পবিত্র মাহে রমজানের ডাক_২০১৯

কর্মীদের উদ্দেশ্যে
বিষয়: রমাদানুল মুবারক ১৪৪০ হিজরী ২০১৯ ঈসায়ী প্রসঙ্গে।    

প্রিয় ভাই ও বোনেরা,
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ।
আশা করি বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহ তা’য়ালার অফুরন্ত মেহেরবানিতে সুস্থ থেকে দ্বীনি দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। বর্ষপরিক্রমায় রহমত, মাগফেরাত ও নাজাতের মাস ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ রামাদানুল মুবারক আবারও আমাদের সামনে উপস্থিত। রমাদান মাসের রোযা মুসলমানদের উপর একটি গুরুত্বপূর্ণ ফরজ ইবাদত। আত্ম সংযম, আত্মশুদ্ধি ও আত্ম উন্নয়নের আল্লাহ প্রদত্ত ধারাবাহিক মুজাহাদার মাস হলো রামাদান মাস। রোজার বিধান প্রত্যেক নবী-রাসূলের উম্মতের উপর বিধিবদ্ধ ছিল। কিন্তু শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা:) এর উম্মতের উপর রোজার বিধানকে পরিপূর্ণরূপ দেয়া হয়েছে এবং মাস ব্যাপী রোযা পালনের এক অতুলনীয় নিয়ম বিধিবদ্ধ করে দেয়া হয়েছে।

ফলে সত্যিকার রোজাদারের উপর এর প্রভাব, এর কল্যাণ এবং সাফল্যও আংশিক নয় বরং পরিপূর্ণ ও সীমাহীন।
মানব সমাজেও রোজার গুরুত্ব অপরিসীম। তাকওয়ার সমাজ, শান্তিময় সমাজ ও সর্বস্তরে জবাবদিহিতার সমাজ বিনির্মাণে রোজার আধ্যাত্মিক ও নৈতিক শক্তি সকল বস্তুগত শক্তিকে হার মানিয়ে দিয়েছে। পবিত্র মাহে রামাদানের মাস ব্যাপী সিয়াম সাধনা মুসলমানদের জন্য এক বিরল সৌভাগ্যের বিষয়। এ সময়ে সকল কল্যাণের দরজা খুলে দেয়া হয় এবং অকল্যাণেরে পথ সমূহ সংকুচিত করে দেয়া হয়। গোটা সৃষ্টিকুলে আল্লাহর আনুগত্যের অনুকূল ভাবধারা ছড়িয়ে দেয়া হয়।

সিয়াম সাধনার মাধ্যমে একজন রোজাদার বান্দা নিজেকে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ধারাবাহিকভাবে সকল প্রকার আহার, যৌন চাহিদা পূরণ, অশ্লীল ও অন্যায় কর্ম থেকে বিরত রেখে নিবিষ্ট চিত্তে আত্ম নিয়ন্ত্রণ ও আত্ম উন্নয়নের ধাপগুলো অতিক্রম করে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভে সক্ষম হন। এ এক অনুপম আধ্যাত্মিক বৈশিষ্ট্য অর্জনের মহা সুযোগ।

রমাদান মানুষকে ধৈর্য ও সহনশীলতার দীক্ষা দেয়, পারস্পরিক অধিকার আদায়, তথা মুয়ামিলাতী জেন্দেগীর কোরআনি লেবাসে ব্যক্তিকে সুসজ্জিত করে। অনাহারে ক্লিষ্টদের প্রতি সহানুভূতি পরায়ণ করে তোলে।
সর্বোপরি দেহ ও আত্মাকে কু-প্রবৃত্তি, স্বার্থান্ধতা ও পাশবিকতা থেকে পরিশুদ্ধ করে উচ্চ মর্যাদায় উপনীত করে দেয় এ রমাদান। সে সাথে এ রমাদানের মাসকে মহিমান্বিত তথা বিশেষ ফজিলতপূর্ণ মাস হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।

কারণ এ মাসেই মহাগ্রন্থ আল-কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে কুফর, শিরক, অন্যায় ও পাপাচার থেকে মুক্ত করে মানুষের হেদায়েত তথা সঠিক দিক নির্দেশনা স্বরূপ। আবার এ মাসেই রয়েছে হাজার মাসের চেয়ে উত্তম একটি অতি মহিমান্বিত রাত বা ‘লাইলাতুল ক্বদর’ । আল্লাহর নৈকট্য লাভের স্পেশাল রজনী, যা রমাদানের শেষ দশ দিনের বিজোড় রাতগুলোতে তালাশ করতে হয়।

