১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, রবিবার, ৫:১৩

বিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠতে পারল না নতুন ইসিও: কর্মকর্তারা বিব্রত

শপথের আগেই নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) নিয়ে বিতর্ক চলছে। বিশেষ করে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে নিয়ে রাজনৈতিক জোটসহ বিভিন্ন মহলে সমালোচনার ঝড় বইছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ জোট পুরো কমিশনকে নিরপেক্ষ ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য দাবি করলেও সরকারবিরোধী জোট এ কমিশনকে ক্ষমতাসীনদের সমর্থক বলে অভিযোগ করছে। নতুন কমিশনে নাগরিকসমাজের কোনো প্রতিনিধি না থাকায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন খোদ সার্চ কমিটির একজন প্রভাবশালী সদস্য। ফলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে আলোচনার ভিত্তিতে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে রাষ্ট্রপতির প্রশংসিত উদ্যোগটি খানিকটা বিতর্কের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। কেউ কেউ আবার মনে করছেন, নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া রাষ্ট্রপতির প্রশংসিত উদ্যোগ হলেও তা নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে; যে বিতর্ক একাদশ জাতীয় নির্বাচনসহ আগামী পাঁচ বছর ধরেই চলতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
শুরুতেই যে বিতর্কের মধ্যে পড়েছে নবনিযুক্ত সিইসি ও অন্যান্য কমিশনার তাতে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের কর্মকর্তারা বিব্রত অবস্থায় পড়েছেন। তাদের বিদায়ী কমিশন নিয়ে পাঁচ বছর তীব্র সমালোচনা করতে হয়েছে। তাদের প্রত্যাশা ছিল নতুন কমিশন হওয়ার পর সে পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসা যাবে। কিন্তু বিতর্কের পারদ যে হারে ক্রমে ঊর্ধ্বমুখী তাতে তারাও প্রমাদ গুনছেন। নতুন ইসি দায়িত্ব গ্রহণের দুই দিন পর থেকেই শুরু হবে কয়েকটি নির্বাচন। ইসি সূত্র জানায়, রকীব কমিশন বিদায়ের আগে জাতীয় সংসদের গাইবান্ধা-১ আসনের উপনির্বাচন, একটি পৌরসভা, তিন উপজেলায় সাধারণ নির্বাচন, ১৫ উপজেলায় উপনির্বাচনসহ চার পৌরসভায় উপনির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে। নতুন ইসি এসব নির্বাচনে ভোটগ্রহণ করবে। এ ছাড়া মেয়াদ শেষ হওয়া কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন, সুনামগঞ্জ-২ আসনে উপনির্বাচনসহ বেশ কিছু পৌরসভায় আগামী তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন হতে হবে। এগুলোতে স্বল্পসময়ের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে নতুন কমিশনকে।
৩১টি রাজনৈতিক দলের সাথে আলোচনা করে গঠন করা সার্চ কমিটির সুপারিশের পর রাষ্ট্রপতি মো: আবদুল হামিদ গত ৬ ফেব্রুয়ারি কে এম নুরুল হুদাকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার করে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করেন। অন্য কমিশনাররা হলেন সাবেক অতিরিক্ত সচিব মাহবুব তালুকদার, সাবেক সচিব মো: রফিকুল ইসলাম, অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ কবিতা খানম এবং ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) শাহাদৎ হোসেন চৌধুরী। আগামী বুধবার প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্য কমিশনাররা শপথ গ্রহণ করবেন।
এর আগে সার্চ কমিটি রাষ্ট্রপতির সাথে সংলাপে অংশ নেয়া ৩১টি দলের কাছে নাম চায়। এ ছাড়া দুই দফা ১৬ জন বিশিষ্ট নাগরিকের মতামত গ্রহণ করে সার্চ কমিটি। এর মধ্যে ২৬টি রাজনৈতিক দল সাড়া দেয় এবং ২৫টি দল নাম জমা দেয় পাঁচটি করে। মোট জমা পড়া ১২৫টি নাম থেকে প্রাথমিকভাবে ২০টি নাম বাছাই করে সার্চ কমিটি। সেখান থেকে চূড়ান্তভাবে ১০ জনের নাম প্রস্তাব করা হলে রাষ্ট্রপতি পাঁচজনকে দিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করেন।
নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের পরপরই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের শরিক দলগুলোর নেতারা এ কমিশনকে একটি নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য দাবি করে অভিনন্দন জানান। অন্য দিকে বিএনপিসহ সরকারবিরোধী জোটের শরিকরা কমিশনের বিষয়ে আপত্তি তুলে কঠোর সমালোচনা করছেন। বিশেষ করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদাকে তারা বহুল আলোচিত ‘জনতার মঞ্চের’ সক্রিয় আমলা বলে অভিযোগ করছেনÑ যেই মঞ্চ ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলে। সেই রোষানলে পড়ে ২০০১ সালের পর ক্ষমতাসীন বিএনপির পুরোটা সময় তিনি ওএসডি ছিলেন। আর বিএনপির সময় ওএসডি থাকা এই সাবেক আমলা একটি দলের সমর্থক হওয়ায় নির্বাচনে কোনোভাবেই নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে পারবে না বলে অভিযোগ বিএনপির। এ ছাড়া সম্প্রতি সিইসির নিজ এলাকা পটুয়াখালী বাউফল আওয়ামী লীগের নেতারা তাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন, যা তাকে একটি দলের সমর্থক বলে প্রমাণ করে। আর একটি দলের সমর্থকের অধীনে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদার নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে গতকাল শনিবার বলেছেন, পত্রপত্রিকায় প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে নিয়ে যে ছবি ছাপা হয়েছে এবং মিডিয়াতে যেটা এসেছে, তাতে সিইসির নাম ঘোষণার পরে আমরা যে বক্তব্য রেখেছিলাম সেটাই সত্য প্রমাণিত হয়েছে। আমরা আবারো নিশ্চিত করে বলতে চাই, এই প্রধান নির্বাচন কমিশনারের নেতৃত্বে ইসি কখনোই নিরপেক্ষ ভূমিকা পালনে সক্ষম হবে না। কারণ তার দলীয় পক্ষপাতের ব্যাপারটি এখন জনগণের কাছে অত্যন্ত পরিষ্কার হয়ে গেছে। পটুয়াখালীর বাউফলে নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে আওয়ামী লীগ নেতাদের শুভেচ্ছা জানানোর ছবি প্রকাশ হওয়া প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বিএনপি মহাসচিব এ কথা বলেন।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আরো বলেন, যেহেতু নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়নি, সেহেতু আমাদের নির্দলীয় সরকারের দাবির যৌক্তিকতা আরো সুদৃঢ় হয়েছে। ফলে আগামী নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ফের উত্তেজনা বাড়তে পারে।
তবে বিএনপির এসব অভিযোগ উড়িয়ে দিচ্ছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। নতুন নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, রাষ্ট্রপতি একক ক্ষমতাবলে ইসি গঠন না করে সবার সাথে আলোচনা করেছেন। বিএনপি নামের তালিকা দিয়েছে। তাদের তালিকা থেকেও কমিশনের সদস্য আছে। সুতরাং এখন বিএনপি নির্বাচন কমিশনকে মানলো কি মানলো না তাতে জাতির কিছু আসে যায় না।
তিনি বলেন, আন্দোলনে ব্যর্থতার কারণে হতাশ বিএনপি বর্তমানে বেপরোয়া। আর বেপরোয়া চালক যেমন দুর্ঘটনার কারণ তেমনি বিএনপিও দুর্ঘটনা ঘটিয়ে বসতে পারে।
দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বিএনপি নেতাদের বক্তব্যের সমালোচনা করে বলেন, বিএনপি ভুল রাজনীতির কারণে হতাশাগ্রস্ত। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ না করাটা ছিল ভুল সিদ্ধান্ত। এই ভুলের দায়ভার তারা নির্বাচন কমিশনের ওপর চাপিয়ে সান্ত্বনা খোঁজার চেষ্টা করছেন।
তিনি আরো বলেন, রাষ্ট্রপতি রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনা করেই সবার কাছে গ্রহণযোগ্য এ কমিশন গঠন করেছেন। নবনিযুক্ত নির্বাচন কমিশন এখনো কাজই শুরু করেনি। তাই কাজ শুরু করার আগে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা যুক্তিসঙ্গত নয়।
এ দিকে ইসি গঠন নিয়ে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন সুশীলসমাজের প্রতিনিধিরাও। সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার অভিযোগ করেছেন, ইসি সদস্য বাছাইয়ে স্বচ্ছ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলেছে, তারা নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের বিষয়টির ওপর নজর রাখছে।
ইসি নিয়োগে অনুসন্ধান কমিটির ১০ জনের তালিকায় নাগরিক সমাজের তিন প্রতিনিধির নাম থাকলেও তাদের কাউকেই শেষ পর্যন্ত নেয়া হয়নি। এ নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন খোদ সার্চ কমিটির সদস্যও।
সার্চ কমিটির অন্যতম সদস্য সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘প্রস্তাবিত ১০ জনের মধ্যে যে কাউকে রাখতে পারেন রাষ্ট্রপতি। কিন্তু নাগরিকসমাজের কাউকে না রাখায় অবাক হয়েছি।’
http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/195118