৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১০:৪৩

মৃত সচিবের নামে ঋণ দিয়েছে কৃষি ব্যাংক

মৃত ব্যক্তিকে জীবিত দেখিয়ে টানা চার বছর একটি কোম্পানিকে ঋণ দিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক (বিকেবি)। অদ্ভুত ও নজিরবিহীন এই কাণ্ড ঘটিয়েছে বিকেবির কারওয়ান বাজার করপোরেট শাখা। এমনকি ব্যাংকের নথিতে মৃত ব্যক্তির স্বাক্ষরও আছে।
জগন্নাথ দে নামের মৃত ব্যক্তিটি একসময় সরকারের পূর্তসচিব ছিলেন এবং অবসরে যাওয়ার পর বাংলাদেশ প্ল্যান্টেশন লিমিটেড (বিডি প্ল্যান্ট) নামের একটি কোম্পানির পরিচালক হয়েছিলেন। বিডি প্ল্যান্ট ১৯৯১ থেকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি।
ঘটনাটি জানা গেছে মৃত সচিবের ঠিকানায় বিকেবির কারওয়ান বাজার শাখা থেকে পাঠানো চিঠি, মৃত সচিবের স্ত্রীর পক্ষ থেকে ব্যাংককে দেওয়া ওই চিঠির জবাব এবং বিডি প্ল্যান্টের পরিচালকদের উদ্দেশে পাঠানো বিকেবির আইনি নোটিশ থেকে।
জগন্নাথ দে ২০১১ সালের ডিসেম্বরে মারা যান। অথচ ২০১২ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত তাঁর নামে বিডি প্ল্যান্টকে ঋণ দিয়ে গেছে বিকেবি। বর্তমানে কোম্পানিটির কাছে বিকেবির পাওনা দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০ কোটি টাকা। ঋণের টাকার সুবিধাভোগী বিডি প্ল্যান্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বুদ্ধদেব মুখার্জিসহ অন্য পরিচালকেরা। বুদ্ধদেব মুখার্জি বিডি মুখার্জি নামে পরিচিত।
ঋণ দেওয়ার আগে ব্যাংকের নির্দিষ্ট ফরমে যে পরিচালকদের স্বাক্ষর থাকতে হয়, বিকেবির কারওয়ান বাজার শাখায় জগন্নাথ দের সেই স্বাক্ষর রয়েছে। শাখার বর্তমান কর্মকর্তারা এ ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেও পাওনা আদায়ে ওই মৃত জগন্নাথ দের বাড়ির ঠিকানায় চিঠি পাঠিয়ে যাচ্ছে।
জগন্নাথ দেকে সম্বোধন করে ২০১৬ সালের ৩১ মে পাঠানো শাখার চিঠিতে বলা হয়, ‘বার্ষিক ১৩ শতাংশ সুদে আপনাকে ৮ কোটি ৩২ লাখ টাকা কর্জ দেওয়া হয়েছিল। শর্তানুযায়ী ২০১৪ সালের ৩০ এপ্রিল থেকে ২০১৫ সালের ৩০ জুনের মধ্যে ৯ কোটি ৩২ লাখ পরিশোধ করার কথা। কিন্তু ২০১৫ সালের ১৬ নভেম্বর থেকে ২০১৬ সালের ২৩ মার্চ পর্যন্ত তিন দফা তাগাদা দেওয়া সত্ত্বেও আপনি টাকা পরিশোধ করেননি।’ চিঠি পাঠানোর এক মাসের মধ্যে পুরো টাকা পরিশোধের কথাও বলা হয় চিঠিতে। চিঠি পাওয়ার পর মৃত জগন্নাথ দের স্ত্রী গায়ত্রী দে গত বছরের ২৬ জুলাই বিকেবির কারওয়ান বাজার শাখার উপ-মহাব্যবস্থাপককে (ডিজিএম) লিখিত জবাব দেন। এর আগে ১৭ জুলাই তিনি প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে দেখা করেন বিকেবির তৎকালীন এমডি এম এ ইউসুফের সঙ্গে।
জবাবে গায়ত্রী দে বলেন, ‘আপনাদের চিঠিতে আমার স্বর্গীয় পতি জগন্নাথ দেকে বিডি প্ল্যান্টের নামে ঋণ গ্রহণকারী দেখিয়ে টাকা পরিশোধের তাগিদ দিয়েছেন। চিঠি পেয়ে আমি হতবিহ্বল হয়ে পড়ি। তিনি পরলোক গমন করেছেন ২০১১ সালের ৯ ডিসেম্বর।’ জগন্নাথ দে মারা যাওয়ার পরও পরিচালক দেখিয়ে বিডি প্ল্যান্টের এমডি বিডি মুখার্জি বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়েছেন বলে জবাবে উল্লেখ করেন গায়ত্রী দে। গায়ত্রী দের জবাবে আরও দেখা যায়, বিকেবির সাবেক এমডি এম এ ইউসুফ বিষয়টি সুরাহা করে দেবেন বলে গায়ত্রী দেকে আশ্বাস দিয়েছিলেন। এরপরও পাঁচ মাস এমডির দায়িত্বে ছিলেন তিনি, কিন্তু সুরাহা আর করে যাননি।
এরপর গত বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর জগন্নাথ দেসহ বিডি প্ল্যান্টের সব পরিচালককে আইনি নোটিশ দেয় বিকেবি। এতে ১৫ দিনের মধ্যে ১০ কোটি টাকা পরিশোধের কথা বলা হয় এবং বলা হয় এটাই চূড়ান্ত নোটিশ।
