৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, সোমবার, ১০:৪২

লবণাক্ততা বদলে দিচ্ছে সুন্দরবনের বৈশিষ্ট্য

পৃথিবীর একমাত্র মিষ্টি পানির ও সবচেয়ে বড় বাদাবন (ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট) সুন্দরবন তার বৈশিষ্ট্য হারাচ্ছে। বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে চিহ্নিত এই বন লবণ পানির আগ্রাসনের মুখে পড়েছে। এর ফলে বনটির মিষ্টি পানিনির্ভর বৃক্ষ ও মাছ কমে যাচ্ছে। সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীগুলোর উৎসস্থল বা উজান থেকে পানি প্রত্যাহার এবং লবণ পানির চিংড়ি চাষ এর মূল কারণ। এর সঙ্গে নতুন বিপদ হিসেবে যোগ হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন।
এই পরিস্থিতি থেকে সুন্দরবনকে বাঁচাতে কী করা যায়, তা বের করতে গত শুক্র ও শনিবার ভারতের কলকাতা শহরে হয়ে গেল এক কর্মশালা। এতে বিজ্ঞান ও গবেষণালব্ধ তথ্য-উপাত্ত নিয়ে হাজির হয়েছিলেন বাংলাদেশ ও ভারতের গবেষক ও নীতিনির্ধারকেরা। সাংবাদিক ও পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিরাও তাঁদের মতামত তুলে ধরেন।
কলকাতার রামকৃষ্ণ মিশন মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত কর্মশালার আয়োজন করে বিশ্বব্যাংক। সহযোগিতায় ছিল বাংলাদেশ ও ভারতের আটটি প্রতিষ্ঠান। কর্মশালায় মোট ১৭টি গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হয়।
‘পরিবর্তিত জলবায়ুতে সুন্দরবনের ঝুঁকি’ শীর্ষক ওই কর্মশালার শুরুতে বিশ্বব্যাংকের পরিবেশ অর্থনীতি বিভাগের প্রধান সুস্মিতা দাসগুপ্তা সুন্দরবন অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে করা একটি গবেষণার ফলাফল তুলে ধরেন। ২০১২ সালের তুলনায় ২০৫০ সালে সুন্দরবনসহ বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা ও মিষ্টি পানির পরিমাণ কমার সম্ভাব্য চিত্র তুলে ধরেন তিনি।
সুস্মিতা দেখান, বর্তমানে বাংলাদেশের উপকূলে ৪১ শতাংশ এলাকায় মিষ্টি পানি রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ২০৫০ সাল নাগাদ তা কমে ১৭ শতাংশে নেমে আসতে পারে।
সুন্দরবনের মৎস্য সম্পদের ওপর মিষ্টি পানি কমে যাওয়ার প্রভাব নিয়ে ওয়ার্ল্ড ফিশ পরিচালিত একটি গবেষণা তুলে ধরেন সংস্থাটির গবেষক গোলাম মোস্তফা। তিনি দেখান, লবণাক্ততা সামান্য বাড়লে পারশে, দাতিনা, টেংরা, ভেটকি ও পোয়া মাছের প্রাপ্যতা কমে আসে। ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে জেলেদের আয় ও জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
সুন্দরবনের আশপাশের এলাকার লবণাক্ততার ধরন ও কৃষিতে এর প্রভাব নিয়ে অধ্যাপক আইনুন নিশাত, সুস্মিতা দাসগুপ্তা ও ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিংয়ের পরিচালক জহিরুল হক খানের করা একটি গবেষণা তুলে ধরা হয়।
গবেষণার ফলাফল তুলে ধরতে গিয়ে জহিরুল হক খান বলেন, সুন্দরবন অঞ্চলে যে হারে লবণাক্ততা বাড়ছে, তাতে ২০৫০ সাল নাগাদ এখানকার বরগুনা, ভোলা, ঝালকাঠি, খুলনা, পটুয়াখালী জেলা এবং ভোলা সেচ প্রকল্পের বেশির ভাগ নদীর পানি আর কৃষিতে সেচ দেওয়ার উপযোগী থাকবে না।
বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ইশতিয়াক সোমহান দেখান, লবণাক্ততা বেড়ে গিয়ে সুন্দরবনের মিষ্টি পানিনির্ভর সুন্দরী গাছের সংখ্যা ধারাবাহিকভাবে কমে আসছে। আর গেওয়া, কেওড়া ও গরানের মতো লবণাক্ততানির্ভর বৃক্ষের সংখ্যা বাড়ছে। ফলে সুন্দরবন তার পুরোনো বৈশিষ্ট্য হারাচ্ছে।
বাংলাদেশ মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন কেন্দ্রের (এসআরডিআই) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মকবুল হোসেন বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে ফারাক্কাসহ উজানের নদীগুলোতে বাঁধ দেওয়াকে দায়ী করেন। একই সঙ্গে উপকূলীয় বেড়িবাঁধ কেটে মিষ্টি পানির এলাকায় লবণ পানি প্রবেশ করিয়ে চিংড়ি চাষকে দায়ী করেন।
কর্মশালার প্রশ্নোত্তর পর্বে পরিবেশবিষয়ক আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা থার্ড পোলের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের প্রধান জয়দেব গুপ্তা বাংলাদেশ ও ভারতের নৌ প্রটোকলের আওতায় সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে জাহাজ চলাচলের বিষয়টির দিকে আয়োজকদের মনোযোগ আকর্ষণ করেন। তিনি বলেন, গত দুই বছরে ওই নৌপথ দিয়ে আসা চারটি জাহাজ বাংলাদেশের সুন্দরবনের ভেতরে ডুবেছে। সার, কয়লা, তেলবাহী জাহাজডুবির ফলে যে সুন্দরবনের ক্ষতি হচ্ছে, তা-ও আমলে নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
কর্মশালায় বিভিন্ন বক্তব্যের সারবস্তু তুলে ধরেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত। তিনি বলেন, ভারত ও বাংলদেশের সুন্দরবনের মধ্যে কিছু মৌলিক পার্থক্য আছে এবং তা সবাইকে মাথায় রেখে পরিকল্পনা করতে হবে। তিনি বলেন, ভারতের সুন্দরবনের ভেতরে ৭৫ লাখ মানুষ থাকে আর বাংলাদেশ অংশে কোনো জনবসতি নেই। ফলে বাংলাদেশ ও ভারতের সুন্দরবন রক্ষার বিষয়ে আলাদা পরিকল্পনা করতে হবে।
কর্মশালায় আরও বক্তব্য দেন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের মৎস্য মন্ত্রণালয়ের সচিব প্রভাত কুমার মিশ্র, প্রধান বন সংরক্ষক দেবাল রায় ও বিশ্বব্যাংকের পরিবেশ বিভাগের প্রধান ড. লিয়া কেরল সিগার্ড।
http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1075371/%E0%A6%B2%E0%A6%AC%E0%A6%A3%E0%A6%BE%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%A4%E0%A6%BE-%E0%A6%AC%E0%A6%A6%E0%A6%B2%E0%A7%87-%E0%A6%A6%E0%A6%BF%E0%A6%9A%E0%A7%8D%E0%A6%9B%E0%A7%87-%E0%A6%B8%E0%A7%81%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A6%E0%A6%B0%E0%A6%AC%E0%A6%A8%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%AC%E0%A7%88%E0%A6%B6%E0%A6%BF%E0%A6%B7