৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, রবিবার, ১০:৪৭

অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জর্জরিত আ.লীগে বাড়ছে হানাহানি

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য দলকে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত প্রস্তুত করার ঘোষণা দিয়েছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু এরই মধ্যে বিভিন্ন এলাকায় দলটিতে অভ্যন্তরীণ কোন্দল, সংঘাত ও হানাহানি বেড়ে চলেছে। এতে গত বছর নিহত হয়েছেন ৮৩ জন নেতা-কর্মী, যা আগের দুই বছরের চেয়েও বেশি। আর চলতি বছরে গত এক মাসে নিহত হন চারজন, যার মধ্যে তিনজন দলের নেতা-কর্মী। আরেকজন হলেন সাংবাদিক।
আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র বলছে, জেলা পরিষদ, উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের সময় বিভিন্ন স্থানে দলের ভেতর বিরোধ তৈরি হয়েছে, যার জের এখনো রয়ে গেছে। তা ছাড়া এলাকায় প্রভাব বিস্তার ও বৈষয়িক স্বার্থসংশ্লিষ্ট কারণেও বিরোধ বা সংঘর্ষ হচ্ছে। কিন্তু এসব কমাতে যতটা কঠোর হওয়ার কথা, দল ততটা হতে পারছে না। কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে হানাহানির ঘটনায় চূড়ান্ত সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার নজির কম। কোনো ঘটনায় স্থানীয়ভাবে তাৎক্ষণিক সাময়িক বহিষ্কার করা হলেও পরে তা চূড়ান্ত করার দীর্ঘ প্রক্রিয়া বাস্তবায়িত হয় না বললেই চলে।
গত বছরের অক্টোবরে জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয়। সম্মেলনের আগে সারা দেশের তৃণমূল থেকে বহিষ্কৃত নেতাদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়। ফলে দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গ, সংঘাত, দখলবাজিসহ নানা অপরাধে অভিযুক্ত অনেক নেতা পার পেয়ে যান বলে দলীয় সূত্র জানায়। সহযোগী সংগঠন যুবলীগ ও ছাত্রলীগেও লোক দেখানো বহিষ্কারের ঘটনা দেখা যায়। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কয়েক দিন পর বহিষ্কৃত ব্যক্তিরা আগের অবস্থায় ফিরে আসেন।
২০১৫ সালের ডিসেম্বরের পৌরসভা নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে গিয়ে অন্য প্রার্থীর পক্ষে কাজ করার দায়ে খাগড়াছড়ি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহেদুল আলমকে সাময়িক বহিষ্কার করে দল। ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক করা হয় নির্মলেন্দু চৌধুরীকে। সাধারণ ক্ষমার আওতায় জাহেদুল দলে ফিরে আসেন। এরপর নির্মলেন্দু ও জাহেদুল দুজনই সাধারণ সম্পাদক হিসেবে কার্যক্রম চালাতে থাকেন। এরপর গত ১৭ জানুয়ারি নির্মলেন্দুকে পিটিয়ে হাসপাতালে পাঠায় জাহেদুলের লোকজন। এ ঘটনায় মামলা হয় জাহিদুলসহ অন্যদের বিরুদ্ধে। এরপর জাহেদুল আলমকে কারণ দর্শানোর চিঠি দেয় কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ।
আওয়ামী লীগের একজন দায়িত্বশীল নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, মারামারি বা অপরাধ করে রাজনৈতিক দলে কারও পদ গেছে, এর নজির কম। পদ যায় রাজনৈতিক কারণে।
ওই নেতা বলেন, আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, কাদের সিদ্দিকী ও মোস্তফা মহসীন মন্টুর মতো বড় অনেক নেতাকে দল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। সেটা হয়েছে রাজনৈতিক কারণে। আর দলীয় নেতাকে হত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত এবং কারাবন্দী টাঙ্গাইলের সাংসদ আমানুর রহমানকে জেলা আওয়ামী লীগ সাময়িক বহিষ্কার করেছে। তবে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ তাঁর বিরুদ্ধে কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠানো বা তদন্তের পথে হাঁটছে না; বরং মামলার চূড়ান্ত রায় হওয়ার আগে কোনো সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
