৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১০:৪২

মানুষ এখন কতটা মানুষ?

৭ ফেব্রুয়ারি সম্মেলনে কিছু কথা বলেছেন দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশে আমি সবচেয়ে অধিকারবঞ্চিত একজন নাগরিক। গণতন্ত্র, মানবাধিকার, ইসলাম ও মুসলমানদের পক্ষে অবস্থান নেয়ায় আমার চিকিৎসার অধিকারও কেড়ে নেয়া হয়েছে। মাহমুদুর রহমান আরো বলেন, দীর্ঘ পাঁচ বছর কারাভোগের কারণে আজ আমি গুরুতর অসুস্থ। বিদেশে আমার চিকিৎসার প্রয়োজন। আদালত আমার চিকিৎসার জন্য শুধু যুক্তরাজ্য যাওয়ার অনুমতি দিয়েছেন। কিন্তু যুক্তরাজ্য হাস্যকর কারণ দেখিয়ে আমার ভিসা আবেদন খারিজ করে দিয়েছে। এ ঘটনায় আমি দুঃখিত হলেও অবাক হইনি। গত ২৩ নবেম্বর কাশিমপুর কারাগার থেকে মুক্তির পর এটাই তার প্রথম আনুষ্ঠানিক বক্তব্য। সংবাদ সম্মেলনে ভিসা আবেদন খারিজ প্রসঙ্গে মাহমুদুর রহমান বলেন, যুক্তরাজ্যের ভিসা কর্মকর্তা বলেছেন, আমি নাকি যুক্তরাজ্যে গলে নাও ফিরতে পারি। রাজনৈতিক আশ্রয় চাইতে পারি। কিন্তু আমার বসয় এখন ৬৩ বছর। যুক্তরাজ্যে থাকার চিন্তা আমি কখনই করিনি এবং ভবিষ্যতেও করবো না।
১৯৮৬ সালে আমি প্রথম যুক্তরাজ্যে যাই। এরপর থেকে প্রতিবারই পাঁচ বছরের জন্য আমার ভিসা নবায়ন করা হয়। সর্বশেষ ২০১২ সালে আমার চোয়ালের অপারেশনের জন্য লন্ডনে গিয়েছিলাম। তখনো আমার ওপর সরকারি দমন-পীড়ন চলছিল এবং আমি ৫০টি মামলার ভিকটিম ছিলাম। সে সময়ও লন্ডনে থেকে যাওয়ার কোনো চিন্তা আমার মাথায় আসেনি এবং অপারেশনের জন্য যে কয়দিন থাকার দরকার সেই কয়দিনই আমি সেখানে ছিলাম। প্রসঙ্গত তিনি আরো বলেন, আমার মনে হয় যুক্তরাজ্যের দৃষ্টিতে আমার অপরাধ আমি কেন ইসলামের পক্ষে অবস্থান নিয়েছি? আজ আমি যদি ইসলামের বিরুদ্ধে শক্তি হতাম, তাহলে আমাকে ভিসা চাইতে হতো না, ডেকে নিয়ে ভিসা দেয়া হতো।
চিকিৎসার অধিকার থেকে বঞ্চিত মাহমুদুর রহমান তার কিছু অনুভূতি ও উপলব্ধির কথা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, আমি দেশের সবচেয়ে অধিকারবঞ্চিত একজন নাগরিক। বর্তমান সময়ে দেশে-বিদেশে মানুষের অধিকার তথা মানবাধিকার নিয়ে নানা মাত্রায় আলোচনা হচ্ছে, তারপরও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বেড়েই চলেছে। ফলে প্রশ্ন জাগে, বর্তমান সভ্যতায় মানুষ কতটা মানুষ?