ইসলামের বিজয়ের এ মাসে ইসলামের সোনালী অতীতকে স্মরণে এনে পুনরায় আধ্যাত্মিক, নৈতিক, আমলী ও জ্ঞানের শক্তিতে বলিয়ান হয়ে দ্বীন কায়েমের প্রেরণায় উজ্জীবিত হতে হবে আল্লাহ প্রদত্ত তারবিয়াতের মাস এ সিয়ামে রামাদানে।

 
সংগ্রামী ভাই ও বোনেরা
সারা দুনিয়ায় ইসলামী আন্দোলন আজ চরম একটা অগ্নি পরীক্ষার অধ্যায় অতিক্রম করছে। এ মুহূর্তে বাংলাদেশের ইসলামী আন্দোলন এক কঠিন বাঁক অতিক্রম করছে।

এখানে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে ইসলামী শক্তিকে কোণঠাসা করার সকল আয়োজন পূর্ণতায় পৌঁছানোর কাজে দেশী-বিদেশী ইসলাম বিরোধী মহল তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। কিন্তু তাদের সকল আয়োজন ও পরিকল্পনার উপরে আল্লাহরও পরিকল্পনা রয়েছে। মহাগ্রন্থ আল- কোরআন এ বিষয়টি সুস্পষ্ট করে তুলে ধরেছে। আল্লাহ তা’য়ালা বলেছেন:
“বিশ্বে কারো সুদিন আর দুর্দিনের চাবিকাঠি তাঁরই হাতে। তিনিই মানুষের মাঝে এ সুদিন আর দুর্দিনের আবর্তন ঘটিয়ে থাকেন।” (সূরা: ইমরান -১৪০)
তাঁর ঘোষণা - “নিশ্চয়ই দুঃসময়ের সাথেই রয়েছে সুসময়ের আগমন বার্তা, অবশ্যই দুঃসময়ের সাথেই আছে সুসময়ের আগমনের নিশ্চিত সম্ভাবনা।” (সূরা: ইনশিরাহ ৫-৬)
আল্লাহ তা’য়ালা অন্যত্র বলেছেন-
“তোমরা কি মনে করেছো তোমরা এমনিই বেহেশতে চলে যাবে? অথচ আল্লাহ এখনো দেখে নেননি যে, তোমাদের মধ্যে এমন কারা আছে যারা তাঁর পথে জীবন দিতে পারে এবং তাঁরই খাতিরে সবর করতে পারে।” (সূরা: ইমরান ১৪২)

আল্লাহ তা’য়ালা আরও বলেন-
“আল্লাহ মুমিনদেরকে কিছুতেই এমন অবস্থায় থাকতে দেবেন না, যে অবস্থায় তোমরা এখন আছো তিনি (বিপদ-মুসীবত দিয়ে, পরীক্ষার মাধ্যমে) পবিত্র লোকদেরকে নাপাক লোকদের থেকে আলাদা করবেনই।” (সূরা: ইমরান -১৭৯)

আল্লাহ তা’য়ালা আরও বলেন-
“আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব, যাতে তোমাদের অবস্থা যাচাই করে নিতে পারি এবং দেখে নিতে পারি যে তোমাদের মধ্যে কারা আল্লাহর পথের মুজাহিদ ও ধৈর্যশীল।” (সূরা: মুহাম্মদ-৩১)

কাজেই নিছক আল্লাহর সন্তোষ অর্জনকে জীবনের চরম ও পরম চাওয়া পাওয়াই যাদের স্বপ্ন তাদেরকে ভয়-ভীতি হতাশা-নিরাশা স্পর্শ করার প্রশ্নই উঠেনা।

