১০ মে ২০১৯, শুক্রবার, ১০:৫৮

ঈদে ভোগান্তির শঙ্কা

৩ দিন ধরে অচল ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ভয়াবহ যানজট লেগেই আছে। গত সোমবার গভীর রাত থেকে শুরু হওয়া মহাসড়কের কুমিল্লা অংশে যানজটের তৃতীয় দিন অতিবাহিত হলো গতকাল বৃহস্পতিবার। কয়েকশ থেকে হাজার হাজার গাড়ি আটকা পড়েছে এ মহাসড়কে। রমজানে প্রচন্ড গরমে হাজার হাজার যাত্রীর সীমাহীন ভোগান্তি অতীতের রেকর্ডকে হার মানিয়েছে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে আসন্ন ঈদে কি হবে তা নিয়ে এখনই শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মেঘনা-গোমতী ও দাউদকান্দি সেতু দিয়ে ধীরগতিতে চলাচলের কারণে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। হাইওয়ে পুলিশ আছে। কিন্তু তাদের কার্যকর ভ‚মিকা খুবই দুর্বল। ভুক্তভোগী যাত্রীরা বলছেন, যানজট প্রতিদিনই বেড়ে চলেছে। কোনো না কোনো জায়গায় যানজট হচ্ছে। আর যানজট মানে কয়েক ঘণ্টার মহাযন্ত্রণা। যারা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত চেয়ারকোচ যাত্রী তাদের দুর্গতি আরো বেশি। কয়েক ঘণ্টা যানজটে পড়লে গাড়ির এসি বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় গাড়ির যাত্রীদের দুর্গতি চরমে উঠে। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা অভিমুখী অ্যাম্বুলেন্সে থাকা সঙ্কটাপন্ন রোগীদের জীবন নিয়ে শঙ্কা দেখা দেয়।

এদিকে টানা তিন দিন ধরে ভয়াবহ যানজটে অচল এই মহাসড়কে ট্রাক ও লরি ভাড়া বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পৌঁছতে লেগে যাচ্ছে ২০ ঘণ্টারও বেশি সময়। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক দিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এই মহাসড়ক ব্যবহার করে সরবরাহ করা হয় পণ্যসামগ্রী। মহাসড়কে চলাচলকারী যানবাহনের ৬০ শতাংশই পণ্যবাহী। মহাসড়কের পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে রাত-দিন ২৪ ঘণ্টাই লেগে থাকছে দুঃসহ যানজট। গত বুধবারের ৫০ কিলোমিটারের যানজট গতকাল বৃহস্পতিবার বেড়ে হয়েছে ৬৫ কিলোমিটার। রমজানের মধ্যে অসহনীয় দুর্ভোগে কাটাতে হচ্ছে সন্ধ্যায় ইফতার ও পানির অভাব দুর্ভোগের মাত্রাকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে রোজাদার যাত্রীদের। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানবাহনে বসে থেকে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েন যাত্রী ও চালকরা। ইফতারের সময় রায়পুরে যানজটে আটকা থেকে ঢাকাগামী একাধিক যাত্রী ইনকিলাবকে বলেন, যানজটে আটকা পড়ে ঠিকমত ইফতার করতে পারিনি। যাত্রীসহ সবাইকে ইফতারের সময় কষ্ট পেতে হয়েছে। দাউদকান্দির হাসানপুর এলাকায় স্টার লাইন পরিবহনের যাত্রী ইফতেখার বলেন, যানজটে আটকা পড়ে গত রাতে সেহেরি খেতে পারেনি। আমার মতো শত শত যাত্রী না খেয়ে আজ (বৃহস্পতিবার) রোজা রেখেছেন।

তবে যানজটের ব্যাপারে হাইওয়ে পুলিশের কর্মকর্তারা বলেছেন, ঘূর্ণিঝড় ফণির কারণে চট্টগ্রাম বন্দরে আটকে পড়া মালবাহী যানবাহন ধীরগতিতে চলতে শুরু করায় মহাসড়কে চাপ বেড়েছে। এ ছাড়া মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া উপজেলায় মেঘনা নদীর ওপর দ্বিতীয় সেতুর সংযোগের কাজের কারণে মহাসড়ক সংকুচিত হওয়ায় যানজট তীব্র আকার ধারণ করেছে।

গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ১০টার দিকে দাউদকান্দি উপজেলার পেন্নাই, গৌরীপুর, আমিরাবাদ এলাকা ঘুরে দেখা যায়, যানজটে আটকে থেকে অনেক চালক ও যাত্রী ঘুমিয়ে পড়েছেন। ঢাকাগামী হিমাচল বাসের যাত্রী চান্দিনার হারং গ্রামের ইউনুস ভূঁইয়া সকাল ১০ টার দিকে ইনকিলাবকে বলেন, সকাল আটটায় ঢাকায় ডাক্তারের এ্যাপায়ারমেন্ট ছিল। এ জন্য ভোর ছয়টায় বাসে ওঠেন তিনি। দেড় ঘণ্টার মধ্যে তার ঢাকায় পৌঁছার কথা ছিল। কিন্তু দাউদকান্দির হাসানপুর এলাকায় যানজটে আটকে আছেন তিনি। কখন ঢাকায় পৌঁছাবেন, তা বুঝতে পারছেন না। ঢাকাগামী প্রিন্স পরিবহন বাসের যাত্রী কুমিল্লা সদরের ব্যবসায়ী জহিরুল ইসলাম বলেন, তিন দিন ধরে যানজট। কুমিল্লা থেকে ঢাকায় পৌঁছাতে দুই ঘণ্টার জায়গায় ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা লাগছে। অথচ যানজট নিরসনে কারো কোনো ভূমিকা নেই। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়কে নবনির্মিত কাঁচপুর সেতুটি যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হলেও পুরাতন সেতুটি মেরামতের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যার কারনে সুফল মিলছে না এই মহাসড়কে। তিনি বলেন, রোজার আগে মেঘনা ও গোমতী সেতু যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেত্তয়া হবে বলে শুনেছি। কিন্তু নবনির্মিত সেতু দুটি খুলে যদি কাঁচপুরের সেতুর মতো পুরাতন দুটি সেতু মেরাতের জন্য বন্ধ করে দেত্তয়া হয় তাহলে ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়ক থেকে সহজেই যানজট থেকে পরিত্রাণ পাবে না যাত্রীরা। ব্যবসায়ী জহিরুল ইসলামসহ এই সড়কে নিরয়মিত চলাচলকারী যাত্রীদের দাবী, অন্তত: রমজান ও সামনে ঈদকে কেন্দ্র করে যেন মেঘনা-গোমতী সেতু দুটি নতুনটির পাাশাপাশি পুরাতন দুটি যেন খোলা রাখা হয়। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী এস আলম পরিবহন বাসের চালক মো. শামীম বলেন, যানজটের কারণে আটকে থেকে যাত্রীরা জরুরি কাজ সারতে ভোগান্তি পোহাচ্ছেন।

এদিকে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে সৃষ্ট যানজটের কারণে পণ্যবাহী গাড়ী ভাড়া বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। দেখা দিয়েছে পণ্য পরিবহনে নিয়োজিত গাড়ী সংকট। যানজটের কারণে ২/৩ দিন পণ্যবাহী গাড়ী রাস্তায় অবস্থান করতে হচ্ছে। অতিরিক্ত ভাড়া দিয়েও গাড়ী পাওয়া যাচ্ছে। ফলে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। পণ্য পরিবহণ মালিক সমিতির নেতারা জানান, যানজটের কারণে অন্যান্য জেলা থেকে কুমিল্লায় আবার কুমিল্লা থেকে বাইরে ভাড়া নিয়ে চালকরা যেতে চাচ্ছে না। দাউদকান্দি পৌর সদরের ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী ফারজানা আক্তার ও সোনিয়া আক্তার বলেন, যানজটে আটকে পড়ে ৯ কিলোমিটার পথ হেঁটে তাদের কলেজে পৌঁছাতে হয়েছে। ঢাকাগামী কাভার্ড ভ্যানচালক রবিউল ইসলাম বলেন, দীর্ঘ সময় যানজটে আটকে থেকে ঘুমানো ছাড়া উপায় নেই। অনেকে আবার দীর্ঘক্ষণ এক জায়গায় বসে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে সুযোগ পেলেই উল্টেপথে গাড়ি ঢুকিয়ে দেয়। যার কারনে যানজটের মাত্রা বেড়ে যায়।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়কে শিল্প কারখানার গাড়িতেই দখল হয়ে যাচ্ছে সড়কের একাংশ। এই মহাসড়কে বাস-ট্রাক-লরি-কাভার্ড ভ্যানের ঠায় দাঁড়িয়ে থাকাই যেন এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে। মহাসড়কের কুমিল্লা অংশে চার লেন সড়কের দু’পাশের বেশিরভাগ অংশই দখল করে নিয়েছে বিভিন্ন কারখানার কন্টেইনার মুভার, লরি, কাভার্ড ভ্যান ও পণ্যবাহী ট্রাক। এছাড়া মহাসড়কেই চলে পণ্য ও কাঁচামাল লোড-আনলোডের কাজ। এতে চার লেন বাস্তবায়িত হলেও তার সুফল পাচ্ছেন না যাত্রীরা।

