১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, সোমবার, ১০:২২

দুই দিনে ৫০ জন: ২৪ ঘণ্টায় আরও ২৫ জনের প্রাণ গেল

সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনায় আবার ব্যাপক প্রাণহানি হয়েছে। গতকাল রোববার বিকেল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ৯ জেলায় সড়ক-মহাসড়কে প্রাণ গেছে ২৫ জনের। এর মধ্যে শুধু নরসিংদীতে বাস-মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন ১৩ জন। তাঁদের ১২ জন কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলার একই গ্রামের তিন পরিবারের সদস্য।
এ ছাড়া রাজধানী ঢাকা, ঢাকার সাভার, গাজীপুর, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম, ঝিনাইদহ ও রাজশাহীতে গত শনিবার সন্ধ্যা থেকে গতকাল বিকেল পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১২ জন।
এর আগে শুক্রবার রাত থেকে শনিবার রাত পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনা কেড়ে নেয় ২৫ জনের প্রাণ।
নরসিংদীতে নিহত ১৩
প্রত্যক্ষদর্শী ও দুর্ঘটনায় হতাহত ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা বলেন, নরসিংদীর বেলাব উপজেলার দড়িকান্দি বাসস্ট্যান্ড এলাকায় ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের মাঝখানে গতকাল সকালে একটি অটোরিকশা হঠাৎ থেমে যায়। এর সামান্য পেছনে থাকা একটি মাইক্রোবাস অটোরিকশাটিকে আকস্মিক পাশ কাটাতে গেলে বিপরীত দিক থেকে আসা একটি যাত্রীবাহী বাসের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। মাইক্রোবাসটির সামনের অংশ বাসের নিচে চলে যায়। ঘটনাস্থলেই ১১ জন নিহত হন। আহত হন ১০ জন। তাঁদের মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে একজন এবং ঢাকায় নেওয়ার পর মারা যায় এক শিশু। বাসটি হবিগঞ্জ থেকে ঢাকায় ও মাইক্রোবাসটি ঢাকা থেকে কিশোরগঞ্জ যাচ্ছিল।
নিহত ব্যক্তিরা হলেন কিশোরগঞ্জের নিকলীর ছাতিরচর গ্রামের নাজমুল মিয়া (৩৫), তাঁর বোন সাধনা বেগম (৪০), চাচাতো ভাই হীরা মিয়া (৪০); মানিক মিয়া (৫৫), তাঁর স্ত্রী মফিয়া খাতুন (৪৫), ছেলে অন্তর আলম (১০), পুত্রবধূ শারমিন আক্তার (২৭) ও শারমিনের ছেলে রাব্বি (৩); হাসান মিয়া (৩৪), তাঁর স্ত্রী হালিমা বেগম (২৫), ছেলে ঈশান মিয়া (৮), হালিমার বোন ঝুমা বেগম (১৫) এবং অজ্ঞাতপরিচয় এক ব্যক্তি (৪০)। তাঁরা সবাই মাইক্রোবাসের আরোহী ছিলেন।
প্রত্যক্ষদর্শী দড়িকান্দি বাসস্ট্যান্ড এলাকার জুতা ব্যবসায়ী কাওসার মিয়া বলেন, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে অটোরিকশা চলাচল নিষিদ্ধ হলেও প্রতিদিন শত শত অটোরিকশা চলছে। সড়কের মাঝে অটোরিকশাটি থেমে না থাকলে দুর্ঘটনাটি ঘটত না।
নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা বলেন, হতাহত ব্যক্তিরা দীর্ঘদিন ধরে পরিবার নিয়ে ঢাকায় বাস করেন। তাঁদের কেউ রিকশাচালক, কেউ হকার এবং নারীদের কেউ কেউ বাসাবাড়িতে কাজ করেন। তাঁরা একসঙ্গে গ্রামে যাচ্ছিলেন।
ভৈরব হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মিজানুর রহমান বলেন, পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে লাশগুলোর ময়নাতদন্ত করা হয়নি। দুর্ঘটনাকবলিত বাস ও মাইক্রোবাস হাইওয়ে থানা হেফাজতে আছে। আহত ব্যক্তিদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। সড়কে থেমে থাকা একটি অটোরিকশা দুর্ঘটনার কারণ—প্রত্যক্ষদর্শীদের এমন দাবির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সড়কের মাঝে একটি অটোরিকশা থেমে থাকার কথা আমিও শুনেছি।’
