নরসিংদী : দুর্ঘটনা কবলিত দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া মাইক্রোবাস। (ডানে) দুর্ঘটনা কবলিত বাসের সামনের অংশ -সংগ্রাম
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, সোমবার, ১০:২৪

জানুয়ারিতে প্রাণ হারিয়েছে ৪১৬ বিগত ৩৬ ঘণ্টায় ৪০ জন

সড়ক-মহাসড়কে বেপরোয়া চালকদের নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। ফলে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল বেড়েই চলছে। প্রায় প্রতিদিনই সড়কে ঝরে যাচ্ছে তাজা প্রাণ। মাত্র ৩৬ ঘণ্টার ব্যবধানে দেশের সড়কে প্রাণ গেল অন্তত ৪০ জনের। জানুয়ারি মাসে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ৪১৬ জন নিহত ও এক হাজার ১২ জন আহত হয়েছেন।
গতকাল রোববার নরসিংদীতে ভয়াবহ দুর্ঘটনায় ১২ জন নিহত হয়েছেন। আর শুক্রবার রাতে ফরিদপুরে ঘটেছে আরেক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। ফরিদপুরের নগরকান্দায় গ্যাস সিলিন্ডারবাহী কাভার্ড ভ্যানের সঙ্গে যাত্রীবাহী বাসের সংঘর্ষের পর আগুন ধরে যাওয়ায় ১৩ জন দগ্ধ হয়ে মারা যান। এর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় যশোর ও হবিগঞ্জে শিক্ষার্থীসহ ১০ জন নিহত এবং অর্ধশত লোক আহত হয়।
প্রশিক্ষণবিহীন অদক্ষ চালকের কারণে সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ছে বলে সম্প্রতি এক সেমিনারে উল্লেখ করা হয়েছে। দ্রুতগতিতে গাড়ি চালানোর পাশাপাশি চালকরা গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোনে কথা বলার কারণেও দুর্ঘটনা ঘটছে। এ জন্য চালকদের সচেতন হতে হবে। পাশাপাশি যাত্রীদেরও সচেতন করা হলে সড়ক দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমে যাবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
বেসরকারি সংগঠন নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির মাসিক নিয়মিত পরিসংখ্যান ও পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, চলতি বছরের (২০১৭) জানুয়ারি মাসে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ৪১৬ জন নিহত ও এক হাজার ১২ জন আহত হয়েছেন। ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত সংঘটিত ৩৫০টি দুর্ঘটনায় নিহতের মধ্যে ৫৪ নারী ও ৫৫ শিশু রয়েছে। মহাসড়ক, জাতীয় সড়ক, আন্তঃজেলা সড়ক ও আঞ্চলিক সড়কগুলোতে এসব প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা ঘটে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের হার ডিসেম্বরের তুলনায় জানুয়ারি মাসে বেড়েছে। জাতীয় কমিটির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বিদায়ী ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে সারা দেশে মোট ২৮১টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। প্রাণঘাতী এসব দুর্ঘটনায় ৩৩২ জন নিহত ও ৬৫৪ জন আহত হন। নিহতদের মধ্যে ৫০ নারী ও ৩৮ শিশু রয়েছে। অন্যদিকে জানুয়ারিতে দুর্ঘটনা ঘটেছে ৩৫০টি; যাতে ৫৪ নারী ও ৫৫ শিশুসহ ৪১৬ জন নিহত ও এক হাজার ১২ জন আহত হন। এতে দেখা যায়, ডিসেম্বরের তুলনায় জানুয়ারিতে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে ৬৯টি। আর নিহত ও আহতের সংখ্যা বেড়েছে যথাক্রমে ৮৪ ও ৩৫৮। গত দুই মাসের এই পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বিদায়ী বছরের শেষ মাসের তুলনায় চলতি বছরের প্রথম মাসে সড়ক দুর্ঘটনা, প্রাণহানি ও আহতের হার যথাক্রমে ২৪ দশমিক ৫৬ শতাংশ, ২৫ দশমিক ৩১ শতাংশ ও ৫৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ বেড়েছে।
