৯ মে ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ১০:৩৯

আগামী নির্বাচনগুলোয় কি তবে নিঃশব্দ দুর্নীতি হবে?

নির্বাচন কমিশন ও সরকারের কর্মকাণ্ড থেকে প্রতীয়মান হচ্ছে যে, বাংলাদেশের আগামী দিনের নির্বাচনী দুর্নীতি সশব্দ বৈশিষ্ট্য থেকে নিঃশব্দ রূপ ধারণ করবে।

এতদিন বিভিন্ন নির্বাচনে যে ভঙ্গিমায় দুর্নীতি হয়েছিল তা ছিল সশব্দ। এসব নির্বাচনে অস্ত্রবাজির শব্দ, ভোট কেন্দ্র দখল, ব্যালট পেপার কাটাকাটির শব্দ ছিল। সন্ত্রাসীদের বোমাবাজি, বিরোধীদলীয় এজেন্টদের হুমকি-ধমকি দিয়ে কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়ার উচ্চকণ্ঠ চেঁচামেচি ছিল।

ভোট কেটে ব্যালট বাক্স ভরতে দলীয় ক্যাডারদের প্রিসাইডিং অফিসারদের প্রতি সশব্দ হুমকি-ধমকি ছিল। ভোট দিতে এসে নিজের ভোট আগেই অন্য কেউ দিয়ে দিয়েছে শুনে দেশপ্রেমিক ভোটারদের সশব্দ প্রতিবাদ ছিল।

ভোট দিতে অনেক সময় লাগলে এবং বুথের বাইরে লাইন বেশি দীর্ঘ হলে অপেক্ষমাণ ভোটারদের সশব্দ প্রতিবাদী উচ্চারণ ছিল। ছিল ভোট গণনাকালে বাইরে অপেক্ষমাণ নেতা-কর্মী-সমর্থকদের দু-একটি কেন্দ্রের ফলাফল জানার পর উচ্চারিত স্লোগান। আরও ছিল ভোট গণনা শেষে সশব্দ আনন্দের বহিঃপ্রকাশ ও বিজয় মিছিল।

তবে এখন নির্বাচনী দুর্নীতির চরিত্রে পরিবর্তন আসবে বলে মনে হচ্ছে। কারণ, সরকার ও নির্বাচন কমিশন সম্প্রতি ইভিএমের প্রতি অধিক নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।

যদিও ইতিপূর্বে ইভিএম ব্যবহার করে ইসি উল্লেখযোগ্য সুফল পায়নি, এ মেশিনকে অধিকতর সক্ষম করার লক্ষ্যে ক্রয় করা ৪৬ কোটি টাকার ট্যাব ব্যবহারেও ব্যর্থ হয়েছে, তারপরও তারা নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।

প্রতিবেশী ভারতসহ উন্নত প্রযুক্তিসমৃদ্ধ দেশগুলোতে যখন ইভিএমের বিরুদ্ধে ভোটার এবং বিরোধী দলগুলো বিষোদ্গার করছে, একে বলছে ‘ভোট চুরির মেশিন’ এবং পাশ্চাত্যের অনেক দেশ যখন ইভিএম বাতিল করে কাগজের ব্যালটের সনাতনী ভোট ব্যবস্থায় ফিরে এসেছে, তেমন সময় প্রযুক্তি অসচেতন ভোটারের বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশনের রহস্যজনকভাবে ইভিএমের প্রতি আস্থা বেড়েছে।

উল্লেখ্য, প্রযুক্তিসমৃদ্ধ দেশ জার্মানি ২০০৫ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত, নেদারল্যান্ডস ১৯৯০ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত এবং আয়ারল্যান্ড ২০০২ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত ইভিএমে নির্বাচন অনুষ্ঠান করার পর বিভিন্ন ত্রুটিজনিত কারণে আবার সনাতনী কাগজের ব্যালট প্রথায় নির্বাচন অনুষ্ঠানে ফিরে এসেছে।

