ঢাকা-চট্টগ্রামে মহাসড়কে ট্রাক ও কাভার্ডভ্যানের এমন বেপরোয়া প্রতিযোগিতা করে চলাচল অহরহ দুর্ঘটনা ঘটায় -সংগৃহীত
৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯, মঙ্গলবার, ১:০৪

বেপরোয়া নৈরাজ্য

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ট্রাক-কাভার্ডভ্যান

ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়কে ভারী যানবাহনগুলো চলছে বেপরোয়া রাজত্বে। এতে দুর্ঘটনা বাড়ছেই। সর্বশেষ গতকাল সোমবার ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লায় সড়ক দুর্ঘটনায় এএসআইসহ ৩ পুলিশ সদস্য নিহত হয়ছে। একটি কাভার্ড ভ্যান পুলিশের পিকাপকে ধাক্কা দিলে এ দুর্ঘটনা ঘটে। এর আগে সাহসিকতার সঙ্গে ডোবায় ঝাঁপিয়ে পড়ে বাসের ২০ যাত্রীর জীবন বাঁচানো পুলিশ কনস্টেবল পারভেজ মিয়া নিজেই সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে পা হারিয়েছেন। কয়েক মাস আগে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় একটি বেপরোয়া গতির কাভার্ড ভ্যান তাকে চাপা দেয়। এতে তিনি ডান পায়ের গোড়ালি ও হাতে গুরুতর আঘাত পান। পরে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে (নিটোর) পারভেজের ডান পা কেটে ফেলতে হয়েছিল।

ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়কে গতকাল সোমবার সকাল ৬টায় ভারী যানবাহনের বেপরোয়া চলাচলে দুর্ঘটনার আশঙ্কায় প্রাইভেটকার নিয়ে বেশ সাবধানে কুমিল্লার পদুয়ার বাজার মোড় পাড় হচ্ছিলেন নোয়াখালীর ব্যবসায়ী মোসলেম খন্দকার। তিনি ইনকিলাবকে বলেন, শুধু ঢাকা-চট্টগ্রাম নয় নিউইয়র্কের সড়কেও গাড়ি চালিয়েছেন তিনি। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, নিউইয়র্কের বড় রাস্তা হলে তো এরকম ঘটনা কখনোই ঘটবে না। এমনকি কুমিল্লা-নোয়াখালী ভেতরের সড়কের মতো ছোট গলির সড়কের মোড়ে প্রথমে যে কোনো গাড়িকে থেমে যেতে হয়। এরপর যে আগে এসে থামবে সে পার হয়। তারপর অন্যগাড়ি। এই নিয়ম মানাতে কোনো ট্রাফিক পুলিশের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু বাংলাদেশে ট্রাফিক পুলিশ গাড়ির পেছনে দৌঁড়ে গিয়েও এ নিয়ম মানাতে পারেনা। কিন্তু মধ্যরাত থেকে সকাল ভোর পর্যন্ত যখন রাস্তা ফাঁকা থাকে তখন ট্রাক কিংবা কভার্ডভ্যান চালকদের গতির কাছে তুচ্ছ হয়ে পড়ে ছোট ছোট যানবাহন বা পথচারীদের জীবন। সেসময় দেখা মেলে না কোনো ট্রাফিক পুলিশের। ট্রাক ও কভার্ডভ্যান চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা বাণিজ্যিক শহর চট্টগ্রাম থেকে রাজধানী ঢাকাতে বিভিন্ন কারখানার মালামাল আনা নেওয়া এবং কাঁচামাল পরিবহনসহ বাণিজ্যিক কাজেই মহাসড়কে রাতভর চলাচল করেন। দিনের বেলায় ঢাকার শহরে ট্রাক, কাভার্ডভ্যান ঢুকতে কিংবা বের হতে দেওয়া হয় না। তাই বাধ্য হয়েই আমরা দ্রুত গতিতে গাড়ী চালাতে হয়, কারণ নির্দিষ্ট সময়ের আগে ঢাকা পৌঁছে মালমাল আনলোড করতে না পারলে ওইদিন শহর থেকে গাড়ী নিয়ে সন্ধ্যা ছাড়া আর বের হওয়া যাবে না। আবার কোন কোন সময় দেখা যায় সড়কে যানজট দেখা দিলে ট্রাক-কাভার্ডভ্যান টানা দু-তিন দিনও রাস্তায় থাকতে হয় গাড়ি নিয়ে।

