১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, রবিবার, ৫:১২

দুর্নীতিগ্রস্ত বেসিক ব্যাংককে ২৬ শ’ কোটি টাকার বন্ড দিতে মরিয়া ব্যাংকিং বিভাগ!

দুর্নীতিগ্রস্ত বেসিক ব্যাংককে বিশাল অঙ্কের বন্ড দিতে উঠেপড়ে লেগেছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। উপর থেকে অনেকটা চাপ দিয়ে এই ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি মেটাতে দুই হাজার ৬০০ কোটি টাকার বন্ড ইস্যু করার চেষ্টা করছে এই বিভাগ। কম করে হলেও তিনবার অর্থ বিভাগের কাছে এই পরিমাণ বন্ড চেয়ে চিঠি দিয়েছে এই বিভাগ। কিন্তু অর্থ বিভাগ এতে রাজি হয়নি। এখন আবার অর্থমন্ত্রীর কিঞ্চিৎ সম্মতিতে আবারো এই বন্ড দেয়ার জন্য অর্থ বিভাগকে চাপ দেয়ার জন্য একটি বৈঠক আয়োজনে অর্থমন্ত্রীর সহায়তা চাওয়া হয়েছে। অর্থমন্ত্রীর কাছে পাঠানো এই চিঠিতে বলা হয়েছে, বেসিক ব্যাংকের স্বাভাবিক ব্যবসাবাণিজ্য চালিয়ে যেতে এই এই বন্ড দেয়া প্রয়োজন। মজার ব্যাপার হচ্ছে চিঠিতে এও বলা হয়েছে, বন্ডের অর্থ ফেরত দিতে যদি ব্যাংকটি ব্যর্থ হয় তবে এর দায় সরকারকেই পরিশোধ করতে হবে।
এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বিষয়টি অনেকটা চূড়ান্ত হয়েছে। অর্থমন্ত্রী রাষ্ট্রীয় কাজে বর্তমানে বিদেশ রয়েছেন। তিনি ফিরলেই উচ্চপর্যায়ের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। অর্থমন্ত্রী ছাড়াও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সচিব, বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক বৈঠকে উপস্থিত থাকবেন।
জানা গেছে, গত সপ্তাহে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব মো: ইউনুসুর রহমান বিষয়টি অবহিত করতে অর্থমন্ত্রীর জন্য একটি সারসংক্ষেপ পাঠিয়েছেন। এতে বলা হয়েছে, বেসিক ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি পূরণের জন্য ১০-২০ বছর মেয়াদি ২৬০০ কোটি টাকার বেসিক ব্যাংক রি-ক্যাপিটাইলজেশন বন্ড ইস্যু করার প্রস্তাবটি বর্তমানে অর্থ বিভাগের বিবেচনাধীন। এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে গত ৫ ফেব্রুয়ারি একটি অনানুষ্ঠানিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মতামতের আলোকে ব্যাংকটির অনুকূলে রি-ক্যাপিটালাইজেশন বন্ড ইস্যু করার প্রস্তাব অর্থমন্ত্রী গত বছর ২১ ডিসেম্বর অনুমোদন দেন। বেসিক ব্যাংকের প্রস্তাবনা বাংলাদেশ ব্যাংকের মতামত ও অর্থমন্ত্রীকর্তৃক অনুমোদিত সারসংক্ষেপ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাসহ অর্থ বিভাগে পাঠানো হয়। বিষয়টি বর্তমানে অর্থ বিভাগের বিবেচনাধীন রয়েছে। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে উচ্চপর্যায়ের একটি বৈঠকের প্রয়োজনীয়তার কথা অবহিত করে অর্থমন্ত্রীর কাছে একটি সারসংক্ষেপ পাঠানো হয়েছে। অর্থমন্ত্রীর অনুমতি পেলেই বৈঠকের তারিখ নির্ধারণ করা হবে।
সূত্র জানায়, এর আগে বেসিক ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি পূরণের লক্ষ্যে বেসিক ব্যাংক থেকে রি-ক্যাপিটালাইজেশন বন্ড ইস্যুর জন্য একটি আবেদন করা হয়। এতে ব্যাংকটির ঝুঁকি-ভরযুক্ত, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী ন্যূনতম প্রয়োজনীয় মূলধন, বর্তমানে সংরক্ষিত মূলধন, মূলধন ঘাটতি ইত্যাদি পূরণের জন্য ২৬০০ কোটি টাকার বেসিক ব্যাংক রি-ক্যাপিটাইলাইজেশন বন্ড ইস্যু করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়।
সূত্র জানায়, বেসিক ব্যাংকের চিঠি অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক নির্ধারিত মূলধন সংরক্ষণের হার বিবেচনায় ব্যাংকটির বর্তমান মূলধন ঘাটতির পরিমাণ ২৫৯৩ কোটি ৩১ লাখ টাকা। মূলধন ঘাটতি পূরণে ওই বন্ড ইস্যু করার জন্য যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছে যে, মূলধন ঘাটতি থাকায় ব্যাংকের বৈদেশিক বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ব্যাংকের স্বাভাবিক আয় থেকে এই ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব নয় উল্লেখ করে নগদ অর্থের পরিবর্তে বন্ড ইস্যু করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
