১০ মে ২০১৯, শুক্রবার, ১০:৩১

তদারকির মধ্যেই নিত্যপণ্যের দাম বাড়তি

রাজধানীতে চলছে বাজার ‘তদারকি’। রমজান মাসে নিত্যপণ্যের দর হাতের নাগালে রাখতে সরকারের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকটি পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দেয়া হয়। এর আগে বাণিজ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে ব্যবসায়ীরা কথা দিয়েছিলেন নিত্যপণ্যের দাম বাড়বে না। কিন্তু বাজারে সবজি থেকে ফল-মাংস, সব কিছুর দামই চড়া। বিশেষ করে রমজানে বেশি দরকারি ছোলা, খেসারি, মসুর ডাল, চিনি, খেজুর, পিয়াজ, বেগুন, কাঁচামরিচ ও ভোজ্যতেলের দাম সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। এমনকি ভোক্তাদের ধোকা দিয়ে মূল্যতালিকার এক পাশে সরকার নির্ধারিত দাম। তালিকার অপর পাশে নিজেদের বাড়তি দাম লিখে গ্রাহকদের পকেট কাটছেন বিক্রেতারা। সংশ্লিষ্টরা জানান, বাজার নিয়ন্ত্রণের কথা বারবার শোনা গেলেও বাস্তবে তার কোনো প্রভাব পরিলক্ষিত হয়নি। পাইকারি বাজারে দাম বাড়ার কারণে বাড়তি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে বলে জানান খুচরা ব্যবসায়ীরা।

বাজার ঘুরে দেখা গেছে, সোমবার সিটি করপোরেশন গরু-খাসির মাংসের যে দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে তার তোয়াক্কা করছে না মাংস ব্যবসায়ীরা। গরুর মাংসের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৫২৫ টাকা। কিন্তু কোনো বাজারেই এ দামে মাংস বিক্রি হচ্ছে না। নির্ধারিত দামের চেয়ে গরু-খাসির মাংস ৬০-৮০ টাকা বেশি বিক্রি হচ্ছে রাজধানীর বাজারে। খাসির মাংস ৭৫০ টাকা কেজি নির্ধারণ থাকলেও বিক্রি হচ্ছে ৮০০ টাকায়।

গতকাল রাজধানীর মোহাম্মদপুরের টাউন হল কাঁচাবাজারের মাংস ব্যবসায়ী কাদির নিজের দোকানে বড় করে সাদা কাগজে লিখে রেখেছেন মাংসের প্রতিকেজি ৫২৫ টাকা। কিন্তু কাগজটি উল্টালেই দেখা যায়, সেখানে লেখা মাংসের দাম কেজিপ্রতি ৫৫০ টাকা। অর্থাৎ বাজার মনিটরিং টিম এলে এক দাম, চলে গেলে আরেক দাম।

আকস্মিক অভিযানে বাজারটিতে গিয়ে এমন চিত্র দেখতে পান মেয়র আতিকুল ইসলাম।

এ সময় অনেক দোকানিকেই মূল্যতালিকা না ঝুলিয়ে ব্যবসা করতে দেখা যায়। কেউ কেউ আবার মেয়রকে দেখে তড়িঘড়ি করে মূল্যতালিকা ঝোলাতে লেগে পড়েন। এটা করতে গিয়ে মেয়রের হাতে ধরাও পড়েন কাদির। মূল্যতালিকার কাগজটি লুকাতে চাইলেও মেয়র এবং তার সঙ্গে থাকা স্থানীয় কাউন্সিলর, কর্মকর্তা ও গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য তা আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি। শেষমেষ ১০ হাজার টাকা জরিমানা ধার্য ও আদায় করা হয় কাদিরের কাছ থেকে।

বাজার পরিদর্শন শেষে মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ রমজানে যেন দ্রব্যমূল্যের দাম সহনশীল পর্যায়ে থাকে। আমরা লাগাতার পাইকারি বাজার মনিটরিং করছি। দাম নির্ধারণ করে দিয়েছি। কিন্তু খুচরা বাজারে এসে দেখছি আমাদের নির্ধারিত দাম আর থাকে না। কিছু ব্যবসায়ী আছেন যারা আমাদের নির্দেশনা মেনে সুন্দরভাবে ব্যবসা করছেন। আবার কিছু ব্যবসায়ী আছেন যারা শতভাগ অনিয়ম করছেন।

প্রধান কয়েকটি ভোগ্যপণ্যের তুলনামূলক চিত্র: এক সপ্তাহ আগে রাজধানীর বাজারে ছোলার কেজি ছিল ৫৫-৬০ টাকা। এখন বিক্রি হচ্ছে ৭০-৮০ টাকায়। অর্থাৎ এক সপ্তাহের ব্যবধানে পণ্যটির দাম বেড়েছে ১৫-২০ টাকা। খোলা চিনি ৪৫ টাকা এবং প্যাকেটজাত চিনি এক সপ্তাহ আগে বিক্রি হয়েছে ৫০ টাকায়। এখন বিক্রি হচ্ছে বাজারভেদে ৬০-৭০ টাকা। এ পণ্যটিতেও দাম বেড়েছে ১৫-২০ টাকা। প্রতি কেজি পিয়াজে দাম বেড়েছে ৫-৭ টাকা। এক সপ্তাহ আগে পিয়াজের কেজি ছিল ২৮-৩০ টাকা। বর্তমান মূল্য ৩৫-৩৮ টাকা কেজি। এছাড়া খেসারি ৬৫ থেকে ৭০ টাকা, মসুর ডাল ১০০ থেকে ১১০ টাকা, বুট ৩৮ থেকে ৪০ টাকা।