ময়মনসিংহে দম্পতি নিহত
ময়মনসিংহের ভালুকা মডেল থানার ওসি মামুন অর রশিদ বলেন, শনিবার রাতে ভালুকার সিডস্টোর বাজারের সামনে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক পার হওয়ার সময় বাসচাপায় নিহত হন এমদাদ হোসেন (৪০) ও তাঁর স্ত্রী কুলসুম (৩৫)। তাঁরা ভালুকার লবণকোঠা গ্রামের বাসিন্দা। এ খবরে বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী রাতেই সিডস্টোর এলাকায় মহাসড়ক অবরোধ করেন। কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। খবর পেয়ে ভালুকা মডেল থানা-পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
টাঙ্গাইলে কলেজছাত্রসহ নিহত ৩
টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের গোড়াই হাইওয়ে থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. কিবরিয়া বলেন, ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের মির্জাপুর বাইপাস বাসস্ট্যান্ড এলাকায় গতকাল সকালে ট্রাকচাপায় মীর আহমেদ সুজন (২৭) নামের এক মোটরসাইকেলচালক নিহত হন। তিনি উপজেলার বানিয়ারা গ্রামের কুদরত-ই-খোদার ছেলে। এ ঘটনায় পুলিশ ট্রাকচালক সুকরেজুল ইসলামকে (২৫) গ্রেপ্তার করেছে। তাঁর বাড়ি রাজশাহীর ঘোড়াঘাটে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে ঘাটাইল থানা-পুলিশ জানায়, উপজেলার পেচারআটায় সকালে ট্রাকচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী স্কুলছাত্র সৈকত (১১) নিহত ও তার বাবা মোহাম্মদ বুলবুল আহত হন। বাঁশখালী গ্রামের বুলবুল ছেলেকে স্কুলে দিতে যাচ্ছিলেন। সৈকত ধলাপাড়া হাইস্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র ছিল।
সখীপুর উপজেলার কুতুবপুর বাজার এলাকায় শনিবার সন্ধ্যায় মোটরসাইকেলের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে কলেজছাত্র আরিফ শিকদার (২০) প্রাণ হারান। তাঁর সঙ্গে থাকা দুই সহপাঠী আহত হন। তাঁরা সবাই বড়চওনা-কুতুবপুর কলেজের শিক্ষার্থী। আহত দুজনকে সখীপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে।
রাজধানীতে বাসের ধাক্কায় তরুণ নিহত
পরিবারের সদস্যদের বরাত দিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির এসআই বাচ্চু মিয়া বলেন, রাজধানীর পল্লবীতে গতকাল ভোরে বাসের ধাক্কায় মো. ফরহাদ (২০) গুরুতর আহত হন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। ফরহাদ মিরপুর-১১-এর একটি দোকানে কাজ করতেন।
সাভারে নিহত বাসচালকের সহকারী
ঢাকার সাভার মডেল থানার ওসি কামরুজ্জামান বলেন, ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের সাভারের গেন্ডায় সকালে বাস উল্টে ঘটনাস্থলেই বাসচালকের সহকারী নূরু মিয়া (৩০) নিহত হন। আহত হন ছয়জন। নূরুর বাড়ি রাজবাড়ী সদর উপজেলার বরাট গ্রামে। বাসটি আটক করা হলেও চালক পালিয়ে গেছেন।
গাজীপুরে বাসের ধাক্কায় তরুণ নিহত
সালনা হাইওয়ে থানার ওসি মো. হোসেন সরকার বলেন, ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের কালিয়াকৈরের চন্দ্রায় সকালে ট্রাকের ধাক্কায় মোটরসাইকেল আরোহী আসিফ মাহমুদ (২৮) নিহত হন। তিনি রাজধানীর শেওড়াপাড়ার আক্তার হামিদের ছেলে। পুলিশ ট্রাকটি জব্দ করলেও চালক পালিয়ে গেছেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মোটরসাইকেল আরোহী নিহত
