১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, সোমবার, ১০:২২

দরপত্র ও চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ নিয়েই ছাত্রলীগে সংঘর্ষ

বিভিন্ন উন্নয়নকাজের দরপত্রের ভাগ পাওয়া, চাঁদাবাজির কর্তৃত্ব ও মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ—এই তিন কারণে চট্টগ্রামের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা বারবার সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছেন। এসব সংঘর্ষ কখনো ক্যাম্পাসের ভেতরে, কখনোবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে ঘটছে। গত ১৩ মাসে চট্টগ্রামে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ বিরোধকে কেন্দ্র করে অন্তত ২৫ বার সংঘর্ষ হয়েছে। এসব ঘটনায় খুন হয়েছেন তিনজন। আহত হয়েছেন অন্তত ৬৫ জন।
সর্বশেষ গত শনিবার বিকেলে চট্টগ্রাম নগরের রেয়াজউদ্দিন বাজারে একটি হোটেলে ভাত খাওয়ার সময় প্রতিপক্ষের ছুরিকাঘাতে প্রাণ হারান সরকারি সিটি কলেজ ছাত্রলীগের কর্মী ইয়াছিন আরাফাত। মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে এমন আলোচনা সামনে চলে এসেছে। প্রাথমিকভাবে পুলিশও তা-ই ধারণা করছে। চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের গণশিক্ষাবিষয়ক উপসম্পাদক আবদুল আহাদও একই কথা বলেছেন। ইয়াছিন তাঁর অনুসারী ছিলেন।
শনিবার বিকেলের ওই ঘটনার পর গভীর রাতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহজালাল হলেও ছাত্রলীগের দুই পক্ষ সংঘর্ষে জড়ায়। এতে আহত হন পাঁচজন। এ সময় হলের অন্তত ১৪টি কক্ষ ভাঙচুর করা হয়।
ছাত্রদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে কাজ না করে দোকানদারি, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি ও দখলবাজিতে এখনকার অনেক ছাত্রনেতা জড়িয়ে পড়ায় সংঘর্ষ ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে বলে মন্তব্য করেছেন চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক চৌধুরী হাসান মাহমুদ হাসনী। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের এই প্যানেল মেয়র আক্ষেপ করে প্রথম আলোকে বলেন, ছাত্রলীগের সংঘর্ষ বন্ধের জন্য বিভিন্ন সময়ে তাঁরা উদ্যোগ নিয়েছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এসব উদ্যোগ তেমন ফলপ্রসূ হয়নি।
গত বছরের ১৯ নভেম্বর লালদীঘি মাঠে এক অনুষ্ঠানে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোছলেম উদ্দিন আহমেদকে প্রকাশ্যে লাঞ্ছিত করেন ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা-কর্মী। ছাত্রলীগের কিছু নেতা-কর্মীর বেপরোয়া আচরণ নিয়ে বিভিন্ন সময় ক্ষোভ প্রকাশ করেন আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতারা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ৯৫ কোটি টাকা ব্যয়ে দুটি ভবন নির্মাণের দরপত্রকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মধ্যে গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর মাসের মধ্যে অন্তত ছয়বার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছে। এতে গুরুতর আহত হয়েছেন ১০ জন।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি খোরশেদ আলম সুজন বলেন, ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট ভোগ করতে অনেকে ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশ করেছেন। তাঁরাই সংঘাত উসকে দিচ্ছেন।
গত বছরের ২০ নভেম্বর রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই নম্বর গেট এলাকার নিজ বাসা থেকে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সহসম্পাদক দিয়াজ ইরফান চৌধুরীর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এর ২২ দিন আগে দিয়াজসহ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের চার নেতার বাসায় তাণ্ডব চালায় প্রতিপক্ষরা। পরিবার ও ছাত্রলীগের এক পক্ষের নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, দিয়াজকে হত্যা করে ঘটনাটি আত্মহত্যা হিসেবে প্রচারের জন্য লাশ ঝুলিয়ে রাখে প্রতিপক্ষ।
এর আগে গত বছরের ২৯ মার্চ চট্টগ্রামে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়াসা ক্যাম্পাসে প্রতিপক্ষের ছুরিকাঘাতে খুন হন আরেক ছাত্রলীগ নেতা নাসিম আহমেদ।
চট্টগ্রাম নগর ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা দুটি ধারায় বিভক্ত। এক পক্ষ নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী। গত ২৫ ডিসেম্বর মহিউদ্দিন চৌধুরীর চশমাহিলের বাসায় এক বৈঠকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের তিন মাসের মধ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কোন্দল মেটানোর নির্দেশ দেন। কিন্তু দেড় মাস পার না হতেই মেয়রের অনুসারী নেতা-কর্মীরা গত শনিবার ক্যাম্পাসে নিজেদের মধ্যে মারামারিতে জড়িয়ে পড়েন।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম প্রথম আলোকে বলেন, সংগঠনের কিছু নেতা-কর্মীর নৈতিক বিচ্যুতি ঘটেছে। এ কারণে বারবার সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী এই ছাত্রনেতা বলেন, সংগঠনবিরোধী কার্যক্রমের জন্য গত এক বছরে নয়জনকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
অপরদিকে আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী নগর ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক ওয়াহেদ রাসেল প্রথম আলোকে বলেন, ব্যবসায়িক স্বার্থ হাসিল এবং দরপত্রের নিয়ন্ত্রণই হচ্ছে সংঘর্ষের মূল কারণ। তবে দুজনই দাবি করেন, রাজনৈতিক কারণে কোনো সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেনি।
তিন দশকের বেশি সময় ধরে ছাত্রশিবিরের ‘নিয়ন্ত্রণে’ ছিল চট্টগ্রাম কলেজ ও হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ। ২০১৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর এ দুটি কলেজে প্রকাশ্য রাজনীতি করার সুযোগ পায় ছাত্রলীগ। শুরুতে কলেজের নিয়ন্ত্রণ ছিল এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারীদের কাছে। পরে আ জ ম নাছির উদ্দীন এবং প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী নুরুল ইসলামের অনুসারীরাও কলেজে নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করে। তিন পক্ষই কলেজে ‘সক্রিয়’ হয়ে ওঠার চেষ্টা করায় গত এক বছরে সেখানে অন্তত সাতবার সংঘর্ষ হয়েছে। গুলিবিদ্ধসহ আহত হয়েছেন ২০ জন।
ছাত্রনেতারা ছাত্রদের নিয়ে না ভেবে ক্ষমতার হালুয়া-রুটির ভাগ নিতেই ঝগড়াঝাঁটিতে লিপ্ত থাকেন বলে মন্তব্য করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউজিসি অধ্যাপক মইনুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ক্ষমতাসীন দলের লেজুড়বৃত্তি পরিত্যাগ না করলে ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে অন্তঃকোন্দল চলতেই থাকবে। আর রাজনৈতিক দলে মাস্তান লালনের যে ‘আইডিয়া’ (চিন্তা) কাজ করছে তা থেকে সরে না এলে ছাত্রসংগঠনের নিজেদের মধ্যে মারামারি কমবে না।
http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1080259/%E0%A6%A6%E0%A6%B0%E0%A6%AA%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0-%E0%A6%93-%E0%A6%9A%E0%A6%BE%E0%A6%81%E0%A6%A6%E0%A6%BE%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%9C%E0%A6%BF%E0%A6%B0-%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A7%9F%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%A3-%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A7%9F%E0%A7%87%E0%A6%87-%E0%A6%9B%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0