এ অবস্থায় স্বল্পশিক্ষিত ভোটারের বাংলাদেশে ইভিএমের প্রতি নাগরিক সমাজের আস্থা সৃষ্টি না করে এবং ইভিএমকে হ্যাকপ্র“ফ প্রমাণ না করেই রহস্যজনক কারণে এ মেশিনে নির্বাচন করার প্রতি বাড়তি আগ্রহ প্রদর্শন রহস্যজনক প্রতীয়মান হয়।

বাংলাদেশে ‘রাতে কাটিং দিনে কাউন্টিং’-এর প্রহসনের ‘মিডনাইট ইলেকশন’খ্যাত একাদশ সংসদ নির্বাচনে মাত্র ছয়টি নির্বাচনী আসনে ইভিএমে ভোট করতে গিয়ে লেজেগোবরে অবস্থা তৈরি করার পরও ইসির ইভিএমের প্রতি এতটা আস্থাবান হওয়ার বিষয়টির মধ্যে লুকায়িত দুরভিসন্ধি উন্মোচনে নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের কপালে ভাঁজ পড়েছে।

কারণ, ওই নির্বাচনে ভোটের দিনের আগে মধ্যরাতেই অধিকাংশ ভোট কেন্দ্রে ব্যালট বাক্স ভরে ক্ষমতাসীনদের বিজয় যে সুনিশ্চিত করা হয়েছিল সে বিষয়টি সিইসির বক্তব্যসহ বিভিন্ন সূত্র এবং নাগরিক সমাজের পর্যবেক্ষণে বিশ্বাসযোগ্যতা পেয়েছে।

অতি সম্প্রতি রাজনীতির নতুন অদৃশ্য বোঝাপড়ার খেলায় বিএনপি মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাদে দলটির বাকি পাঁচজন সংসদ সদস্য শপথ গ্রহণ করার পর সংসদে যোগ দেন। এর মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসন থেকে নির্বাচিত বিএনপি এমপি হারুনুর রশিদ বলেন, ৩০ ডিসেম্বর বাংলাদেশে কোনো নির্বাচন হয়নি, বরং ওই নির্বাচনে মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করা হয়েছে। ২৯ ডিসেম্বরই ভোট হয়ে গেছে। উপজেলা নির্বাচনে ৫ শতাংশ ভোটারও উপস্থিত হয়নি বলে তিনি ভোটের প্রতি সৃষ্ট নাগরিক সমাজের অনীহার প্রতি সংসদীয় বক্তব্যে আলোকপাত করেন।

তাছাড়া কারাবন্দি বিএনপি চেয়ারপারসনকে জামিন না দেয়ার তীব্র সমালোচনা করে তিনি বলেন, খুন, ধর্ষণ, মাদকের মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরাও জামিন পায়, সে কারণে বৃদ্ধ বয়সে অসুস্থ ও হুইলচেয়ারে চলাফেরা করা খালেদা জিয়াকে তিনি অচিরেই জামিন দেয়ার দাবি জানান।

কেন শেষ মুহূর্তে এসে এ পাঁচ এমপি কার নির্দেশে সংসদে কী উদ্দেশ্যে যোগ দিলেন এবং এর পেছনে সরকারি দলের সঙ্গে কোনো অঘোষিত ও অদৃশ্য বোঝাপড়া আছে কিনা তা আর কিছুদিনের মধ্যেই হয়তো স্পষ্ট হবে।

প্রতিবেশী ভারতের নির্বাচন থেকেও বাংলাদেশের ইসি শিক্ষাগ্রহণ করতে চাইছে না। দেশটির চলমান ১৭তম লোকসভা নির্বাচনে ইভিএম নিয়ে বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে।

এ সম্পর্কে আমি এ পত্রিকার পাঠকদের আগেও অবগত করেছি। অন্ধ্রপ্রদেশে ও পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহারে ঘটেছে ইভিএম ভাংচুরের ঘটনা। পশ্চিমবঙ্গের উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী রবীন্দ্রনাথ ঘোষ ৮০টি ইভিএমে বিভ্রাট ঘটার অভিযোগ তুলে ওইসব বুথে পুনঃনির্বাচন দাবি করেছেন।