বিকেবির এমডি মুহাম্মদ আউয়াল খানের সঙ্গে ১ ফেব্রুয়ারি প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে যোগাযোগ করলে তিনি শাখা থেকে খোঁজ নিয়ে বক্তব্য দেবেন বলে জানান। ৫ ফেব্রুয়ারি এমডি বলেন, ‘কীভাবে কী হলো বলতে পারব না। কারণ শাখা থেকে পুরো তথ্য এখনো পাইনি। তবে ঋণটা কোনো ব্যক্তিকে দেওয়া হয়নি, দেওয়া হয়েছে কোম্পানিকে।’
কারওয়ান বাজার শাখায় গিয়ে ৫ ফেব্রুয়ারি জানতে চাইলে ডিজিএম এ আর এম সালার-ই-জাহান প্রথম আলোকে বলেন, তিনি এ শাখায় আসার আগের ঘটনা এটা। আর প্রধান কার্যালয় যেসব তথ্য চেয়েছিল, সবই জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
টাকা পরিশোধের চিঠি পাওয়ার পর বিকেবির কারওয়ান বাজার শাখায় একবার গিয়েছিলেন বলে জানান গায়ত্রী দে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘নথিতে ২০১৩-১৪ সালেও জগন্নাথ দে স্বাক্ষর করেছেন বলে ব্যাংকের লোকজন আমাকে দেখিয়েছেন। দেখে আমি তাজ্জব বনে যাই, এগুলো কী হচ্ছে!’
রাজধানীর সবুজবাগে শ্রীশ্রী বরদেশ্বরী মহাশ্মশানে জগন্নাথ দেকে ২০১১ সালের ৯ ডিসেম্বর যে দাহ করা হয়েছে, তার একটি সনদ শ্মশান কমিটি থেকে তুলে ব্যাংকে জমা দিয়েছেন বলে প্রথম আলোকে জানান গায়ত্রী দে।
ঋণ বিতরণের সময় কারওয়ান বাজার শাখার ডিজিএম ছিলেন ঠাকুর দাস কুন্ডু, পদোন্নতি পেয়ে যিনি এখন প্রধান কার্যালয়ের মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন)। জানতে চাইলে গত সোমবার ঠাকুর দাস কুন্ডু প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিডি প্ল্যান্টের অনেক সম্পত্তি আছে। নিরাপদ মনে করেই ঋণ দেওয়া হয়। টাকা আদায়ে প্রয়োজনে চা-বাগান নিলামে বিক্রি করে দেব।’
মৃত ব্যক্তির স্বাক্ষর নেওয়ার মতো জালিয়াতি কেন হলো এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা ভুলে হয়েছে। আর জগন্নাথ দের ঠিকানায় টাকা পরিশোধের চিঠিও পাঠানো হয়েছে ভুলে।’ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুরো বিষয়টি জানে এবং এ ঘটনায় গায়ত্রী দের কোনো সমস্যা হবে না বলেও তিনি মনে করেন।
জানতে চাইলে গত রোববার বিডি মুখার্জি প্রথম আলোকে বলেন, কোম্পানির যে পরিমাণ সম্পত্তি আছে, সে তুলনায় ১০ কোটি টাকা কিছুই না। মারা যাওয়ার পরও জগন্নাথ দেকে পরিচালক দেখানো, এমনকি তাঁর স্বাক্ষর দেওয়ার মতো ঘটনা কীভাবে ঘটল, জানতে চাইলে বিডি মুখার্জি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
হবিগঞ্জের মাধবপুরে ‘বৈকুণ্ঠপুর চা বাগান’ নামে বিডি প্ল্যান্টের ৯৫৫ একর আয়তনের একটি চা-বাগান রয়েছে। বাগানটির ৪০০ একর জমিতে এত দিন চা-চাষ হচ্ছিল, কিন্তু গত বছরের মে মাস থেকে বাগানটি বন্ধ, শ্রমিকদের পাওনাও বাকি রয়েছে।
পুঁজিবাজারে বিডি প্ল্যান্টের শেয়ার বিক্রি হচ্ছে ওভার দ্য কাউন্টার (ওটিসি) মার্কেটে। স্টক এক্সচেঞ্জে বেশি খারাপ হয়ে যাওয়া কোম্পানিগুলোকেই মূল বাজার থেকে বের করে দিয়ে ওটিসি মার্কেটে পাঠানো হয়। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) সূত্রে জানা গেছে, বিডি প্ল্যান্টের ৭০ দশমিক ৮৮ শতাংশ শেয়ার পরিচালকদের হাতে রয়েছে। বাকি ২৯ দশমিক ১২ শতাংশ শেয়ার রয়েছে সাধারণ মানুষের হাতে।
http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1077549/%E0%A6%AE%E0%A7%83%E0%A6%A4-%E0%A6%B8%E0%A6%9A%E0%A6%BF%E0%A6%AC%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A7%87-%E0%A6%8B%E0%A6%A3-%E0%A6%A6%E0%A6%BF%E0%A7%9F%E0%A7%87%E0%A6%9B%E0%A7%87-%E0%A6%95%E0%A7%83%E0%A6%B7%E0%A6%BF-%E0%A6%AC%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%82