৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১০:৪৪

ডিএনসিসি: ভয়াবহ অনিয়মে জর্জরিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ; কর্মঘণ্টা ফাঁকি, চাকরি বিক্রিসহ নানা অভিযোগ

রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় শীতের কুয়াশার চাদর ঠেলে ভোররাতে সড়ক পরিচ্ছন্নতার কাজ শুরু করেন ময়না বেগম। কয়েক বছর থেকে তিনি ওই এলাকায় পরিচ্ছন্নতা কর্মী হিসেবে কাজ করছেন। প্রতিদিন ৩-৪ ঘণ্টা কাজ করেন তিনি। বিনিময়ে মাসে পান সর্বসাকুল্যে চার হাজার টাকা। অবাক হলেও সত্য; এই পরিচ্ছন্নতা কর্মী ডিএনসিসির বেতনভুক্ত নন, এক পরিচ্ছন্নতা কর্মীর ভাড়াটে কর্মী। আর ওই পরিচ্ছন্নতা কর্মী ডিএনসিসির স্কেভেঞ্জার্স ইউনিয়নের একজন নেতা। চাকরি হারানোর ভয়ে ময়না বেগম মূল পরিচ্ছন্নতা কর্মীর নাম ও পরিচয় বলতে রাজি হননি।


শুধু ময়না বেগম নন, ডিএনসিসির পরিচ্ছন্নতা বিভাগে এমন বহু কর্মী আছেন যারা অন্যের হয়ে কাজ করেন। আর বেতনের টাকাটা চলে যায় ডিএনসিসির তালিকাভুক্ত পরিচ্ছন্নতা কর্মীর অ্যাকাউন্টে। ডিএনসিসির বর্তমান মেয়র দায়িত্ব গ্রহণের পর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের এসব দুর্বলতা নিরসনের নির্দেশনা দিলেও তারা এ ক্ষেত্রে ন্যূনতম সফলতা দেখাতে পারেননি। এ কারণেই এ ধরনের অনিয়ম অব্যাহত রয়েছে।

জানা যায়, ডিএনসিসির সরাসরি তত্ত্বাবধানে বর্তমানে দুই হাজার ৭৪২ জন পরিচ্ছন্নতা কর্মী রয়েছেন। এর মধ্যে ৮০০ জন স্থায়ী এবং এক হাজার ৯৪২ জন মাস্টার রোল কর্মী। স্থায়ী পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা মাসিক ২২-২৩ হাজার টাকা বেতন পান। আর অস্থায়ী কর্মীরা দৈনিক ৪৭৫ টাকা হারে মাসিক ১৪ হাজার ২৫০ টাকা বেতন পান। এই বেতনে পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের দৈনিক আট ঘণ্টা কাজ করার কথা থাকলেও তারা ৩-৪ ঘণ্টার বেশি কাজ করেন না। অন্যদিকে বড় একটি সংখ্যক পরিচ্ছন্নতা কর্মী নিজের কাজ অন্যকে দিয়ে করাচ্ছেন। সংশ্লিষ্টদের ধারণা, এই পরিচ্ছন্নতা কর্মীর সংখ্যা হবে ন্যূনতম অর্ধেক।

মহানগরীর বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ডিএনসিসির প্রত্যেক ওয়ার্ডে যত পরিচ্ছন্নতা কর্মী রয়েছে, তারা সবাই কাজ করেন না। এদের অনেকে তিন-চার ঘণ্টার জন্য ঠিকা পরিচ্ছন্নতা কর্মী নিয়োগ করে কাজ করান। এভাবেই কাজ না করে নিজেরা মাস শেষে বড় অংকের আর্থিক সুবিধা নিচ্ছেন। এ কারণেই ডিএনসিসি প্রতি বছর পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের পেছনে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করলেও কাঙ্খিত সেবা পাচ্ছেন না নগরবাসী।

