নিহত মহসিন
৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯, শুক্রবার, ১১:২৯

কিশোর গ্যাং ছেড়ে আসায় খুন হয় মহসিন!

কিশোর গ্যাং ‘আতঙ্ক গ্রুপ গ্যাং স্টার’ থেকে সরে আসার কারণেই মোহাম্মদপুর চাইল্ড হ্যাভেন ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের দশম শ্রেণির বাণিজ্য বিভাগের ছাত্র মহসিনকে (১৮) হত্যা করা হয়েছে। প্রথমে আতঙ্ক গ্রুপের সদস্য আসিফ গত বুধবার সন্ধ্যায় মহসিনকে বাসা থেকে ঘটনাস্থলে ডেকে আনে। এরপর গ্রুপের ১০-১২ জন এসে তাঁকে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করতে থাকে। এ সময় কিছুটা দূরে থাকা মহসিনের কয়েকজন বন্ধু বাধা দিতে গেলে তাদেরও আহত করা হয়।

এর আগে ঘটনার দিন বিকেল ৩টার দিকে মহসিনের প্রেমিকা সুমাইয়াকে উত্ত্যক্ত করার প্রতিবাদ করায় মহসিনের ওপর ক্ষিপ্ত হয়েছিল আতঙ্ক গ্রুপের সদস্যরা।

এ ঘটনায় বুধবার রাতেই নিহত মহসিনের বড় ভাই ইউসুপ আলী বাদী হয়ে মোহাম্মদপুর থানায় একটি হত্যা মামলা (মামলা নম্বর ২৪) দায়ের করেন। মামলায় ১৩ জনকে আসামি করা হয়। আসামিরা হলো আসিফ (১৮), রকি (১৮), মিজান (১৮), শিশির (১৭), কাল্লু (১৭), সাইফুল (১৭), সুমন (১৮), জাহিদ (১৮), রুবেল (১৭), সোহেল (১৮), রিয়াজ (১৭), রাসেল (১৮) ও সাগর (১৮)। এদের মধ্যে আসিফ ও রকিকে বুধবার দিবাগত রাতে গ্রেপ্তার করা হয়। গতকাল বৃহস্পতিবার রুবেল, সোহেল ও ইমরান নামের আরো তিনজনকে আটক করা হয়।

গতকাল ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, দুপুরে স্কুল-কলেজের সময় হলেও বেশির ভাগ কিশোর রাস্তায় দলবদ্ধ হয়ে আড্ডা দিচ্ছে। চলছে মহসিন হত্যার আলোচনাও; যাদের অধিকাংশের বয়সই ১৮ বছরের কম। মাদারীপুর জেলার শিবচর থানার বাহেরতলা গ্রামের ইদ্রিস আলীর ছেলে নিহত মহসিন মোহাম্মদপুরের চাঁনমিয়া হাউজিংয়ের ১ নম্বর গলির আলম সাহেবের বাগানবাড়ির দ্বিতীয় তলায় পরিবারের সঙ্গে থাকতেন। তাঁর বাসায় এখন মা-বোনদের আহাজারি চলছে। দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে মহসিন সবার ছোট। মা লাইলি বেগম বাসাবাড়িতে রান্না ও ধোয়া-মোছার কাজ করেন। কয়েক বছর আগে তাঁর (মহসিন) বাবা ইদ্রিস আলী মারা যান।

লাইলি বেগম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বুইধবার বিহাল বেলা (৪টা) সাতমসজিদ থেইকা নামাজ পইড়া ঘরো আইলো। সইন্ধার সময় কেডা জানি ডাইকা নিয়া গেলো। পোলাটা আর ফিরা আইলো না।’ মহসিনের বড় বোন ইয়াসমিন বেগম বলেন, ‘আমার ভাইটার সামনে এসএসসি পরীক্ষা আছিলো। ক্লাস ফাইভে এ প্লাস পাইছিলো। ও তো আগে ঘুরলেও এহন কোনো পোলাপানের লগে ঘুরতো না।’

