৯ মে ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ১০:৩১

দূষিত হচ্ছে হাতিরঝিল

পানি পরিশোধনের জন্য একটি প্রকল্প নেয়া হয়েছে

গত কয়েক বছরে ইট-পাথরে আর কংক্রিটে ঘেরা যান্ত্রিক রাজধানীর মানুষের অন্যতম বিনোদনকেন্দ্রের নাম হাতিরঝিল। একটু বুকভরে নিশ্বাস নিতে প্রতিদিনই মানুষ আসে হাতিরঝিলে। যানজটের জালে বন্দি রাজধানীবাসীর জন্য পরিবহন ব্যবস্থায় হাতিরঝিলে যুক্ত হওয়া নতুন বাহন ওয়াটার ট্যাক্সিতেও প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ যাতায়াত করেন। তবে এই মানুষগুলো ইদানিং পড়েছেন সীমাহীন বিড়ম্বনায় আর বিপাকে। কারণ হাতিরঝিলের পানি থেকে ভেসে আসছে তীব্র দুর্গন্ধ।

এর কারণ হিসেবে জানা গেছে, গুলশান লেকসহ আশপাশের এলাকার নোংরা এবং ময়লা-আবর্জনায় ভরা পানি সরাসরি প্রবেশ করছে হাতিরঝিলে। এতে রাজধানীর অন্যতম বিনোদনকেন্দ্র হয়ে ওঠা হাতিরঝিলের পানি ফিরে যাচ্ছে তার পুরনো রূপে। দূষিত হচ্ছে হাতিরঝিলের পানি। নষ্ট হচ্ছে এর পরিবেশ। যদিও রাজধানীর হাতিরঝিল প্রকল্পের মতো গুলশান-বনানী-বারিধারার লেকগুলোও দৃষ্টিনন্দন করতে চায় সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সালে গুলশান-বনানী-বারিধারা লেক উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-রাজউক। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২১ সালে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও গুলশান-বনানী-বারিধারা লেক উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চার বছরেও শুরু না হওয়ায় এখানকার মানুষের জনদুর্ভোগ বাড়ছে। সময়মতো এ প্রকল্পের কাজ না হওয়ায় ময়লা পানি ড্রেনের মাধ্যেমে লেকের পানিতে পড়ছে।

এতে করে লেকের পানি দূষিত হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, গুলশান-বনানী লেক উন্নয়ন প্রকল্প জনকল্যাণের সাথে সম্পৃক্ত। এ কারণে এ প্রকল্পটি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দেখা হবে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, হাতিরঝিল লেকের উৎকট গন্ধে পানিতে বোটিং কিংবা পাশ দিয়ে হেঁটে বেড়ানো দুষ্কর হয়ে উঠেছে। নগরবাসীর নির্মল শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়ার এ মুক্ত বিনোদনকেন্দ্রের পানি দূষিত হয়ে ওঠায় হতাশ এই পথে চলাচলকারীরা। বর্তমানে এই দুর্গন্ধ এতই তীব্র আকার ধারণ করেছে যে, নাকে রুমাল চাপা ছাড়া কেউই ওয়াটার ট্যাক্সিতে চলাচল করতে পারছেন না।

গুলশান লেকের ময়লা-আবর্জনায়ময় পানি হাতিরঝিলে প্রবেশ করাতে মশা-মাছি এবং পানির দুর্গন্ধসহ আরও অনেক সমস্যা পোহাতে হচ্ছে দর্শনার্থীদের। মশা আর পানির দুর্গন্ধে ক্রমেই বিরক্ত হচ্ছে হাতিরঝিলের দর্শনার্থীরা।
দর্শনার্থী মাকসুস মাহমুদ জানান, অফিসের কাজ শেষ করে নিরিবিলি একটু সময় কাটানোর জন্য হাতিরঝিলে আসি। এখানে এসেও শান্তি নেই। পরিবার নিয়ে ঘুরতে আসা আরিফুর রহমান জানান, এখানে মাঝে মধ্যেই আমি পরিবার নিয়ে ঘুরতে আসি। কিন্তু সন্ধ্যার পরে মশার জন্য বেশিক্ষণ এক জায়গায় টেকা দায়। বন্ধুদের নিয়ে ঘুরতে আসা শিক্ষার্থী এহসান জানান, ক্লাস শেষ করে বা রাতে বন্ধুদের নিয়ে হাতিরঝিলে সময় কাটাই। কিন্তু হাতিরঝিলের যে পরিবেশ তাতে এখানে বেশিক্ষণ থাকতে মন চায় না।

জানা গেছে, মহাখালী, পান্থপথ, কাওরান বাজার, কাঁঠালবাগান, নিকেতন, গুলশান লেক, রামপুরা, বাড্ডা, তেজগাঁও, মগবাজার, বেগুনবাড়ী, মধুবাগ এলাকার ১৩টি পথ দিয়ে পানি আসে হাতিরঝিলে। এই পানির অধিকাংশ থাকে পয়োবর্জ্যমিশ্রিত। এ সমস্যা সমাধানের জন্য হাতিরঝিলে পানি নামার ৯টি পথে বর্জ্যশোধনাগার যন্ত্র বসানো হয়েছিল। কিন্তু ইতোমধ্যেই কয়েকটি যন্ত্র নষ্ট হয়ে গেছে। আর পানির চাপ বেশি থাকলে এই যন্ত্রগুলো কাজ করে না। এতে হাতিরঝিলের পানি থেকে উৎকট দুর্গন্ধ সৃষ্টি হচ্ছে। ড্রেন দিয়ে আশপাশে এলাকার পচা আবর্জনা ঝিলে প্রবেশ করে নষ্ট করছে পানির স্বচ্ছতা। এ পানি অনেক দিন ঝিলে আটকে থাকায় ক্রমেই পানির রঙ কালো, সবুজ, ধূসর রঙ ধারণ করেছে। যে কারণে সৃষ্টি হয়েছে তীব্র দুর্গন্ধের।