সোমবার মিরপুর মাজার রোডে কথা হয় ভাড়াটে পরিচ্ছন্নতা কর্মী আবুল হোসেনের সঙ্গে। যুগান্তরকে তিনি বলেন, সাড়ে পাঁচ বছর ধরে ডিএনসিসির এক পরিচ্ছন্নতা কর্মীর হয়ে কাজ করছেন তিনি। প্রতিদিন সকালে তিন-চার ঘণ্টা কাজ করেন। বাকি সময় তিনি দিনমজুরের কাজ করেন। আর ডিএনসিসির ওই পরিচ্ছন্নতা কর্মী মিরপুর এলাকায় মুদি মালামালের ব্যবসা করেন। মাস শেষে তিনি (ভাড়াটে কর্মী) পান সাড়ে তিন হাজার টাকা। এক বছর আগে পেতেন তিন হাজার টাকা। তবে নিষেধ থাকায় তার (মূল পরিচ্ছন্নতা কর্মী) নাম ও পরিচয় জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন আবুল হোসেন।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের অনিয়মের বিষয়টি ডিএনসিসির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের কর্মকর্তারা জানলেও রহস্যজনক কারণে তারা নির্বিকার। কেননা, একজনের কাজ অন্যজনকে দিয়ে করানো, কর্মঘণ্টা ফাঁকি দেয়া এবং একজনের চাকরি অন্যজনের কাছে বিক্রির মতো ঘটনাও ঘটে পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের ক্ষেত্রে। আর এ ধরনের অনিয়ম পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা নিজেরা এককভাবে করতে পারেন না। তাদের এ কাজে সহযোগিতা করেন ডিএনসিসির স্কেভেঞ্জার্স ইউনিয়নের নেতা, পরিচ্ছন্নতা পরিদর্শক এবং অসাধু কয়েকজন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা। এই লেনদেন আগে ওপেন সিক্রেট থাকলেও মেয়র আনিসুল হক দায়িত্ব গ্রহণের পর তা অতি গোপনীয়তা রক্ষা করে চালানো হচ্ছে। বিষয়টি বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের কর্তাব্যক্তিরা অবগত হলেও রহস্যজনক কারণে নির্বিকার।

ডিএনসিসির এক প্রকৌশলী জানান, সংস্থাটিতে বর্তমানে যত পরিচ্ছন্নতা কর্মী রয়েছে, এর অর্ধেকের বেশি কাজ করেন না। বাকিদের কেউ কর্মঘণ্টা ফাঁকি দিয়ে যেনতেনভাবে কাজ করেন। এ কারণে ডিএনসিসির বিভিন্ন সড়ক দিনের বেলায় অপরিষ্কার থাকে।

আরেক কর্মকর্তা জানান, ডিএনসিসি মেয়র যেমনভাবে নগরী পরিষ্কার দেখতে চান, সেভাবে হচ্ছে না। কেননা, পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা সঠিকভাবে কাজ করছেন না। মেয়র এ ক্ষেত্রে যতটা আন্তরিক, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের কর্মকর্তারা ততটা নন।

এ প্রসঙ্গে ডিএনসিসির স্কেভেঞ্জার্স ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইসমাইল যুগান্তরকে বলেন, আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে ডিএনসিসির পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের পারফরম্যান্স অনেক ভালো। চাকরি বিক্রি, একজনের কাজ অন্যজনকে দিয়ে করানোর এসব সিস্টেম বদলে গেছে। তবে যেসব শ্রমিক খুবই অসুস্থ বা দুর্ঘটনায় হাত-পা ভেঙে গেছে, তারা অন্যদের দিয়ে কাজ করিয়ে নেন। এটা তো কোনো দোষের নয়।

ডিএনসিসির প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা কমডোর আবদুর রাজ্জাক বিদেশে থাকায় এ ব্যাপারে তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি। তবে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মেজবাহুল ইসলাম যুগান্তরকে জানান, পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের শৃংখলায় আনতে নানা ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এখন থেকে পরিচ্ছন্নতা কর্মী নিয়োগ ও বদলির ক্ষেত্রে খুবই সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে। এ সংক্রান্ত কার্যক্রম চলমান রয়েছে। আশা করি দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিদ্যমান সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হবে।
http://www.jugantor.com/last-page/2017/02/09/99537/%E0%A6%AD%E0%A7%9F%E0%A6%BE%E0%A6%AC%E0%A6%B9-%E0%A6%85%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A7%9F%E0%A6%AE%E0%A7%87-%E0%A6%9C%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%9C%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A6%A4-%E0%A6%AC%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%9C%E0%A7%8D%E0%A6%AF-%E0%A6%AC%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%AC%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%A5%E0%A6%BE%E0%A6%AA%E0%A6%A8%E0%A6%BE-%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%97