জিলহজ্জ মাসের ফযিলত ও করণীয়

আল্লাহ তা’য়ালা জ্বীন এবং মানবকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর ‘ইবাদত তথা জীবনের সকল ক্ষেত্রে তাঁর আদেশ নিষেধ মেনে চলার জন্যে, এর মাধ্যমে বান্দাহ লাভ করবে তার রবের সান্নিধ্য, বিনিময়ে পাবে সুখ শান্তি, আরাম আয়েশ দুনিয়া ও আখেরাতে। কিন্তু মানুষ শয়তানের প্ররোচনায় নাফসের ধোঁকায় অন্যায় অপরাধে জড়িয়ে পড়ে নিজেদের বিপদকে করে ত্বরান্বিত, সমাজকে করে কলুষিত। আল্লাহ্ তা‘য়ালা তাঁর বান্দার প্রতি অতি দয়াবান, আবার “তিনি মুমিনগণের অভিভাবক” (বাকারা-২৫৭)।  তাই মুমিনগণ কিভাবে তাদের কৃত অপরাধের জন্য সহজেই আল্লাহর নিকট মাপ পেয়ে তাঁর নৈকট্য লাভে সক্ষম  হবে, অল্প সময় ‘ইবাদত করে বেশী সওয়াব পাওয়ার সুবিধা পাবে, আল্লাহ মেহেরবানী করে তাঁর বান্দাদের জন্য এমন কিছু সুযোগ রেখে দিয়েছেন। যেমন, রামাদান মাস, লাইলাতুল কদর, আশুরা, জিলহজ্জ মাসের প্রথম দশ দিন ইত্যাদি। 

জিলহজ্জ মাসে রয়েছে বান্দার জন্য আল্লাহর পক্ষ হতে বিশেষ অফার, রয়েছে বিশেষ সুযোগ। বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধে সে বিষয় নিয়ে কিছু আলোকপাত করব ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ্ বলেন, “ফজরের শপথ, আরও শপথ দশ রাতের” (ফাজর-১,২) আল্লামা ইবনে কাছীর (রঃ) বলেন, এখানে দশ রাত বলতে জিলহজ্জ মাসের প্রথম দশককে বুঝানো হয়েছে। আল্লাহর এ শপথের মাধ্যমে উক্ত দশরাতের গুরুত্ব অনেক বেড়ে গিয়েছে। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন: “আর যাতে তারা মহান আল্লাহকে নির্দিষ্ট দিনগুলোতে বিশেষ ভাবে স্মরণ করে।” (হজ্জ:২৮) হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রাঃ) বলেন, এখানে নির্দিষ্ট দিনগুলো বলতে যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশদিনের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন : রসুল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফরমান “কোন ‘আমলই এ দশদিনের ‘আমলের সমকক্ষ হয়না।” সাহাবীগণ প্রশ্ন করলেন, জিহাদও নয়? তিনি উত্তর দিলেন: না, জিহাদও নয়। তবে হ্যাঁ, যে ব্যক্তি জানমাল দিয়ে জিহাদে বেরিয়ে যাওয়ার পর আর কোন কিছু নিয়েই ফেরত আসেনি (অর্থাৎ যিনি জান মাল দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ করে শহীদ হয়ে গেছেন, তার জিহাদ এ দশদিনের ‘আমলের সমকক্ষ হতে পারে) (বুখারী)

হযরত সাঈদ বিন যুবায়ের বলেন, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) জিলহজ্জ মাসের প্রথম দশদিন বেশী পরিমাণে ইবাদতে লিপ্ত থাকতেন। (দারেমী) হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে ওমর (রা:) বলেন, রসুল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফরমান: “মহান আল্লাহর নিকট এ দশদিনের নেক কাজের তুলনায় মহৎ ও প্রিয় আর কোন কাজ নেই, তাই তাতে তাক্বীর ধ্বনি, আল্লাহ তা‘য়ালার প্রশংসাবাণী ও তাঁর একত্ববাদের ঘোষণা করতে থাকো।” (তাবরানী)

আবু হোরায়রা (রা:) বলেন: রসুল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফরমান, “জিলহজ্জ মাসের দশদিনের ‘ইবাদতের চেয়ে অধিক পছন্দনীয় আর কোন ‘ইবাদত আল্লাহর নিকট নেই। প্রতিদিনের রোযা এক বৎসর রোযার সমকক্ষ, প্রতি রাতের ‘ইবাদত লাইলাতুল কদরের ‘ইবাদতের সমতুল্য। (তিরমিযী, ইবনে মাজা) ইমাম তিরমিযী বলেন: হাদীসটির সনদ দুর্বল।

