৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, রবিবার, ১০:৫১

সাবেক তিন সিইসির অভিমত: ইসির চেয়েও নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিরপেক্ষ করা গুরুত্বপূর্ণ

নতুন নির্বাচন কমিশনে কারা আসছেন তা জানতে সবার নজর যখন সার্চ কমিটির দিকে তখন সাংবিধানিক এই সংস্থার সাবেক সদস্যরা কী ভাবছেন?
কাজী রকীব উদ্দিন আহমদ নেতৃত্বাধীন বর্তমান কমিশনের মেয়াদ পূর্ণ হচ্ছে ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে। এ কমিশনের আগে আরো ১০ জন প্রধান নির্বাচন কমিশনার দায়িত্ব পালন করে গেছেন, যাদের নেতৃত্বে স্বাধীনতার পর চার দশকে নির্বাচনী গণতন্ত্রের পথে নানা চড়াই-উতরাই পার হয়ে এসেছে বাংলাদেশ।
নির্বাচন কমিশনের সেবা ও হিসাব শাখার তথ্য অনুযায়ী, বিগত নির্বাচন কমিশনগুলোর অন্তত ১২ জন সদস্য এখনো বেঁচে আছেন, যাদের মধ্যে চারজন ছিলেন সিইসি, বাকিরা কমিশনার ছিলেন।
ঢাকায় ইসি সচিবালয়ে এক নাগাড়ে ৩০ বছরের বেশি সময় কাজ করে অবসরে গেছেনÑ এমন অন্তত চারজন কর্মকর্তা এখনো জীবিত।
সুষ্ঠু ভোট আয়োজনের চেষ্টায় বিগত দিনের অভিজ্ঞতা, বাংলাদেশের নির্বাচনী সংস্কৃতির সীমাবদ্ধতা এবং পরবর্তী কমিশন গঠন নিয়ে তিন সাবেক সিইসিসহ কয়েকজন সাবেক কমিশনার ও ইসি কর্মকর্তার ভাবনা জানার চেষ্টা করেছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করা বিচারপতি আব্দুর রউফ, সাবেক আমলা মোহাম্মদ আবু হেনা ও এটিএম শামসুল হুদা বলেছেন, সুষ্ঠু নির্বাচন করতে দক্ষ নির্বাচন কমিশন যেমন দরকার, তেমনি রাজনৈতিক দল ও সরকারের সহযোগিতা এবং প্রার্থী ও ভোটারদের সহিষ্ণুতা জরুরি।
নির্দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন করে প্রশংসিত হলেও দলীয় সরকারের সময়ে বিভিন্ন নির্বাচন করতে চাপে পড়তে হওয়ার কথা জানিয়েছেন তারা।
সাবেক এই তিন সিইসির মধ্যে একজন বলেছেন, কারা ইসিতে নিয়োগ পেলেন, তার চেয়েও বড় বিষয় হলো নির্বাচন প্রক্রিয়া নিরপেক্ষ করা।
নিরপেক্ষতার তত্ত্ব তালাশ : এইচ এম এরশাদের সামরিক শাসনের অবসানের পর বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে পঞ্চম সংসদ নির্বাচন হয়েছিল বিচারপতি আব্দুর রউফের কমিশনের আয়োজনে।
সংসদীয় গণতন্ত্রে ফেরার ওই নির্বাচন করে বিচারপতি রউফ প্রশংসা পেয়েছিলেন, কিন্তু বিএনপি সরকারের সময়ে ১৯৯৪ সালে মাগুরা-২ উপনির্বাচনের কারণে তাকে হতে হয়েছিল সমালোচিত।
সাবেক এই সিইসি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনে কে এলো তাতে কিছু আসবে যাবে না যদি ভোটাররা তার অধিকার প্রয়োগ করতে না পারে।’
কেউ যদি ইসিকে হাতের মুঠোয় রাখতে চায় বা ভোটের মালিকানা ভোটারের হাতে রাখতে না চায়, তাহলে কমিশন দিয়ে কিছুই হবে না বলে তার বিশ্বাস।
বিচারপতি রউফ বলেন, সিইসি ও নির্বাচন কমিশনাররাও নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেন; সে অধিকার তাদের আছে। সুতরাং কেবল নিরপেক্ষ ইসি খোঁজার চেষ্টায় তেমন কোনো লাভ আসবে না।
নির্বাচন কমিশনে এবিসিডি যেই থাকুক, ব্যক্তি হিসেবে তিনি কতটা নিরপেক্ষ তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নির্বাচনী প্রক্রিয়াটা কতটা নিরপেক্ষ করা গেছে। ভোটের প্রক্রিয়া নিরপেক্ষ হলে ভোটাররা সুফল পাবে।
বিচারপতি রউফের কমিশন নির্বাচনী বিধিবিধানের সংস্কারের পাশাপাশি ভোটার হিসেবে প্রত্যেক ব্যক্তির নিবন্ধন প্রক্রিয়া শুরুর চেষ্টা করেছিলেন। ভোট কক্ষ বাড়িয়ে সময় কমিয়ে আনার পরীক্ষামূলক কাজও সে সময় হয়েছিল।
নিজের সময়ের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, সার্বিকভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর সহায়তা কমিশনের দরকার। সেই সাথে সরকারের প্রশাসন যন্ত্রের সহায়তাও থাকতে হবে। তা না হলে ভোট প্রক্রিয়া আরো খারাপ হবে।
মেয়াদ শেষ করার আগেই বিদায় নেয়া এই সিইসি বলেন, ‘আমি তো ইসি থেকে বেতন নিইনি। আমার বিষয়টা অন্য রকম ছিল। পরে আমি আবার আদালতে ফিরে যাই স্বেচ্ছায়।’