মানবাধিকার নিয়ে কথা বলতে গেলে বর্তমান সময়ে মিয়ানমারের পাশাপাশি চলে আসে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নামও। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর হত্যাযজ্ঞ ও গণধর্ষণ চালিয়েছে। এ সম্ভাবনা খুব বেশি যে ওই অভিযান মানবতাবিরোধী অপরাধের সামিল এবং তা সম্ভবত জাতিগত নির্মূলের পর্যায়ে পড়ে। ৩ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক কার্যালয়ের এক প্রতিবেদনে এ মন্তব্য করা হয়েছে। সুইজারল্যান্ডের জেনেভা থেকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই নির্মূল অভিযানে সম্ভবত শত শত মানুষ প্রাণ হারিয়েছে।
প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর একই দিন জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থার হাইকমিশনার জেইদ রা’আদ আল হুসেইন বলেছেন, রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংসতার যে কথা জাতিসংঘ বলেছে তা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি। ৩ ফেব্রুয়ারি সু চির সঙ্গে টেলিফোনে কথা হয় হুসেইনের। উল্লেখ্য যে, জেনেভায় রয়টার্সকে দেয়া সাক্ষাৎকারে হুসেইন বলেছেন, ‘আমি সু চির সঙ্গে কথা বলেছি। সেনা ও নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযান বন্ধে সব ধরনের চাপ প্রয়োগের আহ্বান জানিয়েছি তার প্রতি। তিনি আমাকে বলেছেন, এ ব্যাপারে তদন্ত শুরু করবেন তিনি।’ এদিকে মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট থিন কিউয়ের এক মুখপাত্র বলেন, ‘এগুলো অত্যন্ত গুরুতর অভিযোগ এবং আমরা এ ব্যাপারে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। আমরা দ্রুত এসব অভিযোগের ব্যাপারে ভাইস প্রেসিডেন্ট ইউ মিন্ত সুইয়ের নেতৃত্বে তদন্ত কমিশনের মাধ্যমে তদন্তের ব্যবস্থা করবো। অবমাননা ও জুলুমের পরিষ্কার প্রমাণ পাওয়া মাত্র প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
জাতিসংঘ মানবাধিকার কার্যালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়, মিয়ানমার সেনাদের অভিযানের কারণে রাখাইন রাজ্যের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ উত্তরাঞ্চল থেকে প্রায় ৬৬ হাজার মানুষ পালিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। তবে সম্প্রতি জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা বিষয়ক কার্যালয় পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ৬৯ হাজার বলে উল্লেখ করেছে। মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর যে গণহত্যা ও গণধর্ষণ চালিয়েছে তা ইতিহাসে এক নিকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে থাকবে। এমন নিকৃষ্ট তৎপরতা মিয়ানমার সরকারের অবগতি ও অনুমোদনের মধ্যেই হয়েছে। বিষয়টি মিয়ানমারের সেনা কর্মকর্তা ও সরকারের লোকজন ভালোভাবেই জানেন। অথচ তারা এখন এমনভাবে কথা বলছেন যেন তারা কিছুই জানেন না। এখন তারা উদ্বেগ প্রকাশ করছেন এবং তদন্তের পর ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা বলছেন। এটাও ইতিহাসের এক নিকৃষ্টতম নাটক। জাতিসংঘ ও বিশ্ব নেতৃবৃন্দের বিষয়টি উপলব্ধি করার কথা। উপলব্ধির আলোকে তারা যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়।
এদিকে একের পর এক নির্বাহী আদেশ জারির মাধ্যমে ট্রাম্প নানা অস্থিরতা সৃষ্টি করে চলেছেন। তবে মুসলিম অধ্যুষিত সাত দেশের নাগরিকদের ওপর প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভ্রমণ-নিষেধাজ্ঞা সাময়িকভাবে স্থগিত রাখার নির্দেশ দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের একজন ফেডারেল বিচারক। সিয়াটল আদালতের এই স্থগিতাদেশ প্রথমবারের মতো দেশজুড়ে কার্যকর হবে। গত শুক্রবার এই আদেশ দেয়া হয়। উল্লেখ্য যে, প্রেসিডেন্টের নির্বাহী আদেশকে কোনো রাজ্যের বিচারক চ্যালেঞ্জ করতে পারেন না বলে সরকারি আইনজীবীর দাবিও নাকচ করে দেন সিয়াটল ডিস্ট্রিক্ট বিচারক জেমস রবার্ট।
