২৮ আগস্ট ২০১৯, বুধবার, ২:৪৩

শিক্ষকদের পদমর্যাদা কী

দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এখনও তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী। আর সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা পাঁচ বছর আগে দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তার পদমর্যাদা পেলেও এখনও রয়েছে তাদের পদোন্নতি নিয়ে নানা সমস্যা। আবার উচ্চশিক্ষায় যারা এ পেশায় আছেন, তারাও পাননি কাঙ্ক্ষিত পদমর্যাদা। কেবল 'অধ্যাপক' পদেই রয়েছে তিন রকম পদমর্যাদা। বিভিন্ন স্তরের শিক্ষকদের এই পদমর্যাদার সংকট দিন দিন প্রকট হচ্ছে।

রাষ্ট্রীয় মর্যাদাক্রমেও শিক্ষকরা রয়েছেন বেশ পেছনে। আবার শিক্ষকতায় সরকারি ও বেসরকারি দুটি ভাগ থাকায় বেসরকারি শিক্ষকরা কোনো পদমর্যাদাই পান না। তাদের বঞ্চনা আরও বেশি। একই চ্যান্সেলরের (রাষ্ট্রপতি) মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের পদমর্যাদা উচ্চে হলেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের পদমর্যাদা কেবলই কাগুজে।

দেখা গেছে, পদমর্যাদার ক্রম ঠিক না থাকায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আয়োজকরাও বিব্রত হন। একই অনুষ্ঠানে অতিথি হওয়া সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের নাম আগে লিখবেন, নাকি সরকারের সচিবের নাম আগে লেখা হবে- এ নিয়ে ধাঁধায় পড়েন অনেকে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকদের সুস্পষ্ট পদমর্যাদা এবং মর্যাদাক্রম নির্ধারণের দাবি জানিয়েছেন শিক্ষাবিদরা।

প্রাথমিক শিক্ষক :২০১৪ সালের ৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের পদমর্যাদা দ্বিতীয় শ্রেণিতে উন্নীত করেন। একই দিনে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে। সে হিসেবে দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে তাদের বেতন স্কেল নির্ধারণ হওয়ার কথা জাতীয় বেতন স্কেলের দশম গ্রেডে। তবে তা না করে মন্ত্রণালয় প্রধান শিক্ষকদের বেতন স্কেল নির্ধারণ করেছে ১১তম গ্রেড (প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত) ও ১২তম গ্রেডে (প্রশিক্ষণবিহীন)। অথচ নন-ক্যাডার দ্বিতীয় শ্রেণির পদে অন্যান্য মন্ত্রণালয় বা বিভাগের কর্মকর্তারা জাতীয় বেতন স্কেলের দশম গ্রেডেই বেতন পান। পরে এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ঢাকার গেণ্ডারিয়ার মহিলা সমিতি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও বাংলাদেশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষক সমিতির সভাপতি রিয়াজ পারভেজসহ ৪৫ জন উচ্চ আদালতে রিট করেন। ওই রিটের শুনানি নিয়ে গত বছরের ৫ মার্চ রুল জারি করেন উচ্চ আদালত। সেই রুলের চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে গত ফেব্রুয়ারিতে আদালত প্রধান শিক্ষকদের বেতন স্কেলের দশম গ্রেডসহ (প্রশিক্ষণ ও প্রশিক্ষণবিহীন) গেজেটেড পদমর্যাদা দিতে নির্দেশ দেন। ২০১৪ সালের ৯ মার্চ থেকে এটি কার্যকর করতে আদেশ দেন আদালত। এরপর গত ৩১ জুলাই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রধান শিক্ষকদের বেতন স্কেল দশম গ্রেডে উন্নীত করতে অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠায়।

প্রধান শিক্ষকরা তাদের কাঙ্ক্ষিত পদমর্যাদা ও বেতনক্রম পেলেও সহকারী শিক্ষকদের চাওয়া পূরণ হচ্ছে না। তারাও তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হয়ে থাকতে চান না; চান দ্বিতীয় শ্রেণির পদমর্যাদা ও ১১তম গ্রেডে বেতন। এ বিষয়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি শামছুদ্দিন মাসুদ সমকালকে বলেন, প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকরা একই শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে একই প্রক্রিয়ায় নিয়োগ পান। তাহলে পদমর্যাদা দুই রকম কেন হবে। তিনি বলেন, প্রাথমিক শিক্ষকরা 'তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী', এটা বর্তমান সমাজের সঙ্গে একেবারেই বেমানান। তাই আমাদের দাবি, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের পদমর্যাদা কমপক্ষে দ্বিতীয় শ্রেণিতে উন্নীত করা হোক।

মাধ্যমিক শিক্ষক :প্রাথমিকের মতো সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীর পদমর্যাদায় দিনাতিপাত করছিলেন। বর্তমান সরকারের প্রথম মেয়াদে ২০১২ সালের ১৫ মে তাদের পদমর্যাদা বাড়ানোর ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী। সেদিন রাজধানীর রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজ মাঠে শিক্ষক সমিতি আয়োজিত শিক্ষক সমাবেশের উদ্বোধন করে তিনি এ ঘোষণা দেন।