বর্তমানে শারীরিকভাবে ভালো আছেন বলে জানালেন বিচারপতি রউফ। ৮২ বছর বয়সেও নানা ধরনের সামাজিক সংগঠনের কাজে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন তিনি।
প্রথম আমলা হিসেবে নির্বাচন কমিশনের প্রধান হওয়া মোহাম্মদ আবু হেনাও সুস্থ আছেন। বর্তমানে তার বয়স ৮০ বছর। তবে এখন আর নির্বাচন কমিশন নিয়ে খুব বেশি কথা বলার আগ্রহ হয় না বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানালেন।
১৯৯৬ সালে আবু হেনাকে প্রধান নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব দেন দেশের প্রথম সাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি মো: হাবিবুর রহমান।
নির্দলীয় সরকারের অধীনে ভোট আয়োজনের তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি সংবিধানে যুক্ত হওয়ার পর আবু হেনার কমিশন সপ্তম সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করে।
সেই নির্বাচনের জন্য প্রশংসিত আবু হেনা সিইসির দায়িত্বে ছিলেন প্রায় চার বছর। তাকেও দলীয় সরকারের সময়ে ১৯৯৯ সালের টাঙ্গাইল উপনির্বাচন নিয়ে চাপের মুখে পড়তে হয়েছিল।
সাবেক এই সিইসি সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, ইসি গঠন প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হতে হবে, যোগ্যদের নিয়ে কমিশন গঠন হলে তারা দায়িত্বটি সঠিকভাবে পালন করতে পারবেন। যোগ্যদের খুঁজে বের করতে সার্চ কমিটির বিকল্প নেই।
সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে ইসির দক্ষতার পাশাপাশি প্রার্থী, ভোটার, সরকার ও সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতার ওপর জোর দিয়েছেন তিনি।
বিচারপতি রউফ ও আবু হেনা দু’জনেই বলেছেন, ভালো নির্বাচন হলেও পরাজিত পক্ষ কারচুপিসহ নানা অভিযোগ করেÑ এটা রাজনৈতিক সংস্কৃতিরই অংশ হয়ে উঠেছে। তবে নির্বাচন সুষ্ঠু হলে শেষ বিচারে তা আর বিতর্কিত করা যায় না।
সর্বশেষ ফখরুদ্দীন আহমদ নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার তিন মাসের জায়গায় দায়িত্বে ছিল দুই বছর। সেনা শাসনে না হলেও দেশ তখন চলেছে কার্যত সেনা নিয়ন্ত্রণে। ওই সময় প্রধান নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পান সাবেক আমলা এ টি এম শামসুল হুদা। তার কমিশনই নবম সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করে।
সম্প্রতি রাপ্রপতির সাথে সংলাপে ইসি গঠনে আইন করার যে দাবি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্য থেকে এসেছে, তাকে ‘একধাপ অগ্রগতি’ বলে মনে করেন সাবেক এ সিইসি। তার সময়ে ওই আইনের একটি খসড়া সরকারের কাছে পাঠানো হলেও পরে আর তা সাড়া পায়নি।
শামসুল হুদা বলেন, ‘ইসি পুনর্গঠনে রাজনৈতিক মতৈক্য জরুরি। নির্বাচন শুধু নির্বাচন কমিশনের একার বিষয় নয়। যোগ্য ব্যক্তি নিয়োগের জন্য সবার মতামত নেয়ার প্রক্রিয়া যত বেশি স্পষ্ট হবে ততই ভালো। এখন অনেকে আইন প্রণয়নের কথা বলছে, এটা একধাপ অগ্রগতি। তা হওয়ার পর এ নিয়ে কথা বলা যাবে।’
সাবেক এ আমলার মতে, ইসির হাতে এখন যথেষ্ট ক্ষমতা রয়েছে। যোগ্য ও নিরপেক্ষ লোক নিয়োগ পেলে এই ক্ষমতা কাঠামোতেই নিরপেক্ষ নির্বাচন করা সম্ভব।
বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্র পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের কারণেই অকার্যকর হয়েছে মন্তব্য করে ৭৪ বছর বয়সী শামসুল হুদা সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘যে পার্টি ক্ষমতায় এসেছে, সেটা সামরিক সরকারই হোক, আর গণতান্ত্রিক সরকার হোক, বিজয়ীরা সব নিয়ে যায়।’
জীবিত সাবেক সিইসিদের মধ্যে বিচারপতি এম এ আজিজের বয়স এখন ৭৮ বছর। ২০০৭ সালে স্বেচ্ছায় পদত্যাগের পর থেকে গণমাধ্যমের সামনে আসেননি। রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের সময়ে সিইসি হিসেবে নিয়োগ পাওয়া আজিজ তার ২০ মাসের মেয়াদে কোনো জাতীয় নির্বাচন করে যেতে পারেননি।
http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/193264