“ইকামতে দ্বীনের জন্য সামনে অগ্রসর হলে যে সব পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হবে তাতে দেখা যাবে, যে সব লোক আল্লাহর সাথে গভীর সম্পর্ক রাখেনা তারা নিজেরাই নিজেদের দুর্বলতার শিকার হয়ে ছিটকে পড়বে, আর যারা বাস্তবিকই আল্লাহর সাথে গভীর সম্পর্ক রাখেন তারা কেবল একটি পরীক্ষাতেই কামিয়াব হবেন না বরঞ্চ প্রতিটি পরীক্ষাই তাদের মধ্যে সৃষ্টি করবে নবতর উদ্দীপনার। এসব পরীক্ষা তাদের অনেক দোষ ত্রুটি নির্মূল করে দেবে। আর এভাবে আগুনে পুড়িয়ে পুড়িয়েই অবশেষে তারা খাঁটি সোনায় পরিণত হবে।” (সাইয়েদ মওদূদী রহ: )
মহান আল্লাহ তা’য়ালা বলেন- “তোমরা মন ভাঙ্গা হয়োনা, চিন্তা করোনা যদি তোমরা মুমিন হও তাহলে তোমরাই বিজয়ী হবে।” (সূরা: ইমরান-১৩৯)

দুশ্চিন্তা, হতাশা ও ভয়-ভীতি এমন এক ব্যাধি যাকে কোন সময়েই প্রশ্রয় দেয়া যাবে না। অতীতের জন্য অথবা বর্তমান কোন অবস্থার জন্য বিমর্ষ বিষণœ হয়ে যাওয়া এটা মানুষের মনকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেয়, আর ‘কালবের’ মধ্যে এ পথেই কালিমা পড়তে শুরু করে এবং ‘কাল্ব’ মরে যায়। আর একবার মন ভাঙ্গা হয়ে গেলে, মন থেকে ইখলাস বিদায় নিলে সে মন দিয়ে স্বতঃস্ফূর্ত কাজ ও কাজের আশাব্যঞ্জক ফলাফল পাওয়া যায় না। তা স্বয়ং দেহের উপরও আঘাত হানে। এ জন্যে আল্লাহর পথের মুজাহিদদেরকে এ থেকে পুত পবিত্র থাকতে হবে। আমাদের জীবন লক্ষ্যের কথা স্মরণে রেখে চলতে হবে। একান্তভাবে তাঁর উপরই ভরসা করতে হবে। সাফল্য আসতে একটু বিলম্ব দেখে অধৈর্য ও অস্থির হওয়া যাবেনা। যা হয়ে গিয়েছে (ত্রুটি-বিচ্যুতি) তার জন্যে দুঃখ ও শোক প্রকাশে সময় ও শক্তি নষ্ট না করে ভুল ত্রুটির জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা চেয়ে, মন-মেজাজ ঠিক রেখে দৃঢ়তার সাথে উচ্চস্তরের নৈতিক গুণাবলী অর্জনের সাধনায় নিয়োজিত থেকে পূর্ণ সতর্কতা সহকারে মানুষের পারিবারিক, সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের ধ্বস ঠেকাতে তথা ভবিষ্যৎ সংশোধনের চিন্তা ও সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ করে সকলকে নিয়ে ব্যাপকভাবে কাজে আত্মনিয়োগ করতে হবে।

ইসলামের সুমহান আদর্শকে মজবুতভাবে আকড়ে ধরে ধৈর্য ও সহনশীলতার সাথে এগিয়ে যেতে হবে, এ পথই সাফল্যের পথ, বিজয়ের পথ, মহান জান্নাতের পথ। গভীরভাবে অনুধাবন করলে দেখা যায় মাহে রমাদান আমাদের জন্য প্রকৃত অর্থে সে দীক্ষারই বার্তা নিয়ে এসেছে।


নিম্নের এ মহিমান্বিত মাসে দুটি গুরুত্বপূর্ণ দিকের করণীয় সম্পর্কে সকলকে নিষ্ঠাপূর্ণ প্রচেষ্টায় আত্মনিয়োগ করার আহ্বান জানাচ্ছি।

ক) অধ্যয়ন মূলক: 

১. আল-কোরআন - তাফহীমূল কোরআন ১৯ খ- অধ্যয়ন
- যাদের পক্ষে সম্ভব পুরো কোরআন অন্ততঃ একবার অর্থসহ তেলাওয়াত করা।
- বাকারা ঃ ১৮৩-১৮৫ নং আয়াত।
২. আল-হাদীস - তাহারাত, সালাত, সিয়াম ও চরিত্র গঠন সংক্রান্ত অধ্যায়।
৩. সাহিত্য - নামাজ-রোজার হাকীকত, যাকাতের হাকিকত, হেদায়াত, ইসলামী আন্দোলনঃ সাফল্যের শর্তাবলী, কুরআন রমযান তাকওয়া, ইনফাক-ফি-সাবিলিল্লাহ।
৪. তা’লিমুল কুরআন - সহীহ তেলাওয়াত শিক্ষার ব্যবস্থাকে ব্যাপক রূপ দেয়ার চেষ্টা করা।
৫. মৌলিক বিষয়ে বাছাই করা আয়াত ও হাদীস মুখস্ত করা।