যাত্রী ও চালকদের অভিযোগ, শিল্প কারখানাগুলোর পণ্য ও কাঁচামাল পরিবহনকারী গাড়ির পার্কিংয়ে দখল হয়ে থাকে সড়কের একপাশ। শুধু তাই নয়, কারখানাগুলোর কাঁচামাল ও পণ্য লোড-আনলোডের কাজও অনেক সময় চলে সড়কের ওপরেই। নিয়ম না থাকলেও থানা ও হাইওয়ে পুলিশকে টাকা দিয়ে ‘ম্যানেজ’ করে এভাবে পার্কিং ও লোড-আনলোডের কাজ কারখানাগুলো চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। কারখানার গাড়িতে সড়ক দখলের বিষয়টি মেনে নিলেও ‘ম্যানেজ’ হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছে পুলিশ। হাইওয়ে পুলিশের কুমিল্লা রিজিয়নের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মুহাম্মদ রহমত ইনকিলাবকে বলেন, শিল্প কারখানাগুলো নিজস্ব ট্রাক স্ট্যান্ড নেই। তাদের অধিকাংশ গাড়ি সড়কে ডাম্পিং করে রাখা হয়। এ কারণেই মূলত মহাসড়কের এই অংশে যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। সড়ক দখলে রাখার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া প্রসঙ্গে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, আমরা মাঝে মাঝে অভিযান চালিয়ে জরিমানা করি। কিন্তু তাতে কোনও লাভ হচ্ছে না। তবে টাকা নিয়ে পার্কিংয়ের সুযোগ করে দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি।

জানা গেছে, পণ্য ও কাঁচামাল আনা নেওয়া করে চান্দিনার উষা জুট মিল, সাহাদাত জুট মিল। এছাড়াও দাউদকান্দির শহীদনগরে সোনালী জুট মিল ছাড়াও মহাসড়কের পাশে মেঘনা, সোনারগাঁও এলাকায় ছোট বড় শিল্প কারখানা গড়ে ওঠেছে। ওইসব কারখানায় গাড়ি রাখার জন্য নিজস্ব কোনও স্ট্যান্ড নেই। পুলিশকে ‘ম্যানেজ’ করে তারা এসব গাড়ি মহাসড়কের ওপর পার্কিং করেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জুট মিলের পরিবহন সেক্টরের এক কর্মকর্তা বলেন, সড়কে পার্কিং করার জন্য থানা ও হাইওয়ে পুলিশকে প্রতিমাসে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দেওয়া হয়। টাকা না দিলে পুলিশ অভিযান চালায়, ঝামেলা করে। দাউদকান্দি হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল কালাম আজাদ ও গজারিয়ার ভবেরচর হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক আলমগীর হোসেন বলেন, শিল্প কারখানাগুলো অধিকাংশ গাড়ি সড়কে ডাম্পিং করে রাখা ও অতিরিক্ত মালবাহী যানবাহন মেঘনা-গোমতী ও মেঘনা সেতু দিয়ে ধীরগতিতে চলায় এ কারণেই মূলত মহাসড়কের এই অংশে যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। তারা বলেন, আইনিভাবে যা কিছু করা সম্ভব, আমরা তার সবই করি। তারপরও তারা সড়কে গাড়ি রাখছে। গাড়ি সংখ্যা বেশি, রাখার জায়গা নেই এসব বলে তারা সড়কেই পার্কিং করছে। শিল্প কারখানার মালিকরা এ ব্যাপারে মহাসড়কের উপর গাড়ি ডাম্পিং করে না রাখা ও অতিরিক্ত মালবাহী যানবাহন নিয়ে মহাসড়কে চলাচলের ব্যাপারে চালকদের নির্দেশনা দিলেই মহাসড়কে যানজট বন্ধ করা সম্ভব অন্যাথায় এই প্রবণতা দিনের পর দিন চলতে থাকবে, যাত্রীদেরও ভোগান্তি পোহাতে হবে।

https://www.dailyinqilab.com/article/205264