লোকসভা নির্বাচনের প্রথম তিন পর্বে ইভিএম নিয়ে নানাবিধ সমস্যা হয়েছে। লোকসভা নির্বাচনের দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্বে ভোট শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিভিন্ন রাজ্য থেকে ইভিএম বিভ্রাটের খবর আসে। তামিলনাড়ুতে ৩৫০টি ইভিএম পরিবর্তন করতে হয়েছে বলে জানিয়েছে ভারতীয় নির্বাচন কমিশন।

দ্বিতীয় পর্বে ইভিএম বিভ্রাটের কারণে ভোট দিতে গিয়ে অসুবিধায় পড়েন রায়গঞ্জের কংগ্রেসপ্রার্থী দীপা দাস মুন্সি। ইসলামপুর এবং শিলিগুড়িতেও একই রকম অভিযোগ পাওয়া যায়। ইসলামপুরে ভিভিপ্যাট বিকল হয়ে পড়ায় তৃণমূল কংগ্রেসপ্রার্থী কানাইয়ালাল আগরওয়ালকে দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।

শিলিগুড়িতেও ইভিএমজনিত সমস্যায় ভোট শুরু হতে এক ঘণ্টা দেরি হয়। তৃতীয় পর্বে ইভিএমের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন সমাজবাদী পার্টির প্রধান অখিলেশ যাদব ও কেরালার বিজেপি জোটপ্রার্থী। এ পর্বে কেরালা, বিহার, উত্তরপ্রদেশ ও গোয়ার ৩৫০টিরও বেশি ইভিএম কাজ করেনি।

অখিলেশ এক টুইটার বার্তায় বলেন, ‘দেশজুড়ে হয় ইভিএম কাজ করছে না, নয়তো বিজেপিতে ভোট চলে যাচ্ছে।’ আবার বিজেপি প্রার্থীরাও অনেক ক্ষেত্রে ইভিএমের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করেন। কেরালায় বিজেপি প্রার্থী তুষার ভেলাপেল্লি রাজ্যের নির্বাচনী কর্মকর্তাকে জানান, কেউ দু’বার বোতাম টিপলেই ভোট বদলে যাচ্ছে।

ইভিএম নিয়ে পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক হিসেবে পরিচিত প্রতিবেশী ভারতে যখন এহেন বাকবিতণ্ডা, বিতর্ক চলছে অন্য অনেক প্রযুক্তিসমৃদ্ধ দেশেও, তেমন অবস্থায় বাংলাদেশে বিরোধী দলের ইভিএম বিরোধিতা এবং নাগরিক সমাজের মধ্যে এ মেশিনের ওপর আস্থা না থাকা সত্ত্বেও এ দেশের নির্বাচন কমিশন আগামী নির্বাচনগুলোতে ইভিএম ব্যবহারে কোন্্ অদৃশ্য কারণে মরিয়া হয়ে উঠছে তা গবেষণার বিষয়।

ইসি ২০২০ সালে অনুষ্ঠেয় ঢাকা উত্তর, ঢাকা দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনসহ সব স্থানীয় সরকার নির্বাচন এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫০ আসনে ইভিএমে ভোটগ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সে লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না করে ইসির মধ্যে একরকম তাড়াহুড়োও লক্ষ করা যাচ্ছে।

উল্লেখ্য, মধ্য-২০১৮ সালে ইসি দেড় লাখ ইভিএম ক্রয়ের যে ৩ হাজার ৮২৫ কোটি টাকার প্রকল্প গ্র্রহণ করে তা ২০২৩ সালে শেষ হওয়ার কথা। ইভিএমগুলো প্রথম ধাপে ৮২ এবং পরবর্তী দুই ধাপে ৩৪ হাজার করে পর্যায়ক্রমে তিন ধাপে ক্রয় করার পরিকল্পনা করা হয়।