হাতিরঝিলের সৌন্দর্য্য উপভোগের পাশাপাশি সহজে যাতায়াত করতে হাতিরঝিলে ‘ওয়াটার ট্যাক্সি’ সার্ভিসটি খুব অল্প সময়েই জনপ্রিয়তা পায়। হাতিরঝিলে চারটি স্থান থেকে ওয়াটার ট্যাক্সি চলাচল করে। গুলশান-১ গুদারাঘাট, এফডিসি মোড়, রামপুরা ব্রিজ ও পুলিশ প্লাজা থেকে চলাচল করে ওয়াটার ট্যাক্সি। এসব স্থান থেকে প্রতিদিন কয়েক হাজার মানুষ যাতায়াত করেন। কিন্তু হাতিরঝিলের পানিতে তীব্র দুর্গন্ধের কারণে এসব যাত্রীদের কাছে দুর্গন্ধের বিড়ম্বনা প্রকোপ আকার ধারণ করেছে।

ওয়াটার ট্যাক্সির একজন চালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পুরো হাতিরঝিলের পানিতে এখন দুর্গন্ধ। রঙ-ও কালচে হয়ে গেছে। এর মধ্যে দিয়ে যখন ওয়াটার ট্যাক্সি চলাচল করে তখন ইঞ্জিনের কারণে সৃষ্ট ঢেউয়ে অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যায়। তখন দুর্গন্ধের কারণে যাত্রীদের ওয়াটার ট্যাক্সিতে বসে থাকাই কষ্টকর হয়ে পড়ে। সবাই ওয়াটার ট্যাক্সিতে নাক চেপে ধরে হাতিরঝিল পার হন। এমন অবস্থা চলতে থাকলে আমাদের যাত্রী কমে যাবে। তাই এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি।
জানা গেছে, হাতিরঝিলের পানিতে দুর্গন্ধ সমস্যা সমাধানের জন্য পানি পরিশোধনের একটি প্রকল্প নেয়া হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় পানিশোধনের জন্য অস্ট্রেলিয়ায় তৈরি হাই-ক্যাপাসিটি এয়ার কম্প্রোসর স্থাপনসহ আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে। দূষণের প্রধান উৎস পান্থপথ বক্স কালভার্ট থেকে আসা পয়োবর্জ্য যাতে ঝিলে ছড়িয়ে না পড়ে, সে ব্যবস্থা করা হবে। প্রায় ৪৯ কোটি টাকার প্রকল্পটি আগামী বছরে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।

হাতিরঝিলে পানিতে দুর্গন্ধ বিষয়ে হাতিরঝিল প্রকল্পের পরিচালক (রাজউক) এস এম রায়হানুল ফেরদৌস বলেন, হাতিরঝিলের পানিতে দুর্গন্ধ দূর করার জন্য আমরা কাজ করছি। সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটির জন্য বেশ কিছু যন্ত্রপাতি অস্ট্রেলিয়া থেকে আমদানি করতে হবে। এটি প্রক্রিয়াধীন আছে। এটি বাস্তবায়ন হলে আশা করা যায় হাতিরঝিলের পানিতে আর কোনো দুর্গন্ধ থাকবে না।

হাতিরঝিল প্রকল্পটি বাস্তবায়ন ও তদারকি করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ‘স্পেশাল ওয়ার্কস অরগানাইজেশন’ (এসডবিøউও)। হাতিরঝিলের প্রকল্প পরিচালক মেজর জেনারেল আবু সাঈদ মো. মাসুদ বলেন, গুলশান-বনানী লেকের ময়লা নোংরা পানি এসে হাতিরঝিলের পানিকে নোংরা করে দিচ্ছে। পয়:নিস্কাশিত ওই পানিগুলো যাতে হাতিরঝিলে প্রবেশ না করে সে জন্য রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (রাজউক) বলা হয়েছে। তিনি বলেন, গুলশান-বনানী লেকের নোংরা পানি যদি হাতিরঝিলে প্রবেশ বন্ধ না হয় তাহলে হাতিরঝিল রক্ষা করা সম্ভব নয়। সবাই মিলে কাজ করলেই কেবল আমরা মশা আর দুর্গন্ধমুক্ত একটি সুন্দর হাতিরঝিল পাব। প্রকল্প পরিচালক মেজর জেনারেল সাঈদ মাসুদ বলেন, আগে গুলশান-বনানীর পানি যাতে হাতিরঝিলে না আসতে পারে সেজন্য বাঁধ দেয়া ছিল। এখন সে বাঁধ নেই। এতে করে ময়লা পানি এসে একাকার হয়ে যাচ্ছে।

https://www.dailyinqilab.com/article/204947