জানা গেছে, পদমর্যাদা উন্নীত হলেও মাধ্যমিক শিক্ষকদের পদোন্নতির প্রক্রিয়া অত্যন্ত শ্নথ। সহকারী শিক্ষক থেকে প্রধান শিক্ষক হতে দীর্ঘ সময় পেরিয়ে যায়; অনেকের চাকরির বয়সও শেষ হয়ে যায়। এ বিষয়ে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির আহ্বায়ক সাখায়েত হোসেন বলেন, প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ, তিনি আমাদের মর্যাদা দিয়েছেন। এখন পদোন্নতির নানা জটিলতাও দ্রুত কাটানোর জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাই।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক :কাঙ্ক্ষিত পদমর্যাদা পাচ্ছেন না উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরাও। ২০১৫ সালে নতুন জাতীয় বেতন স্কেলে সিলেকশন গ্রেড বাতিলের কারণে শিক্ষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। তাদের বেতন ও পদমর্যাদা কমে যায়। সে সময়ে তারা এ নিয়ে আন্দোলনে নেমেছিলেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাদের পদমর্যাদা নিয়ে বেশ টানাপড়েনেই রয়েছেন। দেশে ৪২টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এখন চালু রয়েছে। এগুলোতে প্রায় ১৫ হাজার শিক্ষক কর্মরত। এই শিক্ষকরা ছাত্রছাত্রীদের তাদের শ্রমের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে দক্ষ গ্র্যাজুয়েট তৈরি করতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।

দেখা গেছে, বর্তমানে 'রাষ্ট্রীয় মর্যাদাক্রম' বা 'ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স'-এ ১৬ নম্বরে রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দেখভালকারী প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান। সরকারের সচিবরাও এই ক্রমে রয়েছেন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা রয়েছেন এর পরের ধাপে, ১৭তম ক্রমে। জাতীয় অধ্যাপকরাও এই ধাপেই অবস্থান করছেন। আর সিলেকশন গ্রেডপ্রাপ্ত অধ্যাপকরা রয়েছেন ১৯তম ক্রমে।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক সমকালের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, 'সিলেকশন গ্রেড' বাতিল হওয়ায় শিক্ষকরা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। ওই সিদ্ধান্তের ফলে জাতীয় বেতন স্কেলের সর্বোচ্চ ধাপে (গ্রেড-১) তারা আর যেতে পারছিলেন না। তারা সচিব পদমর্যাদার গ্রেড-১-এর সুযোগ-সুবিধা, বেতনও পাচ্ছিলেন না। শিক্ষকরা প্রশ্ন তোলেন, সচিবরা নিজেদের সুবিধার জন্য যদি সিনিয়র সচিবের পদ সৃষ্টি করতে পারেন, তাহলে শিক্ষকদের জন্য সিনিয়র অধ্যাপকের পদ নয় কেন?

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সভাপতি অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল সমকালকে বলেন, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সরকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে তারা সুন্দর সমাধান করেছেন। প্রধানমন্ত্রী তৎকালীন অর্থমন্ত্রীর নেতৃত্বে সিনিয়র কয়েকজন মন্ত্রীকে দিয়ে একটি মন্ত্রিসভা কমিটি করে দিয়েছিলেন। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, অধ্যাপকদের তিনটি পদমর্যাদা নির্ধারিত হবে। সহযোগী অধ্যাপক থেকে সরাসরি পদোন্নতি পেয়ে যারা অধ্যাপক হবেন, তারা জাতীয় বেতন স্কেলের তৃতীয় গ্রেডভুক্ত হবেন। এর চার বছরে আরও দুটি স্বীকৃত গবেষণাপত্র প্রকাশের পর তারা গ্রেড-২-এ যেতে পারবেন। এর কমপক্ষে দুই বছর পর সংশ্নিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রেড-২-এ থাকা ২৫ শতাংশ অধ্যাপক গ্রেড-১ ভুক্ত হবেন। এটা শিক্ষকদের বড় অর্জন।

তিনি বলেন, জনপ্রশাসনে সিনিয়র সচিবের স্কেলে তারাও সিনিয়র অধ্যাপকের পদ চেয়েছিলেন। মন্ত্রিসভা কমিটি সে সময়ে কথা দিয়েছিল, এটা নিয়ে পরে আমাদের সঙ্গে তারা বসবেন। এ আলোচনা আর এগোয়নি।

মাকসুদ কামাল বলেন, শিক্ষকদের মর্যাদার জায়গাটি ঠিক করে দিতে হবে। সম্মানের জায়গায় ঘাটতি থাকলে তারা তাদের সর্বোচ্চটা দিতে পারবেন না। রাষ্ট্রীয় মর্যাদাক্রমে শিক্ষকদের আরও ওপরে নিতে হবে। তার দাবি- একই সঙ্গে পুরনো, বড় ও নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে রেটিং করতে হবে। নইলে সংকট থেকেই যাবে। তার প্রশ্ন- ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সঙ্গে দেশের আঞ্চলিক কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদমর্যাদা কি একই হবে? চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানে এ ধরনের রেটিং করা হয়। এটি করা হলে উপাচার্যদের পদমর্যাদা নির্ধারণও সহজ হবে।

https://samakal.com/bangladesh/article/19082090/