৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১০:৪৭

বছরে ৩২ হাজার কোটি টাকা নিয়ে যাচ্ছে বিদেশীরা

বাংলাদেশে বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করে দুই লাখের মতো বিদেশী। এই হিসাব আরও কয়েক বছর আগের। এরপর প্রতিবছরই দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিদেশী কর্মী নিয়োগ বাড়ছে। এসব বিদেশীরা এদেশ থেকে প্রতি বছর বিপুল অংকের টাকা নিয়ে যাচ্ছে। প্রতিবছর এরা নিয়ে যাচ্ছে ৩২ হাজার কোটি টাকা। এই বিপুল অংকের টাকা প্রবাসী আয়ের প্রায় এক তৃতীয়াংশ। দক্ষতার অভাবের কারণে মোটা অংকের টাকা দিয়ে পুষতে হচ্ছে বিদেশীদের। এদিকে বিদেশীদের না এনে দেশীয় দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে সরকারি বেসরকারি উদ্যোগগুলো কতটুকু ফলপ্রসূ হচ্ছে তার কোন দৃশ্যমান ফল পাওয়া যাচ্ছে না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের নব্বই লাখ মানুষ বছরে রেমিটেন্স পাঠায় প্রায় ১৬ বিলিয়ন ডলার। আর বাংলাদেশের কোটি মানুষের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার এক তৃতীয়াংশ মাত্র দুই লাখ বিদেশী নিয়ে যাচ্ছে। দেশে কোটি কোটি বেকার লোক কাজের সন্ধানে হন্ন্যে হয়ে ঘুরছে। একই সাথে লাখ লাখ শিক্ষিত বেকার দেশে বিদেশে কাজের সন্ধান করছে। পাশাপাশি অনেক শিক্ষার্থী বিদেশে গিয়ে উচ্চ ডিগ্রি নিয়ে দেশে এসে ভাল চাকরি করবে এই প্রত্যাশা নিয়ে প্রহর গুণছে। কিছু ক্ষেত্রে দেশের শিক্ষিতরা খুবই নিম্নমানের চাকরি করছে হতাশাজনক বেতনে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, úানি, ফ্রেইট ফরোয়ার্ডিং সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিদেশীদের পাশাপাশি ব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে চলেছেন দেশীয় শিক্ষিত এক্সপার্টগণ। প্রতিটি ক্ষেত্রে দেশীয় নির্বাহীদের সাফল্য অসাধারণ। এরপরও নিয়ম বহির্ভূতভাবে বিদেশীরা এদেশে নির্বিঘেœ এসে বিপুলসংখ্যক কর্মক্ষেত্রে যুক্ত হয়ে বিশাল অংকের অর্থ নিয়ে যাওয়াটা রীতিমত পুকুর চুরির মত ঘটনা।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশে বিদেশীদের মধ্যে প্রতিবেশী দেশ ভারত, শ্রীলঙ্কা, কোরিয়া, চীন, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড সহ অন্যান্য দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। যেখানে টেকনিক্যাল পার্সন ছাড়া এদেশে ভিসা নিয়ে স্কুলে শিক্ষকতার মতো পেশায়ও বিদেশী লোকজন এদেশে কর্মরত আছেন। রয়েছেন গার্মেন্টস, লজিস্টিকস, টেলিকম, জনপ্রিয় বহুজাতিক কোম্পানি, এনজিও কর্পোরেট কারখানা সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পদে। সব মিলিয়ে দ্ুই লাখের মতো বিদেশী বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করছেন। এদের অনেকেরই কাজের কোন অনুমোদন নেই। এরা কোন ধরনের ভ্যাট প্রদান করেন না। এখানে কাজ করে অর্জিত অর্থ চোরাপথে নিজের দেশে নিয়ে যাচ্ছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর মুর্শিদ কুলী খানের মতে, টেকনিক্যাল পার্সন ছাড়াও ব্যাপক সংখ্যক বিদেশী বাংলাদেশে কাজ করছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এমনকি হ্যাচারীর মতো ফার্মেও বিদেশীরা কাজ করছে। এদের বিষয় সুনির্ধারিত কোনো ডাটা নেই। অন্যদিকে এরা নিজের দেশে টাকা পাঠাচ্ছে হুন্ডির মাধ্যমে। এক্ষেত্রে জরুরি ভিত্তিতে সরকারের নজরদারী বাড়ানো উচিৎ। তিনি বলেন, দেশীয় টেকনিক্যাল পার্সন বৃদ্ধি করে ক্রমান্বয়ে দেশ-বিদেশে কর্মসংস্থানের সৃষ্টির মাধ্যমে এধরনের সমস্যা দ্রুত সমাধান করা সম্ভব।
এদিকে দেশে বিভিন্ন খাতে দক্ষ শ্রমশক্তি তৈরির লক্ষ্যে ২ বছর আগে অর্থ মন্ত্রণালয় এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এডিবির অর্থায়নে একটি প্রকল্প হাতে নেয়। এই প্রকল্পের অধীনে তিন বছরের মধ্যে বিভিন্ন খাতের জন্য প্রশিক্ষণ দিয়ে ২ লাখ ৬০ হাজার দক্ষ শ্রমিক গড়ে তোলা হবে বলে জানায়। কিন্তু এর দুই বছর পার হলেও অগ্রগতি কতটুকু সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়নি।
তবে বিনিয়োগ বোর্ডের তথ্য বলছে, দেশের শিল্প ও বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত বিদেশী কর্মী প্রতি বছরই বাড়ছে, যাদের অধিকাংশই দক্ষিণ এশিয়া, বিশেষ করে ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলংকার নাগরিক।
