৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, বুধবার, ১০:০১

নির্বাচন কমিশন গঠনে ছোট দলের বড় গুরুত্ব

অনুসন্ধান কমিটির দশজনের তালিকা এবং এই তালিকা থেকে নেওয়া পাঁচজনের বেশির ভাগ নাম এসেছে ছোট দলের প্রস্তাব থেকে। নবগঠিত নির্বাচন কমিশনের (ইসি) পাঁচ সদস্যের চারজনেরই নাম দিয়েছিল বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশন ও গণতন্ত্রী পার্টি।
অনুসন্ধানে পাওয়া যায়, নতুন নির্বাচন কমিশনের পাঁচ সদস্যের মধ্যে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি থেকে একটি করে নাম নেওয়া হয়েছে। আর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটের শরিক তরীকত ফেডারেশনের পাঁচজনের তালিকা থেকে তিনজন এবং গণতন্ত্রী পার্টির পাঁচজনের তালিকা থেকে দুজনকে নেওয়া হয়েছে। একই নাম বিভিন্ন দলের তালিকায় স্থান পেয়েছে।
অনুসন্ধান কমিটির ১০ জনের তালিকায় নাগরিক সমাজের তিন প্রতিনিধির নাম থাকলেও তাঁদের কাউকেই নেওয়া হয়নি। এ নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন কমিটির একাধিক সদস্য। জানতে চাইলে অনুসন্ধান কমিটিতে থাকা নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘প্রস্তাবিত ১০ জনের মধ্যে যে কাউকে রাখতে পারেন রাষ্ট্রপতি। কিন্তু নাগরিক সমাজের কাউকে না রাখায় অবাক হয়েছি।’
নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদার নাম বিএনপি বা আওয়ামী লীগের তালিকায় ছিল না। কিন্তু গণতন্ত্রী পার্টিসহ কয়েকটি ছোট দলের তালিকায় নামটি ছিল। এ ছাড়া দুই কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম ও শাহাদৎ হোসেন চৌধুরীর নাম ছিল তরীকত ফেডারেশনের তালিকায়।
পাঁচজনের মধ্যে তিনটি নাম টিকে যাওয়া প্রসঙ্গে তরীকত ফেডারেশনের মহাসচিব ও লক্ষ্মীপুর-১ আসনের সাংসদ এম এ আউয়াল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা আধ্যাত্মিক মানুষ। এ জন্য আমাদের দেওয়া নাম হয়তো বেশি টিকেছে।’
গণতন্ত্রী পার্টির দেওয়া পাঁচটি নামের মধ্যে টিকেছে দুটি। একজন হলেন অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ কবিতা খানম এবং অপরজন শাহাদৎ হোসেন চৌধুরী। অবশ্য তাঁদের নাম অন্য দলের তালিকায়ও ছিল।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে গণতন্ত্রী পার্টির সাধারণ সম্পাদক শাহাদাত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা দলের পক্ষ থেকে নাম প্রকাশ করিনি, এখনো করতে চাই না।’ তবে দলের তালিকা থেকে দুজন কমিশনার নিয়োগ পাওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তাঁরা দলনিরপেক্ষ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মানুষ। আশা করি, দেশ ও জাতির জন্য এই কমিশন মঙ্গলজনক ভূমিকা রাখবে।’
অভিযোগ উঠেছে, জোটভুক্ত ছোট দলের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ নির্বাচন কমিশন গঠনে তাদের উদ্দেশ্য পূরণ করেছে। এ প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচন কমিশন গঠনের এই পুরো প্রক্রিয়া লোক দেখানো ছিল কি না, সেই প্রশ্ন তোলার বেশ কিছু কারণ রয়েছে। তা ছাড়া যেভাবে দ্রুততার সঙ্গে সবকিছু হয়ে গেল, সেটিও স্বাভাবিক ছিল না।
জানতে চাইলে ১৪ দলের মুখপাত্র ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, কোনো দলের দেওয়া নাম বিবেচনা করে নয়, সম্পূর্ণ দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা দেখে তাঁদের নেওয়া হয়েছে। তাঁদের অনেকের নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা ছিল। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অন্য দলের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ কেন লক্ষ্য পূরণ করতে যাবে? এমন অভিযোগ হাস্যকর। এর ন্যূনতম ভিত্তি নেই।
নাগরিক সমাজের তিনজনই বাদ
পাঁচ সদস্যের নির্বাচন কমিশনে বিশিষ্ট নাগরিকদের কাউকে নেওয়া হয়নি। এ নিয়ে অনুসন্ধান কমিটির সদস্যদের কেউ কেউ বিব্রত হয়েছেন। তাঁদের প্রস্তাবিত দশজনের মধ্যে তিনজনের নাম দেওয়া হয়েছিল নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে।
ওই তিনজন হলেন স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক জেরিনা রহমান খান এবং বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের সহ-উপাচার্য ও নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা জানিপপের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ। তাঁদের কাউকে নেওয়া হয়নি। নিয়োগপ্রাপ্ত পাঁচজনের তালিকায় তিনজনই সাবেক আমলা, একজন সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও অপরজন অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ।