জাতীয় কমিটি সড়ক দুর্ঘটনা ফের বৃদ্ধির পেছনে চারটি প্রধান কারণ চিহ্নিত করে। এগুলো হলো- সড়ক ও মহাসড়কে থ্রি-হুইলারসহ স্থানীয়ভাবে তৈরি যন্ত্রচালিত ক্ষুদ্র যানবাহনের সংখ্যা হঠাৎ বেড়ে যাওয়া, দূরপাল্লার অধিকাংশ যানবাহনে কুয়াশাভেদী বাতি না থাকা সত্ত্বেও শীত মৌসুমে ঘনকুয়াশার মধ্যে দ্রুতগতিতে গাড়ি চালানো, গ্রামীণ জনপদসহ আঞ্চলিক সড়কগুলোতে মোটরসাইকেলে বাণিজ্যিকভাবে যাত্রী বহনের কারণে অদক্ষ চালকের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি এবং পদচারি ও অযান্ত্রিকসহ ক্ষুদ্র যানবাহন চালকদের সচেতনতার অভাব। এছাড়া সড়ক দুর্ঘটনার জন্য সাতটি সাধারণ কারণ শনাক্ত করেছে জাতীয় কমিটি। সেগুলো হলো- বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন চালক নিয়োগ, নিয়ম ভঙ্গ করে ওভারলোডিং ও ওভারটেকিং করার প্রবণতা, চালকদের দীর্ঘক্ষণ বিরামহীনভাবে গাড়ি চালানো, ট্রাফিক আইন যথাযথভাবে অনুসরণ না করা, ত্রুটিপূর্ণ গাড়ি চলাচল বন্ধে আইনের যথাযথ প্রয়োগের ঘাটতি এবং ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক ও চলাচলের অনুপযোগী সড়ক।
এদিকে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি পর্যবেক্ষণ মতে বিদায়ী ২০১৬ সালে সারাদেশে ৪৩১২টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে প্রাণ হারিয়েছেন ৬ হাজার ৫৫ জন। আর আহত হয়েছেন ১৫ হাজার ৯১৪ জন। আহতদের মধ্যে হাত-পা বা অন্য অঙ্গ হারিয়ে চিরতরে পঙ্গু হয়েছে ৯২৩ জন। ২০১৬ সালে এক হাজার ৬৩টি বাস, এক হাজার ১৮৭টি ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান, ৫৯৭টি হিউম্যান হলার ৬৪৯টি কার জিপ মাইক্রোবাস ৯৭৩টি অটোরিকশা এক হাজার ৪৪৯টি মোটরসাইকেল, এক হাজার ১৯০টি ব্যাটারি চালিত রিকশা ৮৬৩টি নছিমন করিমন দুর্ঘটনার কবলে পড়ে।
কয়েকটি ঘটনা : ১২ ফেব্রয়ারি (রোববার) সকাল সাড়ে ৮টায় নরসিংদীতে ভয়াবহ দুর্ঘটনায় ১২ জন নিহত হয়েছেন। আর আগের দিন শুক্রবার রাতে ফরিদপুরে ঘটেছে আরেক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। ফরিদপুরের নগরকান্দায় গ্যাস সিলিন্ডারবাহী কাভার্ড ভ্যানের সঙ্গে যাত্রীবাহী বাসের সংঘর্ষের পর আগুন ধরে যাওয়ায় ১৩ জন দগ্ধ হয়ে মারা যান।
জানা গেছে, নরসিংদীর বেলাবো উপজেলার দড়িয়াকান্দিতে বাস-মাইক্রোবাস সংঘর্ষে ১২ জন নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে ২ শিশু ও ৪ নারী রয়েছেন বলে জানা গেছে। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও ৪ জন। গতকাল সকাল সাড়ে ৮টার দিকে এ ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে। আহতদের মধ্যে ৩ জনকে ভৈরব হাসপাতালে ও একজনকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ফরিদপুরের নগরকান্দা থানার গজারিয়া এলাকায় ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে বাস ও পিকআপ ভ্যানের সংঘর্ষে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১৩ জন হয়েছে। এছাড়া আরও অন্তত ১৫ আহত হয়েছেন। শুক্রবার দিবাত রাত সাড়ে ১১টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুরে ট্রাকচাপায় ইজিবাইক আরোহী অবসরপ্রাপ্ত এক সৈনিকসহ তিনজন নিহত ও অপর ছয়জন আহত হয়েছেন। শুক্রবার রাত সাড়ে ৯টায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। এছাড়া গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের চক্রবর্তী বাসস্ট্যান্ড এলাকায় বাস ও ট্রাক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে দুইজন নিহত এবং ২৫ জন আহত হয়েছেন। শনিবার রাত ৭টার দিকে নবীনগর-কালিয়াকৈর সড়কে এই ঘটনা ঘটে। নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার আইড়মারি সেতু এলাকায় বনপাড়া-হাটিকুমরুল মহাসড়কে শনিবার ভোর পাঁচটার দিকে একটি ট্রাক অপর একটি ট্রাককে ধাক্কা দিলে তিনজন নিহত ও সাতজন আহত হন। নিহতদের মধ্যে ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার হারোয়া গ্রামের আবদুল হাকিমের ছেলে শহীদ হোসেন (৪০) ও টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলার চর তেঁতুলিয়া গ্রামের মৃত কোরবান আলীর ছেলে ফুলচাঁদ আলীর (৩৮) পরিচয় জানা গেছে। যশোর-মাগুরা সড়কের শেখপাড়া নামক স্থানে শনিবার ভোররাতে সড়ক দুর্ঘটনায় একই পরিবারের তিনজনসহ চার ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। আহত হন আরও ১০ জন। নিহতরা হলেন দেবগ্রাম ইউনিয়নের তেনাপচা গ্রামের বাসিন্দা ব্যবসায়ী নূর মোহাম্মদ মোল্যার স্ত্রী খোদেজা বেগম (৪৫), নূর মোহাম্মদের ভাই সালাম মোল্যার স্ত্রী মজিরন বেগম (৪০) ও সালাম মোল্যার ছেলে আলামিন (৯) এবং দৌলতদিয়া ইউনিয়নের উত্তর দৌলতদিয়া ওমর আলী মোল্যা পাড়ার মৃত আজগর আলী সরদারের স্ত্রী ফুলজান বিবি (৭০)।
অন্যদিকে ২৭ জানুয়ারি সড়ক দুর্ঘটনায় যশোর ও হবিগঞ্জে ১০ জন নিহত এবং অর্ধশত আহত হয়। এর মধ্যে য়শোরের চৌগাছায় গাছের সঙ্গে ধাক্কা লেগে পিকনিকের বাস উল্টে ৫ ও হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জে বাস-ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে ৫ জন শিক্ষার্থী মারা হয়। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার রামকৃষ্ণপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বাসে তাদের শিক্ষার্থীদের নিয়ে ২৬ জানুয়ারি রাত ৯টার দিকে স্কুল থেকে দিনাজপুরের স্বপ্নপুরীর উদ্দেশে রওনা হয়। চৌগাছা পুড়াপাড়া রোডে দানবাক্স এলাকায় পৌঁছে রাস্তার পাশের একটি তাল গাছের সঙ্গে সজোরে ধাক্কা লেগে বাসটি উল্টে যায়। এতে ঘটনাস্থলেই বাসের হেলপার মিলন (২৭) ও শিক্ষক জহুরুল (৪৫) নিহত হন। এ ছাড়া শিক্ষার্থী সুমাইয়া খাতুন (১৩) ও সাথি খাতুন (১৪) হাসপাতালে আনার পর মারা যায়। এ ঘটনায় দুর্ঘটনাস্থলে থাকা মিলন হোসেন নামে এক ট্রাক হেল্পারও নিহত হন। আহতদের মধ্যে রয়েছেন শিক্ষার্থী সাগর (১৪), আকলিমা খাতুন (১৫), অফিস সহকারী সত্য কুমার (৩৫), যোথি খাতুন (১৩), উর্মি খাতুন (১৪), অলিয়ার রহমান (১৫), সাথি খাতুন (১৪), শিক্ষক কামাল হোসেন (৪০), আজম আশরাফুল (৪২), মিলন (১৪), রোজিনা খাতুন (১৩), কল্পনা খাতুন (১৫), অনন্যা খাতুন (১৩), শিক্ষক কবির হোসেন (৩৭)।
http://www.dailysangram.com/post/271590-%E0%A6%9C%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A7%81%E0%A7%9F%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A6%A4%E0%A7%87-%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%A3-%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A7%9F%E0%A7%87%E0%A6%9B%E0%A7%87-%E0%A7%AA%E0%A7%A7%E0%A7%AC-%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%97%E0%A6%A4-%E0%A7%A9%E0%A7%AC-%E0%A6%98%E0%A6%A3%E0%A7%8D%E0%A6%9F%E0%A6%BE%E0%A7%9F-%E0%A7%AA%E0%A7%A6-%E0%A6%9C%E0%A6%A8