গত বুধবার চাঁদপুরের হাইমচরে ছাত্রদের পিঠের ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার ঘটনা সারা দেশে আলোচিত হওয়ার পর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নূর হোসেন পাটোয়ারীকে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ কারণ দর্শানোর চিঠি দিয়েছে। গত বৃহস্পতিবার সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ সমকাল-এর শাহজাদপুর প্রতিনিধি আবদুল হাকিম নিহত হওয়ার ঘটনায় দলের রাজশাহী বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক ও সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরীকে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র অনুসারে, কোনো সদস্য আওয়ামী লীগের আদর্শ, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, গঠনতন্ত্র ও নিয়মাবলি বা প্রতিষ্ঠানের স্বার্থের পরিপন্থী কার্যকলাপে অংশগ্রহণ করলে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে দলের কার্যনির্বাহী সংসদ যেকোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে। এতে আরও বলা হয়েছে, কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা কেবল আওয়ামী লীগ কার্যনির্বাহী সংসদের। তাই স্থানীয় পর্যায়ে কোনো ব্যবস্থা নিলেও কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের অনুমোদন ছাড়া তা কার্যকর হয় না।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচনের কারণে কিছু মারামারি হয়েছে। তবে সামনে কমে আসবে।
মারামারির ঘটনায় দল ব্যবস্থা নেয়—এমন অভিযোগ সম্পর্কে কাজী জাফর উল্লাহ বলেন, ‘ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব পুলিশের। তারা সেটা করে। দলের লোক মারামারি করেছে, এটা পত্রপত্রিকা বলে। কিন্তু নিজেরা খুঁজতে গেলে পাওয়া যায় না। তাহলে কীভাবে ব্যবস্থা নেব?’
তবে আওয়ামী লীগের অপর একজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, দল কঠোর নয় বলে ক্ষমতাসীন নেতারা অপরাধ করলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে চুপচাপ থাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কোনো ঘটনা জাতীয়ভাবে আলোচিত হলেই কেবল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আইনি পদক্ষেপ নেয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের উপদপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া প্রথম আলোকে বলেন, সাংগঠনিক ব্যবস্থা একটা চলমান প্রক্রিয়া। দলের বিভিন্ন পর্যায়ে সেগুলো প্রয়োগ করা হচ্ছে। আগামী নির্বাচন সামনে রেখে দলের মধ্যে শৃঙ্খলা আনার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চলছে।
আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ মূল্যায়ন ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য বলছে, ২০১৬ সাল ছিল আওয়ামী লীগের জন্য বেশ ভ্রাতৃঘাতী। এর মূল কারণ ছিল স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন স্তরের নির্বাচন। গত বছর জুনে নির্বাচন শেষ হওয়ার পর প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা যায়, ছয় ধাপের ইউপি নির্বাচনে সারা দেশে সহিংসতায় নিহত হন ১১৬ জন। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের সমর্থক ৭১ জন, যাঁরা নিজেদের মধ্যে সংঘাতে প্রাণ হারান।
বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৬ সালে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ সংঘাতে নিহত হন ৮৩ জন। ২০১৫ সালে এ সংখ্যা ছিল ৩৩। তার আগের বছর নিহত হন ৩৪ জন।
জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ক্ষমতায় থাকলে দল বড় হতে থাকে। ক্ষমতার মোহে দল যত বড় হবে, হানাহানি তত বাড়বে, এটাই স্বাভাবিক। তার ওপর ক্ষমতাসীন দলের অংশ হলে আইনি প্রক্রিয়া ঠিকভাবে চলে না। দল থেকে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে—এমন নজিরও খুব একটা পাওয়া যায় না। মাঠে যেহেতু অন্য কেউ নেই, তাই নিজেদের মধ্যেই একে অপরকে লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘সরকারি দল হলে সাত খুন মাফ, এটা তো কথার কথা নয়। বাস্তবেও ঘটছে।’
http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1074501/%E0%A6%85%E0%A6%AD%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%B0%E0%A7%80%E0%A6%A3-%E0%A6%95%E0%A7%87%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A6%E0%A6%B2%E0%A7%87-%E0%A6%9C%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%9C%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A6%A4-%E0%A6%86.%E0%A6%B2%E0%A7%80%E0%A6%97%E0%A7%87-%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A7%9C%E0%A6%9B%E0%A7%87-%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%B9