প্রেসিডেন্টের ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞাকে অসাংবিধানিক ও মুসলিমদের জন্য অযথা হয়রানির কারণ বলে উল্লেখ করা হয় নির্দেশনায়। আরো কয়েকটি অঙ্গরাজ্যের অ্যাটর্নি জেনারেলও ট্রাম্পের আদেশকে অসাংবিধানিক বলে বর্ণনা করেছেন।
একজন বিচারক যখন প্রেসিডেন্টের আদেশকে অসাংবিধানিক ও হয়রানিমূলক বলে উল্লেখ করেন, তখন উপলব্ধি করা যায় যে, আদেশটি সুবিবেচনাপ্রসূত হয়নি। বিচারকের নির্দেশনার বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারছে মার্কিন সমাজও। ফলে ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশের ওপর আদালত স্থগিতাদেশ জারি করার পর মার্কিন এয়ারলাইন্সগুলো নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা ভিসাপ্রাপ্ত মুসলিমদের বহন শুরু করেছে। আদালতের আদেশের পর পরই দেশটির কাস্টমার অ্যান্ড বর্ডার প্রোটেকশন (সিপিবি) কর্তৃপক্ষ এক বিবৃতিতে মার্কিন এয়ারলাইন্সগুলোকে নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা বৈধ ভিসাপ্রাপ্ত মুসলিমদের বহনের নির্দেশনা জারি করে। বিমান কোম্পানিগুলোকে নির্বাহী আদেশের আগে যেভাবে যাত্রী বহন করছিল, সেভাবেই কাজ চালিয়ে যেতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
এদিকে সাতটি মুসলিমপ্রধান দেশের নাগরিকদের বিরুদ্ধে দেয়া ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আদালতের আদেশে সাময়িকভাবে স্থগিত হয়ে গেলেও তা উল্টে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। আর এ কাজে তিনি সফল হলেও আমরা তেমন অবাক হবো না।
আমরা জানি, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট একজন ক্ষমতাবান ব্যক্তি। আর ট্রাম্পের মতো একজন দাম্ভিক মানুষের পক্ষে এমন হুংকার দেয়া তেমন অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। তবে ট্রাম্পের বক্তব্যের চাইতেও আদালতের বক্তব্য আমাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে। আদালত একটি ধর্ম গোষ্ঠীর মানুষের বৈধ অধিকারের পক্ষে নির্দেশনা দিয়ে মার্কিন সংবিধানকে সমুন্নত রেখেছেন।
মুসলমানদেরকে অযথা হয়রানির বিরুদ্ধে ভূমিকা রেখে বৈষম্য ও বর্ণবাদকে রুখে দিয়েছেন। মার্কিন আদালতের এমন ভূমিকা যুক্তরাষ্ট্রকে তার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের পথে বহমান রেখে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখবে বলে আমরা মনে করি। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তার প্রশাসন বিষয়টি উপলব্ধি করে কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়।
লেখাটি শুরু করেছিলাম অধিকারবঞ্চিত মাহমুদুর রহমানের দুঃখ নিয়ে, তবে এই ধরনের দুঃখ পুরো সভ্যতাকেই যেন ঘিরে ফেলছে। প্রাচ্যের মিয়ানমার কিংবা পাশ্চাত্যের আমেরিকা সর্বত্রই লক্ষ্য করা যাচ্ছে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সেই দানবীয় অশনি-সঙ্কেত। এমন সঙ্কট থেকে কি মানুষের মুক্তি নেই?
http://www.dailysangram.com/post/271042-%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A7%81%E0%A6%B7-%E0%A6%8F%E0%A6%96%E0%A6%A8-%E0%A6%95%E0%A6%A4%E0%A6%9F%E0%A6%BE-%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A7%81%E0%A6%B7