৯ মে ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ১০:৩৫

সুপেয় পানি মিলছে না ঢাকায়

কোন এলাকায় মান খারাপ জানতে চান হাইকোর্ট

নগরবাসীর জন্য সরবরাহ করা পানি শতভাগ বিশুদ্ধ ও প্রতিটি ফোঁটাই সুপেয় বলে ঢাকা ওয়াসা দাবি করলেও তার সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বরং নগরবাসীর মতে, পাইপলাইনে তারা যে পানি পাচ্ছেন, তার বেশির ভাগেই মিলছে জীবাণু, নানা ধরনের ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া ও ময়লা-আবর্জনা। এসব পানি ব্যবহার করে নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ার অভিযোগও মিলছে। এমন প্রেক্ষাপটে রাজধানীর কোন কোন এলাকায় পানির মান বেশি খারাপ, সে ব্যাপারে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে প্রতিবেদন দিতে বলেছেন হাইকোর্ট।

সম্প্রতি অ্যাডভোকেট তানভীর আদালতে ওয়াসার পানির মান নিয়ে রিট করলে আদালত ওয়াসার পানির মান সম্পর্কে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কাছে মতামত চান। গতকাল বুধবার স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব জহিরুল ইসলাম আদালতে হাজির হয়ে এ জন্য চার মাস সময় প্রার্থনা করেন। তিনি বলেন, 'ঢাকা ওয়াসার ল্যাবে বিভিন্ন এলাকার পানি পরীক্ষা করতেও তিন মাস সময় লেগে যাবে।' এ অবস্থায় আদালত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবে পানি পরীক্ষার নির্দেশ দিয়ে রিপোর্ট পেশের নির্দেশ দেন। এ জন্য চার মাস সময় দেন আদালত।

সাম্প্রতিক সময়ে ওয়াসার পানির মানহীনতা নিয়ে ব্যাপক অভিযোগ উঠছে। গত ১৭ এপ্রিল ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ঢাকা ওয়াসা নিয়ে একটি প্রতিবেদন পেশ করে। টিআইবি জানায়, ওয়াসার পানি দূষিত হওয়ার কারণে ৯৩ শতাংশ গ্রাহক পানি ফুটিয়ে পান করেন। এ জন্য নগরবাসীকে বছরে ৩৩২ কোটি টাকার গ্যাস পোড়াতে হয়। টিআইবির ওই রিপোর্টকে 'একপেশে', 'উদ্দেশ্যমূলক' ও 'ভিত্তিহীন' হিসেবে দাবি করে ওয়াসা। ২০ এপ্রিল সংবাদ সম্মেলন করে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান বলেন, 'ওয়াসার পানি শতভাগ বিশুদ্ধ। ফুটিয়ে খাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।'

পরে গত ২৩ এপ্রিল জুরাইনের বাসিন্দা মিজানুর রহমান সেখানে সরবরাহ করা ওয়াসার পানিতে লবণ-লেবু দিয়ে শরবত বানিয়ে সংস্থার এমডি তাকসিম এ খানকে খাওয়ানোর জন্য কারওয়ান বাজারের ওয়াসা ভবনে যান। কিন্তু তিনি তা পান করেননি।

এরপর গত ৭ মে বুধবার নিরাপদ পানি আন্দোলন জাতীয় প্রেস ক্লাবে ঢাকা ওয়াসার পানি নিয়ে গণশুনানির আয়োজন করে। শুনানিতে বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দা বোতলে ভরে স্থানীয় পানির নমুনা নিয়ে যোগ দেন। তারা ওয়াসার পানির মানহীনতার নানা ফিরিস্তি তুলে ধরেন।

জুরাইনের বাসিন্দা মো. রিফাত বলেন, কয়েক বছর ধরে জুরাইন এলাকার পানির মান এত খারাপ হয়েছে যে এ পানি খেয়ে নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন জনসাধারণ। তার মা ও বাবার কিডনির সমস্যা দেখা দিয়েছে। ওয়াসার দূষিত পানি পান ও ব্যবহারের কারণেই বাবা-মায়ের কিডনিতে সমস্যা দেখা দিয়েছে বলে তার ধারণা। বিষয়টি তিনি পরীক্ষা করে দেখার অনুরোধ জানান।

নিরাপদ পানি আন্দোলনের আহ্বায়ক মিজানুর রহমান বলেন, শরবত খাওয়ানোর চেষ্টা করার পর জুরাইন এলাকায় পানির সংকট ও মানহীনতা দুটোই বেড়েছে। ওয়াসার লোকজন তাকে নানা ধরনের হুমকি-ধমকি দিচ্ছে।

সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাইপলাইনের মাধ্যমে বাসাবাড়িতে সরবরাহ করা পানির প্রায় ৮২ শতাংশ পানিতে ই-কোলাই ভাইরাসের জীবাণু মিলেছে। আর দেশের পানীয় জলের নিরাপদ উৎসের ৪১ শতাংশে রয়েছে ই-কোলাই এবং ১৩ শতাংশে রয়েছে আর্সেনিক। ৩৮ শতাংশ গভীর নলকূপের পানিতেও পাওয়া গেছে ই-কোলাই ও আর্সেনিক ভাইরাস। পাকস্থলী ও অন্ত্রের প্রদাহের জন্য ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়াকে দায়ী করা হয়।

আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর'বি) একজন গবেষণা কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সমকালকে বলেন, ওয়াসা যে উৎস থেকে পানি সংগ্রহ করে শোধন করে, সেই পানির মান এতই খারাপ যে সেটা শোধন করেও এসব ভাইরাসকে নিবারণ করা যায় না। এ জন্য ওয়াসা অতিরিক্ত রাসায়নিক মিশিয়ে শোধনের চেষ্টা করে। এতে শরীরের কোষগুলো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। লিভার, কিডনিসহ নানা ধরনের সমস্যা হতে পারে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসিউটিক্যালস কেমিস্ট্রি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আবদুল মজিদ সমকালকে বলেন, গভীর নলকূপের পানির মান কিছুটা ভালো হলেও অনেক ক্ষেত্রেই জীবাণু থেকে যায়। এসব জীবাণু পেটে গেলে ডায়রিয়া, আমাশয়, টাইফয়েডসহ নানা রোগ হতে পারে। পানির এসব ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াকে নিষ্ফ্ক্রিয় করার জন্য ক্লোরিন ব্যবহার করে পানিকে বিশুদ্ধ করে ওয়াসা। ওয়াসার পানির সরবরাহ লাইনেও অনেক লিকেজ থাকে। এসব লিকেজ দিয়েও নানা ধরনের ব্যাকটেরিয়া সরবরাহ লাইনে ঢুকে থাকে। কিন্তু অতিরিক্ত ক্লোরিন মেশানো হলে তা মানবস্বাস্থ্যের জন্য আরও বিপজ্জনক।

নগরবাসীর অভিযোগ, গভীর নলকূপের পানিতে ক্লোরিন মিশিয়ে শোধন করে সরবরাহ লাইনে দেওয়ার কথা ঢাকা ওয়াসার। কিন্তু অনেক পাম্পেই সেটা করা হয় না। যে সরবরাহ লাইন নিয়ে পানি গ্রাহকের ট্যাপে পৌঁছে, সেই লাইনেও রয়েছে অসংখ্য ছিদ্র। এসব ছিদ্র দিয়েও ময়লা-আবর্জনা পাইপে ঢুকে পড়ে। এ ছাড়া সায়েদাবাদ ও চাঁদনীঘাট পানি শোধনাগারে শীতলক্ষ্যা ও বুড়িগঙ্গা নদীর পানি শোধন করে পাইপলাইনে দেওয়া হয়। শুস্ক মৌসুমে দুটি নদীর পানির মানই অতি নিম্ন ও বিষাক্ত হয়ে পড়ে। চ্যানেল দিয়ে মলমূত্রসহ নানা আবর্জনামিশ্রিত পানি শোধনাগারে প্রবেশ করে। ই-কোলাই ভাইরাসের উপকরণ মলমূত্র। ওই পানি শোধনের সময় মাত্রাতিরিক্ত ক্লোরিন, লাইম (চুন) ও অ্যালাম (ফিটকিরি) ব্যবহার করা হয়। ফলে শোধনের পরও অনেক সময় পানিতে জীবাণু থেকে যায়। অতিরিক্ত রাসায়নিক ব্যবহারের ফলে পানিতে গন্ধও পাওয়া যায়। ওই পানি স্বাস্থ্যের জন্য আরও ক্ষতিকর। অনেক ক্ষেত্রে স্যুয়ারেজ লাইনের সঙ্গে ওয়াসার পাইপলাইনেরও সংযোগ ঘটে যায়।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক মহাপরিচালক প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক বলেন, ঢাকা ওয়াসা নিরাপদ পানি সরবরাহ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এ দায় ওয়াসাকে স্বীকার করতেই হবে। কারণ, পানি আর পাইপলাইন দুটোই ওয়াসার। আর সুপেয় পানি পাওয়ার ন্যায্য অধিকার জনগণের রয়েছে।

https://samakal.com/capital/article/1905612