অনুসন্ধান কমিটি যে দশজনের নাম প্রস্তাব করেছিল, তাঁদের মধ্যে সাবেক সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন পাঁচজন, তিনজন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, একজন সেনা কর্মকর্তা এবং একজন অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মনজুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘নাগরিক সমাজের অন্তর্ভুক্তি চেয়েছিলাম। কারণ, তাঁদের জ্ঞান নির্বাচনের সুষ্ঠু ও সুন্দর পরিবেশ নিশ্চিত করতে সহায়তা করতে পারত। আস্থার জায়গা তৈরি করতে তাঁরা ভূমিকা রাখতে পারতেন।’
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অনুসন্ধান কমিটির অপর সদস্য ও সরকারি কর্মকমিশনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাদিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের জ্ঞান, বুদ্ধি ও বিবেচনা অনুযায়ী দশজনের নাম রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করা হয়। সেখান থেকে পাঁচজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে আর কিছু বলা ঠিক হবে না।’
অনুসন্ধান কমিটির একাধিক সদস্য জানান, তাঁরা যেসব ব্যক্তির কথা ভেবেছিলেন, চূড়ান্ত তালিকায় তাঁদের সংখ্যা কম। এ জন্য তাঁদের কেউ কেউ বিব্রত। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন সদস্য বলেন, ‘আমরা যা করতে চেয়েছিলাম, তা করতে পারিনি। এমনও হয়েছে যে কমিটির ছয়জন সদস্য একমত হয়ে যে নামটি প্রস্তাব করেছেন, সেটিও বাদ পড়েছে।’
উল্লেখ্য, নির্বাচন কমিশন গঠনে ২৬টি রাজনৈতিক দল ১২৮টি নাম জমা দিয়েছিল অনুসন্ধান কমিটির কাছে। কমিটি ওই নামগুলো ছাড়াও বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া কয়েকটি নাম বিবেচনায় নেয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, নবনিযুক্ত কমিশনার রফিকুল ইসলামের নাম বিএনপি বা আওয়ামী লীগের তালিকায় ছিল না। তরীকত ফেডারেশনসহ অন্তত পাঁচটি দলের তালিকায় তাঁর নাম ছিল। তবে ১৪ দলের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বা সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টির (জাপা) তালিকায় তাঁর নাম ছিল না। অপর কমিশনার মাহবুব তালুকদারের নাম শুধু বিএনপির তালিকায় ছিল। নির্বাচন কমিশনের পাঁচজনের মধ্যে কেবল এই নামটি এককভাবে এসেছে।
অনুসন্ধান কমিটি যে দশটি নাম প্রস্তাব করেছিল, সেগুলোর মধ্যে পাঁচজন নিয়োগ পান। তিন বিশিষ্ট নাগরিক বাদ পড়েন। এ ছাড়া সিইসি হিসেবে প্রস্তাবিত আলী ইমাম মজুমদার বাদ পড়েন। ২০১২ সালের তালিকায়ও তাঁর নাম ছিল। এই নয়জন ছাড়া তালিকায় নাম ছিল আবদুল মান্নানের। আওয়ামী লীগের পাঠানো তালিকায় তাঁর নাম ছিল।
বদিউল আলম মজুমদার বলেন, অনুসন্ধান কমিটি বিশিষ্ট নাগরিকদের সঙ্গে যে বৈঠক করেছিল, তাতে সুস্পষ্ট মানদণ্ডের ভিত্তিতে সিইসি ও কমিশনার পদে নিয়োগের কথা বলা হয়েছিল। তাদের সুপারিশ ছিল জনগণকে আস্থায় নেওয়া, স্বচ্ছতার চর্চা করা এবং গোপনীয়তার সংস্কৃতি পরিহার করার। এ ছাড়া কোন যোগ্যতার ভিত্তিতে সিইসি ও কমিশনারদের নেওয়া হলো, তা প্রকাশ করার অনুরোধ জানিয়েছিল নাগরিক সমাজ। প্রকৃতপক্ষে তাদের এসব মতের কিছুই রাখা হয়নি।
শপথ ১৫ ফেব্রুয়ারি
নবনিযুক্ত সিইসি ও কমিশনাররা শপথ নেবেন ১৫ ফেব্রুয়ারি। ওই দিন বেলা তিনটায় জাজেস লাউঞ্জে তাঁদের শপথবাক্য পাঠ করানো হবে। হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার (প্রশাসন ও বিচার) মো. সাব্বির ফয়েজ প্রথম আলোকে বলেন, প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা তাঁদের শপথবাক্য পাঠ করাবেন।
এদিকে আজ বুধবার শেষ হবে কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন বর্তমান কমিশনের মেয়াদ। তবে একজন কমিশনারের মেয়াদ শেষ হবে ১৪ ফেব্রুয়ারি। ধারণা করা হচ্ছে, এ জন্য শপথের তারিখ ১৫ ফেব্রুয়ারি ঠিক করা হয়েছে।
http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1076779/%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%9A%E0%A6%A8-%E0%A6%95%E0%A6%AE%E0%A6%BF%E0%A6%B6%E0%A6%A8-%E0%A6%97%E0%A6%A0%E0%A6%A8%E0%A7%87-%E0%A6%9B%E0%A7%87%E0%A6%BE%E0%A6%9F-%E0%A6%A6%E0%A6%B2%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%AC%E0%A7%9C-%E0%A6%97%E0%A7%81%E0%A6%B0%E0%A7%81%E0%A6%A4