৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯, শনিবার, ১১:৪৮

সুপথে ফিরতে চেয়ে লাশ!

ট্টগ্রামে আত্মসমর্পণের পর ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মৃত্যুতে তোলপাড়

থানায় আত্মসমর্পণের কয়েক ঘণ্টা পর পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে এক আসামির মৃত্যুর ঘটনায় চট্টগ্রামে তোলপাড় চলছে। পরিবারের দাবি দ্রুত আদালতে পাঠিয়ে দেওয়া হবে এমন আশ্বাসের ভিত্তিতেই বেলাল হোসেন (৪৩) নিজেই থানায় হাজির হয়েছিলেন। কিন্তু পুলিশ কথা রাখেনি, তাকে সুপথে ফিরে আসার কোন সুযোগ দেয়নি। তবে পুলিশের দাবি তাদের গুলিতে নয়, সহযোগীদের গুলিতেই বেলালের মৃত্যু হয়েছে। মানবাধিকার নেতারা বলছেন, আইনের আশ্রয় নেওয়ার পর তার জীবনের নিরাপত্তা দেয়া হয়নি, তাকে সাংবিধানিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত করা হয়েছে।

গত বুধবার বেলা দেড়টায় নগরীর খুলিশ থানায় আত্মসমর্পণ করেন বেলাল হোসেন। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার ভাষ্য ওইদিন রাত আড়াইটায় নগরীর জালালাবাদ পাহাড়ে বন্দুকযুদ্ধে তিনি মারা যান। বেলাল কুমিল্লার চান্দিনা থানার কঙ্গাই গ্রামের আব্দুল খালেক বাড়ির মৃত আব্দুল কাদেরের ছেলে। তিনি দীর্ঘদিন ধরে পরিবার নিয়ে চট্টগ্রাম নগরীর খুলশী থানাধীন আমবাগান পুকুর পাড় এলাকার নাজমুলের কলোনিতে থাকতেন।

পুলিশ জানিয়েছে, বেলালের নামে বিভিন্ন থানায় খুন, ডাকাতি ও মাদকের ১৩টি মামলা রয়েছে। নগরীর ১৩ নম্বর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের কমিশনার আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ হোসেন হিরণ গতকাল দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, দলের কোন পদ-পদবীতে না থাকলেও বেলাল ছিলো আওয়ামী লীগের তৃণমূলের কর্মী। সে আমার অনুসারি ছিলো। তার বিরুদ্ধে অপরাধের কিছু মামলা ছিলো জানিয়ে তিনি বলেন, বেশিরভাগ মামলা অনেক আগের। এসব মামলায় সে জামিনেও ছিলো। তবে দুটি মামলায় হুলিয়া ছিলো। কোন মামলায় তার সাজা হয়নি, সে ছিলো অভিযুক্ত। বেলাল ভাল হয়ে যেতে চেয়েছিলো বলেই থানায় হাজির হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, তাকে এই সুযোগ দেওয়া উচিত ছিলো। প্রধানমন্ত্রী নিজেও অপরাধীদের অপরাধ ছেড়ে সুপথে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। এ আহ্বানে অনেক অপরাধী আত্মসমর্পণও করেছে। ভাল হওয়ার অঙ্গিকার করে পুলিশের কাছে গিয়ে তার লাশ হওয়াকে আমরা মানতে পারছি না।

নিহতের পরিবারের অভিযোগ, সংশোধন হওয়ার সুযোগ পাওয়ার আশ্বাসে আত্মসমর্পণ করেন বেলাল। এরপর ওইদিন পরিবারের কাছ থেকে ‘৪৫ হাজার টাকা ঘুষ’ নেওয়ার পরও পুলিশ বেলালকে আদালতে হাজির না করে থানা হাজতে রাখে এবং রাতে অস্ত্র উদ্ধারে নিয়ে গিয়ে ‘ক্রসফায়ারে’ হত্যা করে। বেলালের বোন মিনু আক্তার সাংবাদিকদের বলেন, বেশির ভাগ মামলায় তিনি জামিনে ছিলেন। তার পরও তিনি পুলিশের ‘ক্রসফায়ারের’ ভয়ে পালিয়ে বেড়াতেন। গেল বছর ঢাকায় তার বাবা মারা যান। দাফন শেষে বাসা ফিরে আসতেই নগরীর অংলকার মোড় থেকে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। জামিন নিয়ে তিনি তবলিগে চলে যান, নিয়মিত নামাজ পড়েন। তিনি সব মামলা আইনিভাবে মোকাবেলা করে ভালো হয়ে যাওয়ার অঙ্গিকার করেন।

নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (উত্তর) বিজয় বসাকের সাথে যোগাযোগ করেই থানায় হাজির হন। মিনু বলেন, ঢাকা থেকে সরাসরি থানায় এসে হাজির হয়ে আমাদের ফোনে বিষয়টি জানান। তখন আমরা সবাই থানায় গিয়ে তাকে আদালতে প্রেরণের অনুরোধ করি। ওসি প্রণব চৌধুরী কথা দেন তাকে আদালতে চালান দেওয়া হবে। পরিবারের সদস্যরা পুলিশের কথা বিশ্বাস করলেও রাত ১০টা পর্যন্ত থানায় অবস্থান করেন। পরে একজন থানার বাইরে থাকতে চাইলে পুলিশ তাকেও বাসায় চলে যেতে বলে। পরদিন সকালে পরিবারের সদস্যরা নাস্তা নিয়ে থানায় এসে দেখে বেলাল হাজতে নেই। পুলিশ জানায় তাকে অভিযানে নেওয়া হয়েছে। ততক্ষণে খবর আসে বেলাল ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা গেছে।

বেলাল আত্মসমর্পনের আগে যোগাযোগ করেছেন স্বীকার করে নগর পুুলিশের উপ-কমিশনার বিজয় বসাক দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, আমরা তাকে থানায় হাজির হতে বলি। তবে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সে তার সহযোগীদের অস্ত্র থাকার কথা স্বীকার করে। সে একজন বড় ডাকাত তার কাছে অস্ত্র থাকা স্বাভাবিক। অস্ত্র উদ্ধারে গেলে তার সহযোগীরা তাকে ছিনিয়ে নিতে গুলি করে। ওই সময় পুলিশ শর্টগান থেকে ১০-১২ রাউন্ড কার্তুজের গুলি ছুঁড়েছে দাবি করে তিনি বলেন পুলিশের গুলিতে বেলাল মারা যায়নি। সে সন্ত্রাসীদের গুলিতে মারা গেছে। তাকে দ্রুত থানা থেকে আদালতে হাজির করতে পুলিশ ঘুষ নিয়েছে বলে পরিবারের অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটা সঠিক নয়, তবে পরিবারের পক্ষ থেকে লিখিত অভিযোগ পেলে পুলিশ তা তদন্ত করবে।

পুলিশের হাতে ধরা দেওয়ার পর জীবনের নিরাপত্তা পাওয়া একজন অভিযুক্তের সাংবিধানিক অধিকার উল্লেখ করে চট্টগ্রাম মহানগর আদালতের পিপি ও মানবাধিকার সংগঠনের নেতা অ্যাডভোকেট ফখরুদ্দিন চৌধুরী দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, এক্ষেতে তাকে ওই অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। বেলাল সাজাপ্রাপ্ত নন, অভিযুক্ত। তিনি অপরাধজগত থেকে ফিরে আসার ওয়াদা করে থানায় আসেন। পুলিশের উচিত ছিলো তাকে নিরাপত্তা দেওয়া এবং আদালতে হাজির করা। তবে কেন এবং কি পরিস্থিতি তার মৃত্যু হয়েছে তা তদন্ত সাপেক্ষ। এদিকে বেলালের মৃত্যুর পর নগরীর আমাবাগান এলাকায় আওয়ামী লীগের একাংশ শোক প্রকাশ করে তার জানাযা ও দাফনে হাজির হয়েছে। অন্য অংশ এলাকায় মিষ্টি বিতরণ করে। সরকারি দলের বিরোধের জেরে বেলালের এমন পরিনতি বলে জোর গুঞ্জন রয়েছে।

এ বিষয়ে বিশিষ্ট সমাজ বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. গাজী সালেহ উদ্দিন দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, পুলিশ চরম অন্যায় কাজ করেছে। বেলাল হোসেনকে সংশোধনের সুযোগ দেওয়া উচিত ছিলো। এতে অন্য অপরাধীরাও সুপথে আসতে উৎসাহিত হতো। এমন ঘটনার পর আর কেউ ভাল হওয়ার আশায় থানা-পুলিশে আত্মসমর্পণ করবে না। তিনি বলেন, কেউ অপরাধী হয়ে জন্মায় না। পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে অনেকে অপরাধে জড়ায়। তবে তাদের বিচারের পাশাপাশি সংশোধনের সুযোগ দেয়া দরকার। এক্ষেত্রে পুলিশ একটি সুযোগ হাতছাড়া করেছে।

https://www.dailyinqilab.com/article/232394/