বেসরকারি বিনিয়োগ নিবন্ধনসহ বিওআইয়ের অন্যতম কাজ দেশের শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বিদেশীদের ওয়ার্ক পারমিট বা কাজের অনুমোদন দেয়া। বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ হওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোয় বিদেশী কর্মী নিয়োগ পেতে বিওআই থেকে অনুমতি নিতে হয়।
২০১১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত কাজের অনুমোদনের পরিসংখ্যান বলছে, দেশে কর্মরত বিদেশীদের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো থেকে আসা কর্মীর আধিপত্যই বেশি।
বিওআইয়ের তথ্য বলছে, ২০১১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত দেশের শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় কাজের জন্য ২৬ হাজার ৬১৯ জন বিদেশীর নামে ওয়ার্ক পারমিট ইস্যু করা হয়েছে। এর মধ্যে ৭ হাজার ৯২০ জন বা এক-তৃতীয়াংশই ভারতের নাগরিক। এর পরই আছে দক্ষিণ এশিয়ার আরো দুটি দেশ শ্রীলংকা ও পাকিস্তান। দক্ষিণ এশিয়ার বাইরের কর্মীদের মধ্যে আধিপত্য আছে চীনের।
গত পাঁচ বছরে শ্রীলংকান কর্মীদের কাজের অনুমোদন দেয়া হয়েছে ২ হাজার ৮৭৩টি। পাকিস্তানি কর্মীদের নামে ওয়ার্ক পারমিট ইস্যু হয়েছে ২ হাজার ৬১২টি। এ হিসাবে মোট ওয়ার্ক পারমিটের ৫০ শতাংশের বেশি পেয়েছেন এ তিন দেশের নাগরিক। এর বাইরে দেশে চীনের কর্মীদেরও আধিপত্য রয়েছে। আলোচ্য সময়ে চীনের কর্মীদের জন্য বিওআই ওয়ার্ক পারমিট ইস্যু করেছে ২ হাজার ৮২০টি।
বিওআইয়ের মতে, বিদেশী কর্মী নিয়োগে বাংলাদেশের বিনিয়োগকারীদের ওপর কোনো বিধিনিষেধ নেই। কারিগরীভাবে দক্ষ বিশেষজ্ঞ ও ব্যবস্থাপকের প্রয়োজনেই তারা শিল্প ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে বিদেশী কর্মী নিয়োগ দেন। আর রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল ইপিজেডের বাইরে স্থাপিত শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় কাজ করতে গেলেই বিওআইয়ের অনুমোদন প্রয়োজন পড়ে বিদেশীদের।
গত পাঁচ বছরের বিওআইয়ের বার্ষিক প্রতিবেদনগুলোর তথ্য অনুযায়ী, মোট ওয়ার্ক পারমিটের প্রায় ৪০ শতাংশ বাণিজ্যিক ও বাকি ৬০ শতাংশ শিল্পপ্রতিষ্ঠানে। ৮০ শতাংশের বেশি ওয়ার্ক পারমিট দেয়া হয়েছে উন্নয়নশীল দেশের কর্মীদের।
জানা যায়, দক্ষ কর্মী ঘাটতিতে প্রতি বছর দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের বছরভিত্তিক হিসাবে দেখা গেছে, ২০১৩-১৪ অর্থবছরেই দেশের বাইরে চলে যাওয়া অর্থের পরিমাণ ৪ বিলিয়ন ডলার ৩১ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এ অর্থ যাচ্ছে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে।
ভারত, শ্রীলংকা ও পাকিস্তান ছাড়াও অন্য যেসব দেশের কর্মী বাংলাদেশে কর্মরত, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইন, তুরস্ক, মরিশাস, ইন্দোনেশিয়া, উজবেকিস্তান, ইউক্রেন, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র।
এদিকে বাংলাদেশের দারিদ্র্য কমিয়ে আনতে এবং উন্নয়ন সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলতে ভালো কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করাই হবে আগামী দিনের বাংলাদেশের বড় চ্যালেঞ্জ বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এডিবি।
প্রতিষ্ঠানটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ২০১৫ সালের জুলাইয়ে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, তা সম্ভব হয়েছে ধারাবাহিক মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ভালো প্রবৃদ্ধির কারণে।
এডিবির মতে, এত সব ইতিবাচক দিক থাকা সত্ত্বেও ভালো কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিই আগামী দিনের বাংলাদেশের বড় চ্যালেঞ্জ। অন্য চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের হার কমানো, অবকাঠামো সমস্যা দূর করা, দক্ষ শ্রমগোষ্ঠী তৈরি করা, ব্যবসার পরিবেশের উন্নয়ন করা, ব্যবসা করার খরচ কমিয়ে আনা।
http://www.dailysangram.com/post/271001-%E0%A6%AC%E0%A6%9B%E0%A6%B0%E0%A7%87-%E0%A7%A9%E0%A7%A8-%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%9C%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%95%E0%A7%8B%E0%A6%9F%E0%A6%BF-%E0%A6%9F%E0%A6%BE%E0%A6%95%E0%A6%BE-%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A7%9F%E0%A7%87-%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%9A%E0%A7%8D%E0%A6%9B%E0%A7%87-%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B6