প্রথম ধাপের ৮২ হাজার ইভিএম ক্রয়ে ইসির প্রয়োজন ১ হাজার ৯২১ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। ইসি ইভিএম ক্রয়ে এতই ব্যস্ত হয়ে পড়ে যে, এ টাকা জোগাড় না করেই বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরিকে উল্লিখিত ইভিএম সরবরাহের কার্যাদেশ প্রদান করে।

পরবর্তী সময়ে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ৭৯৭ কোটি টাকা পেলে ইসি বাকি ১ হাজার ১২৪ কোটি টাকা জোগাড়ের প্রচেষ্টা চলমান রাখে। এখন শোনা যাচ্ছে, সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির অব্যয়িত অর্থ থেকে ইসি প্রয়োজনীয় টাকা পাওয়ার সরকারি আশ্বাস পেয়েছে।

এ প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় লোকবল নিয়োগ থেকে শুরু করে কোনো পর্যায়েই পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুল মানা হয়নি। এজন্যই ইসি অর্থ বরাদ্দ হওয়ার আগেই প্রকল্পের মালামাল ক্রয়ের কার্যাদেশ দিতে পেরেছে। ইভিএমে নির্বাচন করার ইসির এ বাড়তি আগ্রহ সুধীমহলে নির্বাচনে ডিজিটাল কারচুপির সন্দেহ সৃষ্টি করেছে।

কারণ, যুগপৎ বিরোধী দলগুলো এবং নাগরিক সমাজ এ ইসির দায়িত্ব গ্রহণ করার পর গত সোয়া দুই বছরের কার্যকলাপ বিবেচনা করে এ কমিশনের ওপর মোটেও আস্থাশীল হতে পারেনি। তবে সরকারের শরিক দলগুলো বাদে প্রায় অন্য সব রাজনৈতিক দলের যেহেতু ইভিএমের ওপর আস্থা নেই, কাজেই এ ব্যাপারে তাদের চুপ না থেকে এখনই করণীয় নির্ধারণ করা উচিত।

নির্বাচন পর্যবেক্ষক ও গবেষকরা ইসির ইভিএম ক্রয়সংক্রান্ত অনিয়ম এবং এ বিষয়ে বাড়তি আগ্রহের লক্ষণ বিবেচনা করে মনে করছেন, আগামী নির্বাচনগুলোতে দুর্নীতি-কারচুপি, হুমকি-ধমকি ও অস্ত্রবাজি করে ব্যালট কেটে বাক্স ভরার মতো সশব্দ কার্যকলাপ হয়তো থাকবে না।

পরিবর্তে, বাহ্যিকভাবে নির্বাচন হবে নিঃশব্দ ও শান্তিপূর্ণ। সন্ত্রাস ও অস্ত্রবাজিমুক্ত। কিন্তু কারচুপি হয়ে যাবে নিঃশব্দে অদৃশ্য ডিজিটাল পদ্ধতিতে, যা সাধারণ ভোটাররা, এমনকি পোলিং ও প্রিসাইডিং অফিসাররাও বুঝতে পারবেন না।

সে কারণেই হয়তো বিদেশি গবেষণা প্রতিষ্ঠান দিয়ে ইভিএমের সক্ষমতা যাচাই করানো হয়নি। ফলে, এ মেশিন যে হ্যাকপ্র“ফ সে ব্যাপারে নাগরিক সমাজ, রাজনৈতিক দল ও ভোটারদের মধ্যে আস্থা-বিশ্বাস গড়ে ওঠেনি। অতঃপর বলা যায়, আগামী নির্বাচনগুলো এর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে হয়তো সশব্দ ও দৃশ্যমান দুর্নীতির পরিবর্তে অদৃশ্য এবং নিঃশব্দ দুর্নীতির চরিত্র যুক্ত করতে যাচ্ছে।

ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : অধ্যাপক, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

akhtermy@gmail.com

https://www.jugantor.com/todays-paper/window/175339