স্থানীয়রা বলছে, মোহাম্মদপুরে বেশ কয়েকটি কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা থানাহাজতে থাকলেও এ এলাকার কয়েকটি গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। এরা মাদক সেবনসহ বিভিন্ন ধরণের অপকর্মের সঙ্গে জড়িত। শামীম বাবু নামের এক স্থানীয় শ্রমিক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘এক্কুনি (ছোট ছোট) পোলাপানরা গ্যাং করছে। কাম করাইয়া টাহা দেয় না। খালি কয়, আমি এই ভাইয়ের লোক, ওই ভাইয়ের লোক।’

জানা যায়, আতঙ্ক গ্রুপ গ্যাং স্টার ও টাডালি গ্রুপ গ্যাংয়ের সদস্যরা মোহাম্মদপুরের ওই এলাকায় শোডাউন করে শক্তি প্রদর্শন, মাদক কেনাবেচা, নারী শিক্ষার্থীদের উত্ত্যক্ত করা, বিভিন্ন অসিলায় রাস্তা থেকে টাকা তোলা, নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাতেই ব্যস্ত থাকে।

ঘটনার সময় মহসিনের সঙ্গে আহত হন বন্ধু সাব্বির। তাঁর মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ সড়কের পশ্চিম পাশে হোসেন মার্কেটের দ্বিতীয় তলার বাসায় কথা হয়। ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা কয়েকজন ক্রিকেট খেলা নিয়ে আলোচনা করছিলাম। হঠাৎ কয়েকজন মহসিনের কলার ধরে নিয়ে আসে। আমি জানতে চাইলে এলোপাতাড়ি কোপানো শুরু করে। পরে শুনেছি মহসিনকে বাসা থেকে আসিফ ডেকে নিয়ে আসে।’

নিহত মহসিনের আরেক বন্ধু মিজান কালের কণ্ঠকে বলে, ‘মহসিন কয়েক মাস আগেও আতঙ্ক গ্রুপ গ্যাং স্টারের সঙ্গে আড্ডা দিত। কিন্তু পরে আর তাদের সঙ্গে কাজ না করায় গ্রুপের অন্যরা খ্যাপা ছিল। গত সপ্তাহে আতঙ্ক গ্রুপের আসিফের শরীরে মোটরসাইকেল চালানোর সময় ধাক্কা লাগলে বাগিবতণ্ডা হয়। তখন বিষয়টি মহসিন ও আসিফের বড় ভাইয়েরা মিটমাট করে দেয়। কিন্তু মহসিনের প্রেমিকা নিয়ে আবারও ঝামেলা হলে এমনটা ঘটল।’

মোহাম্মদপুর থানার ওসি গণেশ গোপাল বিশ্বাস কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ঘটনার সঙ্গে কোনো গ্যাং কালচারের ব্যাপার আছে কি না বলা যাচ্ছে না। তবে এলাকার কিছু পোলাপান ঢাকা উদ্যান ও আশপাশে আড্ডা দিত। তারা একসাথেই থাকত। কিন্তু পরে আলাদা হয়ে যায়। গত বুধবার বিকেলে মহসিন তার প্রেমিকাকে নিয়ে ঢাকা উদ্যানে ঘুরতে যায়। সেখানে কয়েকজনের সঙ্গে মহসিনের কথা-কাটাকাটি হয়। এরপর সন্ধ্যা ৭টার দিকে মহসিনের ওপর হামলা করা হয়।’

উল্লেখ্য, রাজধানীর মোহাম্মদপুরে কিশোর গ্যাং ‘আতঙ্ক গ্রুপ গ্যাং স্টার’-এর ছুরিকাঘাতে নিহত হন মহসিন। এ ঘটনায় আরো তিনজন আহত হয়। আহত অবস্থায় মহসিনকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নেওয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। এ সময় তাঁর বন্ধু সাব্বির, রাকিব ও রুবেল গুরুতর আহত হয়।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2019/09/06/811592