২৯ আগস্ট ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ৩:৪৭

ঘুমন্ত প্রকল্পেও ৪৮৩ কোটি টাকা ব্যয় বৃদ্ধি

প্লাস্টিক শিল্পনগরী

দেশের কিছু কিছু উন্নয়ন প্রকল্প জনগুরুত্বপূর্ণ হলেও তার কাজ চলছে ঠেলাগাড়ির গতিতে। মূলত ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতার কারণে অনেক উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদন নিয়ে ঘুমিয়ে থাকে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়হীনতাই সরকারের অনেক উন্নয়ন প্রকল্প ঝিমিয়ে পড়ছে। পুরনো ঢাকায় অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা প্লাস্টিক শিল্প কারখানা সুবিধাজনক স্থানে নেয়ার জন্য মুন্সীগঞ্জে বিসিক প্লাস্টিক শিল্পনগরীর জন্য প্রায় পৌনে চার বছরেও জমি অধিগ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। ভূমি জটিলতা নিরসন না হওয়ায় প্রকল্পের ব্যয় ১৩৩ কোটি টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে এখন ৬১৬ কোটি ৫০ লাখ টাকায় প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে প্রকল্পের ব্যয় বেড়েছে ৪৮৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা। সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়া সাধারণ বাজার যাচাই প্রতিবেদনকে এ ক্ষেত্রে সমীক্ষা হিসেবে দেখানো হয়েছে বলে পরিকল্পনা কমিশন বলছে।

পিইসি সূত্র মতে, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প করপোরেশন (বিসিক) ধলেশ্বরী নদীর কাছে ঢাকা-মাওয়া-খুলনা মহাসড়কের পাশে মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান উপজলোয় ৫০ একর জমিতে ২০১৮ সালের জুনের মধ্যে প্লাস্টিক শিল্পনগরী গড়ে তুলবে। রাজধানীর বিভিন্ন জায়াগা ও পুরান ঢাকার আশপাশে অপরিকল্পতিভাবে ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে গড়ে ওঠা প্লাস্টিক শিল্প-কারাখানাগুলো ওই শিল্প নগরীতে স্থানান্তর করা হবে। এতে পরিবেশসম্মত প্লাস্টিকদ্রব্য উৎপাদনের সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান বাড়বে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে শিল্প নগরীতে ৩৭০টি শিল্পপ্লট পাওয়া যাবে। এর মধ্যে ১০ শতাংশ নারী উদ্যোক্তার জন্য সংরক্ষণ করা হবে। ৩৭০টি প্লটে কম-বেশি ৩৬০টি শিল্প ইউনিট স্থাপিত হবে। এসব শিল্প ইউনিটে ১৮ হাজার লোকের সরাসরি কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।

শিল্প মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে প্রায় পাঁচ হাজার ৩০টি প্লাস্টিক শিল্প-কারখানা রয়েছে, যার অধিকাংশই বেসরকারি মালিকানাধীন। এর মধ্যে ৫০টি বড়, ১ হাজার ৪৮০টি মাঝারি এবং প্রায় ৩ হাজার ৩০টি ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কারখানা। এসব কারখানার মধ্যে ৮০ শতাংশই ঢাকাকেন্দ্রিক এবং ক্ষুদ্র কারখানার ৯০ শতাংশই পুরান ঢাকার বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত।

বিসিক প্রস্তাবনা পর্যালোচনা থেকে জানা গেছে, ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে ১৩৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫০ একর জমির ওপর তিন বছর মেয়াদে প্লাস্টিক শিল্পনগরী স্থাপন প্রকল্পটি অনুমোদন দেয়া হয়। ২০১৮ সালের জুনে প্রকল্পটি শেষ করার কথা ছিল; কিন্তু ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতার কারণে সেটার কাজ চার বছরেও শুরু করতে পারেনি বাস্তবায়নকারী সংস্থা। প্রায় পৌনে চার বছরেও ভূমি অধিগ্রহণের কোনো অগ্রগতি নেই। এমনকি খাস জমিও প্রকল্পের আওতায় আনা যাচ্ছে না। ৫০ একর জমি অধিগ্রহণের জন্য ২০১৬ সালের জুনে শিল্প মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব প্রেরণ করা হয়; যা ১৫ দিন পর মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন পেয়ে মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসককে দেয়া হয়। দুই বছর পর ২০১৮ সালের ৩১ আগস্ট ডিসি অফিস থেকে ৪ ধারায় নোটিশ জারি করা হয়। জমির ওপর যৌথ তদন্ত সম্পন্ন ও আপত্তি নিষ্পত্তিপূর্বক জেলা প্রশাসন থেকে চলতি বছরের ২৬ মে ভূমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব ভূমি মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়। এখানে ৫০ একর জমির মধ্যে প্রায় ৩৩ একর জমি হলো খাস জমি। যেখানে বসবাসকারী লোকজন অধিগ্রহণে বাধা প্রদান করায় অধিগ্রহণ বিলম্বিত হচ্ছে।