ব্যাংকগুলোর জন্য বর্তমানে মূলধন সংরক্ষণের হার ঝুঁকি-ভরযুক্ত সম্পদের ১০ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা ২০১৬-১৯ মেয়াদে ব্যাসেল-৩ বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। সে অনুযায়ী ওই হার ক্রমান্বয়ে ২০১৯ সাল নাগাদ ১২ দশমিক ৫ শতাংশে উন্নীত হবে।
মূলধন ঘাটতি পূরণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের মতামত অনুযায়ী ২৬০০ কোটি টাকা বন্ড ইস্যু করার প্রস্তাব করেছে বেসিক ব্যাংক। তাদের প্রস্তাব অনুযায়ী সাধারণ শেয়ারের বিপরীতে ১০ বছর মেয়াদি ৮০০ কোটি, ১৫ বছর মেয়াদি ৮০০ কোটি এবং ২০ বছর মেয়াদি ১০০০ কোটি সর্বমোট ২৬০০ কোটি টাকার সুদহিলেবিহীন বন্ড দেয়া হলে ব্যাংকের ২০১৬ সালের জুন ভিত্তিক পিলার-১ মূলধনের ঘাটতি পূরণসহ পিলার-২ এর মূলধন ঘাটতির আংশিক পূরণ হবে।
সূত্র জানায়, ব্যাংকটি তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী মুনাফা করতে সফল হলে সে ক্ষেত্রে তাদের শেয়ার সরকারের কাছ থেকে পুনঃক্রয়ের ফলে পরিশোধিত বন্ডের অর্থ ক্রমান্বয়ে কমবে এবং সরকারের কোনো আর্থিক দায় থাকবে না। উল্লেখ্য রি-ক্যাপিটাইলাইজেশন বন্ড ইস্যুর বিপরীতে বেসিক ব্যাংক কর্তৃক সরকারের অনুকূলে শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে মূলধন সংস্থানের কার্যক্রমটির বিপরীতে বর্তমানে কোনো ধরনের আর্থিক লেনদেন হবে না। তবে বেসিক ব্যাংক যদি পরিকল্পনা অনুযায়ী পর্যাপ্ত মুনাফা অর্জন করতে সক্ষম না হয় সে ক্ষেত্রে সরকারকে বন্ডের মূল্য হিসেবে মেয়াদ শেষে বেসিক ব্যাংকের অনুকূলে ওই ২৬০০ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হবে।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশ সরকার ব্যাংকটির শতভাগ শেয়ারের মালিক। তাই এ ঘাটতি মূলধন পূরণের আবশ্যকতা রয়েছে। ওই ঘাটতি পূরণে সরকার কর্তৃক বার্ষিক বাজেট থেকে বরাদ্দের মাধ্যমে মূলধন সরবরাহের সুযোগ রয়েছে। তবে বিপুল পরিমাণ মূলধন ঘাটতি বাজেট থেকে পূরণ করা হলে বাজেটের ওপর চাপ সৃষ্টি হবে। এ অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংকের মতামত অনুযায়ী বেসিক ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি পূরণের লক্ষ্যে ‘বেসিক ব্যাংক রি-ক্যাপিটালাইজেশ বন্ড’ ইস্যুর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
এর আগেও বেসিক ব্যাংকের আর্থিক সঙ্কট কমানোর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে তিন দফায় দুই হাজার তিন শ’ ৯০ কোটি টাকা দেয়া হয়েছিল। প্রথমবার ২০১৪ সালে প্রথম দফায় ৭৯০ কোটি টাকা এবং দ্বিতীয় দফায় ৪০০ কোটি টাকা দেয়া হয়। পরবর্তীতে গত বছর দেয়া হয়েছিল আরো ১২ শ’ কোটি টাকা।
সরকারি মালিকানাধীন বেসিক ব্যাংক ২০০৯ সাল পর্যন্ত একটি লাভজনক ব্যাংক ছিল। কিন্তু এরপর যখন রাজনৈতিক বিবেচনায় ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে শেখ আব্দুল হাই বাচ্চুকে নিয়োগ দেয়া হয় তখন থেকেই ব্যাংকটির আর্থিক অনিয়মের সূত্রপাত ঘটে। চেয়ারম্যান ও পরিচালনা পর্ষদের প্রত্যক্ষ মদদে বেসিক ব্যাংকে একে একে ঘটে যায় অনেক আর্থিক কেলেঙ্কারি। এই কেলেঙ্কারিতে আত্মসাৎ করা হয় প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা যা ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদনে এই চিত্র ফুটে উঠেছে। ২০১৪ সালের আগস্ট মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়, প্রধান কার্যালয়ের ঋণ যাচাই কমিটি বিরোধিতা করলেও বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ সেই ঋণ অনুমোদন করেছে। ৪০টি দেশীয় তফসিলি ব্যাংকের কোনোটির ক্ষেত্রেই পর্ষদ কর্তৃক এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ কার্যক্রম পরিলক্ষিত হয় না। পর্ষদের ১১টি সভায় ঋণ অনুমোদন করা হয়েছে তিন হাজার ৪৯৩ কোটি ৪৩ লাখ টাকা যার অধিকাংশ ঋণই গুরুতর অনিয়ম সংঘটনের মাধ্যমে করা হয়েছে। এই ঋণ পরিশোধ বা আদায় হওয়ার সম্ভাবনা কম বলেও মতামত দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/195149