এ দশ দিনের মাঝে রয়েছে একটি উল্লেখযোগ্য দিবস.তা হলো ‘আরাফার দিবস, যা অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ এবং ফজীলত পূর্ণ। রসুল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফরমান “আমি আল্লাহর নিকট চাই, আরাফার দিনের রোযার বিনিময়ে যেন অতীতের এক বৎসরের এবং ভবিষ্যতের এক বৎসরের গুনাহ্ মিটিয়ে দেয়া হয়।” (মুসলিম) আরাফার দিন বলতে ঐ দিনকে বুঝানো হয়, যে দিন হাজী সাহেবগণ আরাফার ময়দানে উপস্থিত হন। সেদিনটি হল জিলহজ্জ মাসের নয় তারিখ। ভবিষ্যতের এক বৎসরের গুনাহ্ বলতে বুঝানো হয়েছে, ভবিষ্যতে এক বৎসরের গুনাহ্ থেকে বেঁচে থাকার তৌফিক দেয়া। তবে যারা  হজ্জে যান, তারা আরাফার এ দিনের রোযা রাখবেন না। আল্লাহর রসুল আরাফার ময়দানে আরাফার এ দিনের রোযা রাখেন নি। কারণ এ দিন রোযা রাখলে হাজী সাহেবগণের শরীর দুর্বল হয়ে পড়তে পারে এবং এতে হজ্জের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিধান পালনে সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। আরাফার এদিনটি পুরো বৎসরের মাঝে সর্বশ্রেষ্ঠ দিন, যেমন লাইলাতুল কদর পুরো বৎসরের মাঝে সর্বশ্রেষ্ঠ রাত্রি। আরাফার দিনটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ দিন। আরাফায় অবস্থান করা হজ্জের তিনটি রোকনের অন্যতম একটি রোকন। যাবের (রা:) বলেন, রসুল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফরমান, “আরাফার দিন আল্লাহ্ প্রথম আকাশে অবতরণ করেন এবং আরাফায় অবস্থানরত হাজীদেরকে নিয়ে ফেরেশতাদেরকে গর্ব করে বলেন, আমার বান্দাদের দিকে তাকাও, তারা উশকু-খুশকু মাথায়, ধুলায় মিশ্রিত শরীর নিয়ে দূর দূরান্ত হতে লাব্বাইকের ধ্বনি দিতে দিতে এ ময়দানে এসে হাজির হয়েছে। আমি তোমাদেরকে সাক্ষী রেখে বলছি, আমি তাদেরকে মাফ করে দিলাম, ফেরেশতারা বলে, হে রব! উমুকতো এ গুনাহ করেছে, উমুকতো অপরাধী, উমুক মহিলাতো পাপী। আল্লাহ্ বলেন: আমি তাদেরকেও মাফ করে দিলাম। রসুল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আরাফার দিনের চেয়ে আল্লাহ অন্য কোন দিন এত অধিক সংখ্যক জাহান্নামীকে  মাফ করেন না। (শরহুসসুন্নাহ্) 

জিলহজ্জ মাসের ১০ তারিখ রয়েছে মুসলিম উম্মাহর বড় একটি আনন্দের দিন তা হলো কোরবানীর দিন। কোরবানী মুসলিম মিল্লাতের পিতা ইবরাহীম ‘আলাইহিস্ সালামের সুন্নাত। এ বিধান তাঁর থেকেই শুরু হয়েছে। জিলহজ্জ মাসের ১০ তারিখ যাদের নিকট প্রয়োজনীয় সামগ্রী ব্যতীত নেসাব পরিমাণ সম্পদ থাকে, তাদের উপর কোরবানী করা ওয়াজিব। আয়েশা (রা:) বলেন, রসুল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফরমান: “কোরবানীর দিন কোরবানীর চেয়ে উত্তম কোন আমল আল্লাহর নিকট নেই।” কোরবানীর জন্তুর রক্ত জমীনে পড়ার পূবের্ই আল্লাহর নিকট পৌঁছে যায়।” (তিরমিযী, ইবনে মাজা) “কোরবানীর জন্তুর প্রত্যেকটি পশমের বিনিময়ে একটি করে নেকী পাওয়া যায়।” (আহমদ, ইবনে মাজা) 