মোটরযান আইন অনুসারে, একজন চালক একটানা পাঁচ ঘণ্টার বেশি ভারী যানবাহন চালাতে পারবেন না। আধঘণ্টার বিরতি দিয়ে পুনরায় চালাতে পারবেন। তবে দিনে ৮ ঘণ্টা এবং সপ্তাহে ৪৮ ঘণ্টার বেশি চালাতে দেওয়া যাবে না। এ জন্য যানবাহনের তুলনায় চালকের সংখ্যা বেশি থাকা জরুরি। অথচ দেশের প্রায় ৩৮ শতাংশের বেশি ভারী যানবাহনের চালকের কোনো লাইসেন্স নেই। মোটরযান আইনে ভারী যানবাহনের মধ্যে পড়ে বাস, ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, বিশেষ যানবাহন (লরি, মিক্সচার মেশিনবাহী যান)। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য বলছে, দেশে ভারী যানবাহন আছে ২ লাখ ৫২ হাজার। এসব যানবাহনের বিপরীতে বৈধ লাইসেন্স আছে এমন চালকের সংখ্যা ১ লাখ ৫৫ হাজার। অর্থাৎ ৩৮ দশমিক ৪৯ শতাংশ যানবাহন চলছে ভুয়া চালক দিয়ে। সড়ক দুর্ঘটনার বড় কারণ ভারী যানবাহনের বেপরোয়া গতি। মোটরযান আইন অনুসারে, ভারী যানবাহনের চালকের সর্বনিম্ন বয়সসীমা ২১ বছর। আর হালকা যানের চালকের সর্বনিম্ন বয়স ১৮ বছর। একজন হালকা যানের চালক তিন বছর পর মাঝারি যানের লাইসেন্স পেতে পারেন। মাঝারি যান চালানোর তিন বছরের অভিজ্ঞতা থাকলেই কেবল ভারী যানের চালক হতে পারবেন। পেশাদার চালককে পাঁচ বছর পরপর পরীক্ষা দিয়ে লাইসেন্স নবায়ন করতে হয়। অর্থাৎ হালকা যানবাহনের তুলনায় ভারী যানের চালক হওয়ার প্রক্রিয়া কঠিন। কারণ, ভারী যানবাহন দূরের পথে চলে।

চট্টগ্রাম থেকে রংপুর দূরপাল্লার পথে ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান চালক মমতাজ উদ্দিন ও আমিরুজ্জামান ইনকিলাবকে বলেন, ভারী যানবাহনের চালকদের প্রায় শতভাগই প্রথমে চালকের সহকারী ছিলেন। তারা ‘ওস্তাদের’ কাছ থেকেই গাড়ি চালানো শিখেছেন। তাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। সড়কের সাইন-সংকেত সম্পর্কেও কোনো প্রশিক্ষণ নেই। তাদের কাছে লাইসেন্স পরীক্ষা দিতে যাওয়া মানেই একটা ঝক্কি, দালালের খপ্পরে পড়ে বাড়তি গচ্চা দেওয়া। এ ছাড়া একাধিক দিন বিআরটিএ কার্যালয়ে যাওয়ার কারণে আয় থেকেও বঞ্চিত হতে হয়।

এ বিষয়ে সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী বলেন, যেসব চালক ভারী যানবাহন চালাতে পারেন, তাদের লাইসেন্স দেওয়ার বিষয়টি সহজ করা উচিত। বিআরটিএতে গেলেই চালকেরা চক্করে পড়ে যান। এ জন্যই যানবাহনের তুলনায় লাইসেন্স কম। অনেকে বছরের পর বছর লাইসেন্স নবায়ন করেন না। রাস্তায় পুলিশ ধরে, মামলা দেয়, চাঁদাবাজির শিকার হচ্ছে। ব্যবস্থা পরিবর্তন না করে শুধু চালকদের দোষ দিয়ে সড়ক দুর্ঘটনা কমানো যাবে না।

