান, রাতে রামপুরা এলাকায় তার ট্রাক থামিয়ে কাগজপত্র চেক করেন সার্জেন্ট।

সবকিছু ঠিক থাকার পর অতিরিক্ত পণ্য পরিবহনের অভিযোগে মামলা দেয়া হয়। একইভাবে প্রতিদিনই ট্রাক, কাভার্ড ভ্যানের বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয় বলে চালকদের অভিযোগ।

ঢাকা মহানগরীর ট্রাফিক ব্যবস্থার চিত্র তুলে ধরে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ড. আবদুল হাকিম সরকার যুগান্তরকে বলেন, শুধু মামলা ও জরিমানা করে মানুষের আচরণে পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে না।

মানুষের মধ্যে শৃঙ্খলাবোধ জাগ্রত করা প্রয়োজন। সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। এক্ষেত্রে অবশ্যই ট্রাফিক পুলিশকে অনভিপ্রেত ব্যবহার পরিবর্তন করে জনবান্ধব হতে হবে। সেইসঙ্গে ট্রাফিক ব্যবস্থা যুগোপযোগী করা প্রয়োজন। স্কুল, কলেজ ও শপিংমলে পার্কিং রাখতে হবে। আমরা প্রত্যেকে দায়িত্বশীল হলে শৃঙ্খলা আসবেই।’

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/219060/