কোরবানী করতে ইচ্ছুক ব্যক্তির করণীয়: কোরবানী করতে ইচ্ছুক ব্যক্তির জিলহজ্জ মাসের চাঁদ উঠার পর হতে কোরবানী করার পূর্ব পর্যন্ত নিজের চুল, পশম, নখ, চামড়া না কাটা সুন্নাত। উম্মে সালমা (রা:) হতে বর্ণিত, রসুল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফরমান জিলহজ্জ মাস শুরু হলে তোমাদের মধ্যকার কোরবানী করতে ইচ্ছুক ব্যক্তি যেন তার চুল ও নখ না কাটে। (আহমদ, মুসলিম) অন্য বর্ণনায় এসেছে, কোরবানী না করা পর্যন্ত নিজের চুল এবং চামড়া কাটবে না। কোরবানীর ঈদের আগের দিন অর্থাৎ জিলহজ্জ মাসের ৯ তারিখ ফজর হতে তের তারিখ আছর পর্যন্ত প্রত্যেক ফরজ নামাজের সালামের পরপরই তাকবীর পাঠ করবে। তাকবীর হলো “আল্লাহু আকবর , আল্লাহু আকবর, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর ওয়ালিল্লাহিল হামদ।”

ঈদের দিন সকাল থেকে কিছু না খেয়ে কোরবানী করে সে গোশত দিয়ে সে দিনের খাবার শুরু করা উত্তম। রসুল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা-ই করতেন। কোরবানীর গোশত তিনভাগ করে এক ভাগ নিজের পরিবারে রাখা, একভাগ আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবদের দেয়া, এক ভাগ গরীব মিসকীনদের মাঝে বন্টন করে দেয়া উত্তম। ঈদের দিন উচ্চস্বরে তকবীর বলতে বলতে ঈদগাহে যাবে, আবার তকবীর বলতে বলতে বাড়ি ফিরে আসবে।তবে মহিলারা নিচু আওয়াজে তকবীর বলবে।এক রাস্তায় যাবে, অন্য রাস্তায় ফিরে আসবে। কোরবানীর জন্তু যবেহ করার পূর্বে ছুরিটা ভাল করে ধারালো করে নিতে হবে। রসুল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: আল্লাহ সকলের উপর ইহসান করা বাধ্যতামূলক করে দিয়েছেন, তোমরা যদি (শরী‘য়াতের দৃষ্টিতে কতল যোগ্য) কাউকে কতল কর অর্থাৎ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর কর, তাহলে, ইহসানের সাথে তা কর (যাতে সহজেই মৃত্যু হয়ে যায়) যদি কোন প্রাণী যবেহ কর, ইহসানের সাথে যবেহ কর (যাতে তার কষ্ট কম হয়) আর যবেহকারী যেন ধারালো অস্ত্র দ্বারা তা করে। (যাতে প্রাণীটা খুব সহজেই যবেহ হয়ে যায়) ( বুখারী, মুসলিম)  নিজের কোরবানীর জন্তু নিজে যবেহ করাটাই বেশী ভাল। নিজে না পারলে কোন অভিজ্ঞ কুরবানীর মাসয়ালা সম্পর্কে জ্ঞাত লোক দিয়ে যবেহ করাবে, তবে নিজে উপস্থিত থেকে তা দেখবে। জিলহজ্জ মাসের ১০,১১,১২ এ তিনদিন সকল মুসলিম আল্লাহর মেহমান, তাই এ তিন দিন রোযা রাখা নিষেধ।

প্রতিটি মুসলিমের উচিত জিলহজ্জ মাসের প্রথম দশদিন বেশী বেশী এবাদত বন্দেগী করা। নয় তারিখ পর্যন্ত দিনে নফল রোযা রাখা, রাত্রিবেলায় নফল এবাদত করা, তাকবীর বেশী বেশী বলা। বিশেষ করে সোম, বৃহস্পতি এবং আরাফার দিনে রোযা রাখা। ১০ তারিখ কোরবানী করার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভে সচেষ্ট হওয়া। তবে মনে রাখতে হবে ফরয, ওয়াজিব ছেড়ে দিয়ে শুধু নফল এবাদতে সুফল পাওয়া যাবে না। আল্লাহ গোটা মুসলিম উম্মাহকে দীনের গুরুত্ব উপলব্ধি করে সে মোতাবেক জীবন গড়ার তৌফীক দিন। আমীন।