সারা বছর বেগুনের কদর না থাকলেও রমজানে এর কদর বাড়ে। এ সময় বেগুনের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসায়ীরা দাম বাড়ান সিন্ডিকেট করে। রমজানের আগে লম্বা বেগুনের দাম ছিল ৪০ টাকা, আর গোল বেগুনের কেজি ছিল ৫০ টাকা। গোল বেগুনের দাম ৫০ টাকায় রয়েছে। কিন্তু লম্বা বেগুনের দাম কেজিতে ৩০-৪০ টাকা বাড়িয়ে বিক্রি করা হচ্ছে ৭০-৮০ টাকায়। কোনো কোনো বাজারে ১০০ টাকায়ও বিক্রি হতে দেখা গেছে। অর্থাৎ বাজারে এখন ৩-৪ প্রকার দামে বিক্রি হচ্ছে বেগুন। তা ছাড়া কাঁচামরিচ কেজিতে ২০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকায়। আর ভোজ্যতেলে লিটারপ্রতি দাম বেড়েছে ৩-৫ টাকা। বোতলজাত প্রতি লিটার সয়াবিন তেল রোজার আগে বিক্রি হয়েছে ১০৫ টাকায় এখন বিক্রি হচ্ছে ১১০ টাকায়।

রাজধানীর কাওরান বাজারের সবজি বিক্রেতারাই বেগুন বিক্রি করছেন তিন/চার রকম দামে। বাজারের খুচরা বিক্রেতা আতিক লম্বা বেগুনের দাম চাইলেন ১০০ টাকা। আরেক বিক্রেতা বিক্রি করছেন ৮০ টাকা কেজিতে। আরেক বিক্রেতা বিক্রি করছেন ৬০ টাকায়। আর মাত্র ৫ হাত দূরে পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি লম্বা বেগুন বিক্রি হচ্ছে ৩৫-৪০ টাকায়।

বেগুনের হরেক দামের কারণ কী? জবাবে বিক্রেতারা বলেন, বেগুনের মানের ওপর দাম নির্ভর করে। যার মান সবচেয়ে ভালো, তা ১০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছে। এক সপ্তাহ আগে এটি ৪০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

রমজানের ইফতারিতে প্রধান উপকরণ খেজুরের দামও বেড়েছে অস্বাভাবিক। খেজুরের দাম কেজিতে নিম্নে ২০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। বাজারে সবচেয়ে দামি খেজুর আম্বার ব্রান্ডের। এ খেজুরের দাম আগে ছিল ২ হাজার টাকা কেজি। এখন বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৫০০ টাকায়। মরিয়ম প্রতি কেজি ৮০০ টাকায় বিক্রি হলেও এখন দাম ১২০০ টাকা। গান্দিয়লা খেজুর বিক্রি হচ্ছে ৪০০ টাকার বদলে ৬০০ টাকায়। টোকারি প্রতি কেজি খেজুর ৬০০ টাকার বদলে ৮৫০ টাকা কেজি, রসোদা ব্রান্ডের খেজুর ২৫০ টাকার বদলে ৪০০ টাকা, তিউনিশিয়ান খেজুর ৪৫০ টাকার থেকে বেড়ে ৭৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কম দামের সর্বনিম্ন স্তরের বড়ই খেজুর প্রতি কেজি ২০০ টাকার স্থলে বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ টাকায়। এগুলোর পাশাপাশি খুচরা মূল্যে রেজিস প্রতি কেজি ৪৫০ টাকা, ইরাকি খেজুর ২৫০ টাকা, নাগাল ৩০০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে।

ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন স্বল্প আয়ের মানুষ। কাওরান বাজারে পণ্য কিনতে আসা তেজকুনিপাড়ার বাসিন্দা কাসেম বলেন, বাজারে এসেছিলাম ২ হাজার টাকা নিয়ে। মাছ, মাংস, কাঁচাবাজার এবং কিছু ইফতারি পণ্য কিনতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ইফতারি পণ্য আর মাছ কিনতেই আমার টাকা শেষ। অর্ধেক পণ্য কিনেই ঘরে ফিরতে হচ্ছে।

এদিকে মাছের বাজার চড়া। দুই মাস বন্ধ থাকার পর ইলিশ ধরা শুরু হলেও বাজারে কম দামে মিলছে না সুস্বাদু মাছটি। মাঝারি মানের এক হালি ইলিশের দাম রাখা হচ্ছে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা। আর এক কেজি ওজনের মাছ প্রতিটি বিক্রি হচ্ছে ১২০০ থেকে দেড় হাজার টাকায়। এ ছাড়া অন্যান্য মাছের দামও আকাশছোঁয়া।

এদিকে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিএসটিআই’র অনুমোদনহীন কসমেটিকস, জুস ও শিশুখ্যাদ্য বিক্রয় করার আলমাস সুপার শপসহ ২১টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করেছে জাতীয় মান নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইন্সটিটিউশন (বিএসটিআই)।

http://mzamin.com/article.php?mzamin=171789&cat=2