প্রতিটি ভারী যানের বিপরীতে চালক থাকা দরকার তিনজন অথচ চালক আছেন একজনের কম। ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানের মতো বাণিজ্যিক যানবাহনের মালিক ও চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভারী যানবাহনের চালকের সংকটের কারণে আট ঘণ্টার বেশি যানবাহন চালাতে না দেওয়ার যে আইনি বাধ্যবাধকতা আছে, তা মানা হয় না। প্রতি পাঁচ ঘণ্টা পর বিশ্রামের যে বিধান, তাও কাগজপত্রেই সীমাবদ্ধ। নামীদামি কিছু কোম্পানি চালকদের বিশ্রাম দিলেও অনেক চালক অন্য মালিকের যানবাহন চালাতে নেমে পড়েন। সংকটের কারণে যানবাহনের মালিক লাইসেন্সবিহীন চালকের হাতে নিজের যান তুলে দেন। কম মজুরিতে চালক পেতে অনেকে হালকা যানের চালক দিয়ে ভারী যান পরিচালনা করেন।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ২০ হাজার পণ্যবাহী ট্রাক এবং কাভার্ড ভ্যান চলাচল করে। এর কোনোটিই পুলিশকে চাঁদা না দিয়ে চলতে পারে না। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে চলাচলকারী কাভার্ডভ্যান চালক আলমগীর ইনকিলাবকে বলেন, পুলিশের নানা বাহানা আছে। বডি পরীক্ষা, রঙ পরীক্ষা, ইঞ্জিন পরীক্ষা, ওজন পরীক্ষা আরো কত কি! তিনি বলেন, ট্রাক যেখান থেকে পণ্য বোঝাই করে সেখানে শুরুতেই পুলিশসহ তিনটি গ্রুপকে চাঁদা দিতে হয়। তারপর পথে পুলিশের যতগুলো বক্স আছে সবখানে চাঁদা দিতে হয়। এরপর ঢাকায় প্রবেশের আগে আরেক দফা চাঁদা দিতে লাগে। ট্রাক চালক মোনায়েম জানান, আমরা প্রতিবাদ করলে হয়রানি আরো বেড়ে যায়। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, পুলিশ এক হাজার টাকা চাঁদা চাইলো। কোনো ট্রাক ড্রাইভার যদি তা না দেন, পুলিশ তাহলে ১৫১ ধারায় ট্রাকের রঙ চটে গেছে বলে একটি মামলা করে দেয়। যার জন্য জরিমানা গুনতে হয় প্রায় ৫ হাজার টাকা। আবার পচনশীল পণ্যের ট্রাক চাঁদা না দিতে চাইলে অবৈধ পণ্য আছে বলে সব পণ্য রাস্তার পাশে নামাতে বলা হয়। তখন কয়েক লাখ টাকার পণ্য রাস্তাতেই পচে। তবে কুমিল্লা অঞ্চলের হাইওয়ে পুলিশ সুপার নজরুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, চাঁদাবাজি বন্ধ করতে এরই মধ্যে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। মহাসড়কে চাঁদাবাজি বন্ধে সাদা পোশাকে পুলিশের টিম কাজ শুরু করেছে। ট্রাক চলাচলে পুলিশের বেঁধে দেওয়া গতিসীমা হলো ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটার। কিন্তু বাস্তবে ৭০ থেকে ৮০ কিলোমিটার গতিতেই ছুটতে দেখা যায় ট্রাকগুলোকে। কোনো গতি নিয়ন্ত্রণ না করেই ট্রাকগুলো বেপরোয়া হয়েই মহাসড়কের বিভিন্ন মোড় পার হচ্ছে। এসময় ঝুঁকির মধ্যে থাকছে ছোট যানবাহনগুলো।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহকারী অধ্যাপক সাইফুন নেওয়াজ বলেন, নগরীতে মালামাল আনা নেওয়া এবং লোড ও আনলোডিং স্থানটি এমনভাবে নির্ধারণ করতে হবে যাতে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ও চলাচলে বাধা সৃষ্টি না হয়। এছাড়া ভারী যান চলাচলের কারণে সড়কের ক্যাপাসিটিও নষ্ট হয়ে যায় বলে মনে করেন তিনি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উদাহরণ টেনে বুয়েটের এই শিক্ষক বলেন, নগরীর বাইরে পণ্যবাহী ট্রাকের মালামাল আনার পর ছোট যানবাহনে তা বিভিন্ন এলাকায় পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

https://www.dailyinqilab.com/article/231406/