কসবা থানার এসআই মুজিবুর রহমান প্রত্যক্ষদর্শী ব্যক্তিদের বরাত দিয়ে বলেন, কুটি বাজার এলাকায় বিকেলে রিকশার সঙ্গে ধাক্কা লেগে মোটরসাইকেল থেকে পড়ে যান রিফাত হোসেন (২৬)। এরপর গাছের সঙ্গে ধাক্কা লাগে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। তাঁর সঙ্গে থাকা দুজন আহত হন।
সাতকানিয়ায় বাসচাপায় স্কুলছাত্রী নিহত
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের সাতকানিয়ার মিঠাদীঘি এলাকায় সকালে মহাসড়ক পার হওয়ার সময় বাসচাপায় স্কুলছাত্রী রূপসী নাথ (১১) নিহত হয়। এর প্রতিবাদে প্রায় দুই ঘণ্টা মহাসড়ক অবরোধ করে রাখেন বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী। রূপসী ছদাহা কেফায়েত উল্লাহ কবির আহমদ উচ্চবিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী ছিল।
পুলিশ বাসটি আটক করলেও চালক ও সহকারী পালিয়ে গেছেন।
ঝিনাইদহে ট্রাকচাপায় স্কুলছাত্র নিহত
ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার চরবাখরবা গ্রামে সকালে ট্রাকচাপায় সপ্তম শ্রেণির ছাত্র কবির হোসেন (১৪) নিহত হয়। ট্রাকটি জব্দ করেছে পুলিশ।
রাজশাহীতে বাসচাপায় এসএসসি পরীক্ষার্থী নিহত
রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহাসড়কের গোদাগাড়ী উপজেলার বুজরুক রাজরামপুরে বিকেলে বাসের চাপায় মোটরসাইকেল আরোহী এসএসসি পরীক্ষার্থী বরকত-বিন-শহিদ (১৫) নিহত হয়েছে। সে গোদাগাড়ী পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শহিদুল ইসলামের ছেলে। বাসটি জব্দ করা হয়েছে।
ফরিদপুরে ছয়জনের লাশ দাফন
ফরিদপুর জেলা আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের সম্পাদক এ এ সামাদ বলেন, নগরকান্দায় শুক্রবার রাতের সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ১৩ জনের মধ্যে পরিচয় শনাক্ত না হওয়া ৬ জনের লাশ আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের মাধ্যমে গতকাল শহরের আলীপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। এর আগে লাশগুলোর ময়নাতদন্ত ও ডিএনএ পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ করা হয়।
ফরিদপুরের এনডিসি সুমন কুমার দাশ বলেন, ওই দুর্ঘটনায় নিহত আরও একজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তিনি নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার মঠবাড়ী গ্রামের হাফিজার সিকদারের ছেলে বাসযাত্রী মনির সিকদার (২৬)।
ওই দুর্ঘটনায় শনিবার রাতে ভাঙ্গা হাইওয়ে পুলিশের এসআই মোহসিন আলী বাসচালক হেমায়েত হোসেন ও তাঁর সহকারী মো. জুয়েল এবং কাভার্ড ভ্যানের চালক আসাদুজ্জামান ও তাঁর অজ্ঞাত সহকারীকে আসামি করে নগরকান্দা থানায় মামলা করেন। নগরকান্দা থানার ওসি এ এফ এম নাসিম বলেন, ওই সড়ক দুর্ঘটনায় দুই চালক ও তাঁদের দুই সহকারী নিহত হয়েছেন। পুলিশ তদন্ত করে তাঁদের মৃত বলে উল্লেখ করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেবে।
http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1080301/%E0%A7%A8%E0%A7%AA-%E0%A6%98%E0%A6%A3%E0%A7%8D%E0%A6%9F%E0%A6%BE%E0%A7%9F-%E0%A6%86%E0%A6%B0%E0%A6%93-%E0%A7%A8%E0%A7%AB-%E0%A6%9C%E0%A6%A8%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%A3-%E0%A6%97%E0%A7%87%E0%A6%B2