খ) অনুশীলনী মূলক:

১. পরিবার পরিজন, পাড়া-প্রতিবেশীকে নিয়ে ভাবগম্ভীর পরিবেশে যথাযথভাবে রোজা পালন করা।
২. জামায়াতের সাথে ফরজ সালাত ও তারাবীহ আদায় করা।
৩. কিয়ামুল লাইল বা সালাতুত তাহাজ্জুদ আদায় ও তিলাওয়াতে কুরআনের দুর্লভ সুযোগ কাজে লাগানো।
৪. আল্লাহর গজব থেকে রক্ষা ও তাঁর সাহায্য লাভে কাতর কন্ঠে দোয়া করা।
৫. নেতৃবৃন্দসহ সকল মজলুম মানুষের মুক্তির জন্য এ সময়ে বেশী বেশী আল্লাহর দরবারে র্ধণা দেয়া ।
৬. সদস্য (রুকন), কর্মী, সহযোগী বৃদ্ধির কাজ এ মাসে অন্য মাসের তুলনায় ব্যক্তিকে অধিক সাওয়াবের অধিকারী করবে, তাই জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার উপায় হিসেবে এ ক্ষেত্রের দায়িত্ব পালনে যত্নশীল হওয়া।
৭. পারিবারিকভাবে পাড়া প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে ইফতারীর আয়োজন করা।
৮. সাংগঠনিকভাবে ইফতার মাহফিলের আয়োজন করা।
৯. বেশী বেশী দান-সাদাকাহ করা। এ ক্ষেত্রে মজলুম ভাই বোন ও পরিবারের প্রতি খেয়াল রাখা।
১০. হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি, জিঘাংসা ও নৈরাজ্যের বিষ ছড়ানোর মোকাবিলায় ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব, সম্প্রীতি ও সৌহার্দের স্বর্গীয় আবহ তৈরীতে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করা।
সম্মানিত ভাই ও বোনেরা,
আপনারা নিশ্চয়ই ভাল করে জানেন যে, যাকাত ইসলামের অর্থনৈতিক ইবাদত এবং তা আল্লাহ নির্ধারিত ফরজ ইবাদত। রামাদান মাসেই সাধারণত: সাহেবে নিছাব ভাই/বোনেরা যাকাত দিয়ে থাকেন। যাকাতের ৮টি খাতেই জামায়াত যাকাতের অর্থ ব্যয় করে থাকে। জামায়াতের তৃতীয় দফার কাজকে গতিশীল ও জোরদার করার লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় ও জেলা/মহানগরী পর্যায়ে একটি ফান্ড গঠন করা আছে। অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে এ ফান্ডে যারা যাকাত দিতে ইচ্ছুক তাদের সাথে আগে থেকেই যোগাযোগ করার সক্রিয় উদ্যোগ নিতে হবে।

সাহেবে নিছাব সদস্যগণ (রুকনগণ) তাঁদের ব্যক্তিগত যাকাতের ৫০% ভাগ সংশ্লিষ্ট জেলা/মহানগরী সংগঠনের যাকাত ফা-ে জমা দেবেন। সংগৃহীত যাকাতের সমূদয় অর্থ স্থানীয়ভাবে গরীব ও বঞ্চিত মানুষের কল্যাণে ও তাদের পুনর্বাসনে পরিকল্পিতভাবে ব্যয় করতে হবে।

আত্মগঠন তথা সবর ও ইস্তিকামাতের নিয়তে চরিত্র গঠনের সাধনায় মানোন্নয়নের অবলম্বন হিসেবে রামাদানকে যথাযথ গুরুত্ব সহকারে পালনের জন্য এখন থেকে শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতি নিতে হবে। সিয়ামের প্রথম দিন থেকেই সার্র্কুলারে বর্ণিত পরামর্শ গুলো সাধ্যানুযায়ী বাস্তবায়নে আত্মনিয়োগ করার একান্ত অনুরোধ করছি।

আল্লাহ আমাদেরকে ঈমান নিঃস্মৃত সকল গুণাবলী অর্জনের তৌফিক দান করুন। আমীন।

আল্লাহ হাফেজ।