প্রকল্পের ব্যয় বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রথমে ৫০ একর জমির দর ধরা হয় ৬৩ কোটি ১৬ লাখ টাকা। ফলে একরপ্রতি মূল্য পড়ে ১ কোটি ২৬ লাখ টাকা। এখন ৫০ একর জমির দাম ধরা হয়েছে ৪৯০ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। একরপ্রতি এখন দর পড়ছে ৯ কোটি ৮১ লাখ টাকার বেশি।

ব্যয়ের ব্যাপারে পরিকল্পনা কমিশনের শিল্প ও শক্তি প্রধান বলেন, মূল প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণ ব্যয় ছিল ৬৩ কোটি ১৬ লাখ টাকা। এখন ৪২৭ কোটি ৫৮ লাখ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে সেটা হয়েছে ৪৯০ কোটি ৭৪ লাখ টাকা, যা অত্যধিক ও সামঞ্জস্যহীন। এ ছাড়া অধিগ্রহণ ব্যয় বৃদ্ধিতে প্রতি বর্গফুট প্লটের মূল্য ১২শ’ ৪০ টাকা থেকে প্রায় চার গুণ বৃদ্ধি পেয়ে এখন ৪ হাজার ৫৫৬ টাকা হয়েছে। প্লটের মূল্য বৃদ্ধিতে শিল্প উদ্যোক্তারা এসব প্লট ক্রয়ে আগ্রহী হবেন কি না সেটাও দেখার বিষয়।

বিসিক চেয়ারম্যান প্লটের দর বৃদ্ধির ব্যাপারে বলেন, জেলা প্রশাসন থেকে প্রদত্ত আনুমানিক দরের ভিত্তিতে প্রাক্কলন করায় ভূমির উচ্চমূল্য হয়েছে।

এ ব্যাপারে প্রকল্প পরিচালক মো: নিজাম উদ্দিনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি নয়া দিগন্তকে জানান, মূলত ভূমি অধিগ্রহণে জটিলতার কারণেই প্রকল্পের কাজ আগানো যাচ্ছে না। অনুমোদনের পাঁচ মাস পর প্রকল্প পরিচালক নিয়োগপ্রাপ্ত হন। সরকারি যে খাস জমি আছে ৩৩ একর সেটিও প্রকল্পের আওতায় আনা যাচ্ছে না। ওই সব জমিতে অবৈধভাবে দখলে যারা আছে সেখান থেকে তাদের সরানো যাচ্ছে না। সরকারের জমি সরকারি কাজে লাগানো হবে এটাই নিয়ম। তিনি বলেন, যৌথ তদন্ত করতেই ২৭ মাস অতিক্রম। ডিসি অফিসে ভূমি অধিগ্রহণের ব্যাপারে চিঠি দেয়া হয়েছে, এটা ভূমি মন্ত্রণালয় হয়ে আসবে। এখনো আমাদের কাছে আসেনি। আশা করছি দ্রুত আসবে। ভূমি হাতে পেলে কাজ শুরু করতে বেশি সময় লাগবে না।

ব্যয় বৃদ্ধির ব্যাপারে তিনি বলেন, এখন ওসব জমিতে বাড়িঘর আছে। ফলে ক্ষতিপূরণ ও জমির মূল্য বেশি দিতে হবে। তারপরও ডিসি অফিসকে জমির দর যৌক্তিক করার জন্য বলা হয়েছে। সেটা করা হলে হয়তো ব্যয় কিছুটা কমবে। এ ছাড়া এখন কাজ করতে হবে পিডব্লিউডির নতুন ২০১৮ সালের রেট শিডিউল অনুযায়ী, যার ফলে প্রকল্প ব্যয় তো বাড়বেই।

পরিকল্পনা কমিশন বলছে, দীর্ঘ সময় প্রকল্প বাস্তবায়নে অগ্রগতি না থাকলে তা রুগ্ণ প্রকল্পে পরিণত হয়, যা অনাকাক্সিক্ষত। এ ছাড়া প্রকল্পটির জন্য কোনো সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়নি। বিধি অনুযায়ী কোনো বিনিয়োগ প্রকল্প ৫০ কোটি টাকার বেশি ব্যয়ের হলে তার জন্য সম্ভাব্যতা যাচাই বাধ্যতামূলক। কিন্তু এই প্রকল্পের ডিপিপিতে সংযুক্ত সমীক্ষাটি যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ নয়; বরং একটি সাধারণ বাজার যাচাই প্রতিবেদন। এতে প্রয়োজনীয় বিষয়ের বিবরণ, চাহিদা ও সুপারিশ নেই। যথাযথ সম্ভাব্যতা সমীক্ষার আলোকে মূল ডিপিপি প্রণীত হয়নি। তাই উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান দিয়ে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করে সে আলোকে ডিপিপি করতে হবে।

http://www.dailynayadiganta.com/first-page/435961/